ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নদী বাঁচানো কঠিন ॥ দূষণকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থার তাগিদ

আবারও বর্জ্যরে ভাগাড় বুড়িগঙ্গা

প্রকাশিত: ১১:০৬, ১৪ মার্চ ২০২০

আবারও বর্জ্যরে ভাগাড় বুড়িগঙ্গা

শাহীন রহমান ॥ নদী উদ্ধারে ঢাকঢোল পেটানোর মধ্যেও বুড়িগঙ্গা আবারও বর্জ্যরে ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। নদীর দুই পাড় জুড়ে এখন আবর্জনার স্তূপ। প্রতিনিয়ত বাসাবাড়িসহ শিল্প কলকারখানার বর্জ্য সরাসরি পাড়েই ডাম্পিং করা হচ্ছে। এভাবে নদীপাড়ে ময়লা আবর্জনা ফেলায় চারদিকের পরিবেশ দুর্গন্ধময় হয়ে পড়ছে। আবার এসব বর্জ্যরে শেষ ঠিকানা হচ্ছে বুড়িগঙ্গা। ফলে নদীও দূষিত হয়ে পড়ছে। এছাড়া আবর্জনার দুর্গন্ধের কারণে এলাকার ব্যবসা-বাণিজ্যের বড় ধরনের ক্ষতি হচ্ছে। সরেজমিন দেখা গেছে, বাসাবাড়ির কঠিন বর্জ ভ্যানে করে নদীর পাড়ে ফেলা হচ্ছে। আবার তৈরি পোশাক শিল্পের বর্জ্যও এই পাড়ের উপর স্তূপ করা হচ্ছে। হাসনাবাদ থেকে বছিলা পর্যন্ত নদীর পাড় এখন ময়লা আবর্জনার ডাম্পিং স্টেশন। কোন নিয়ম নীতি ছাড়াই পাড়ে জমা হচ্ছে এই বর্জ্য। এরপর সেগুলো চলে যাচ্ছে নদীতে। গত বছর সারাদেশের নদীর রক্ষায় মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করেছে সরকার। যে অনুযায়ী দখল দূষণ প্রতিরোধে ব্যাপক অভিযান চলছে। কিন্তু এই অভিযানের মধ্যে এভাবে নদীতে আবর্জনা ফেলায় নদী রক্ষা কার্যক্রমই হুমকির মুখে পড়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকা বাঁচাতে হলে বুড়িগঙ্গাকে রক্ষা করা জরুরী। কিন্তু দূষণ যেভাবে ছড়িয়ে পড়েছে এভাবে চলতে থাকলে নদী রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়বে। নদী বাঁচাতে সরকারের পদক্ষেপের পাশাপাশি সাধারণ জনগণ জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্ব রয়েছে। সবাই যদি দায়িত্ব পালন করতেন তাহলে কেউ নদীতে বর্জ্য ফেলতে সাহস পেত না। এক্ষেত্রে মানুষের সচেতনতার বড়ই অভাব রয়েছে। গত বছর ফেব্রুয়ারি থেকে নদীর দখলদার উচ্ছেদে ব্যাপক অভিযান পরিচালনা করে আসছে বিআইডব্লিউটিএ। গত বছর এক দফা অভিযান শেষে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে আবারও কঠোর অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। এই দফায় অভিযানে কোন প্রভাবশালীকে ছাড় দেয়া হচ্ছে না। এমনকি ঢাকা ১৪ আসনের সংসদ সদস্য আসলামুল হকের অবৈধ স্থাপনাও গুঁড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। সাধারণ জনগণ বিআইডাব্লিউটিএর এই পদক্ষেপের প্রশংসা করলেও তারা নদীর দূষণরোধে গৃহীত কার্যক্রমে হতাশ হয়ে পড়ছে। তারা বলছেন শুধু দখল উচ্ছেদ নয়। যারা দূষণের সঙ্গে জড়িত তাদের আইনের আওতায় আনাও জরুরী হয়ে পড়েছে। দীর্ঘদিন ধরে নদী দখলদার উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করে আসছেন বিআইডব্লিউটিএর যুগ্ম পরিচালক একেএম আরিফ উদ্দিন। তিনি আক্ষেপ করে বলেন ‘সর্বাঙ্গে ব্যথা, ওষুধ দেব কোথা।’ আসলে নদীর দখল দূষণ রোধে সবারই দায়িত্ব রয়েছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ সাধারণ মানুষেরও এ বিষয়ে দায়িত্ব রয়েছে। শুভাঢ্যা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, কেরানীগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যানসহ এলাকায় জনপ্রতিনিধিরা এ বিষয়ে দায়িত্ব নিয়েছিলেন যাতে কেউ নদীতে বর্জ্য ফেলতে না পারে। এছাড়া কেরানীগঞ্জ তৈরি পোশাক শিল্পমালিক সমিতির পক্ষ থেকেও এ বিষয়ে ওয়াদা করা হয়েছিল নদীতে বর্জ্য না ফেলার। কিন্তু কেউ তাদের দায়িত্ব পালন করছে না। তিনি বলেন, এখন আর কাউকে এ বিষয়ে সচেতন করা হবে না। যারা বর্জ্য নদীতে ফেলবে তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। প্রয়োজনে জেল-জরিমানা করা হবে। সরেজমিন দেখা গেছে, বুড়িগঙ্গার দক্ষিণ প্রান্তে শুভাঢ্যা খালের ব্রিজের দু’পাশ এখন আবর্জনার স্তূপে পরিণত করা হয়েছে। এলকার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা জানান এই আবর্জনার দুর্গন্ধের কারণে তাদের ব্যবসায়েও অনেক ক্ষতি হচ্ছে। ময়লা আবর্জনার গন্ধ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে পরিবেশ যেমন দূষিত করছে, তেমনি কোন খরিদ্দার এই এ কারণে আসতে চান না। শুধু তাই নয়, নদীর পাড়ে যে আবর্জনার স্তূপ জমা হয়েছে তার শেষ ঠিকানা নদীর পানিতে গিয়ে মিশেছে। ফলে নদীর পানিও দূষিত হয়ে পড়ছে। কিন্তু দেখার কেউ নেই। এভাবে চলতে থাকলে নদীয় বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়বে। এ বিষয়ে পরিবেশ সংগঠন ‘পবা’র নির্বাহী সাধারণ সম্পাদক ও পরিবেশ অধিদফতরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক প্রকৌশলী আবদুস সোবহান জনকণ্ঠকে বলেন, সরকার নদী দখলদার মুক্ত করতে যে পদক্ষেপ নিয়েছে তাকে সাধুবাদ জানাই। কিন্তু একই সঙ্গে নদীর দূষণরোধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। দূষণ রোধ করা না হলে নদী বাঁচানো যাবে না। এছাড়া নদীর নাব্য ফিরে আনতেও পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরী। তিনি বলেন, ঢাকার লোকসংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। সেই সঙ্গে শিল্প কলকারখানাও বাড়ছে। ওয়াসার স্যুয়ারেজ লাইন বাড়ছে। এর মাধ্যমে দূষিত বর্জ্য নদীতে পড়ছে। শিল্পকারখানার দূষিত বর্জ্য নদীতে পড়লেও কোন ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। শিল্প মালিকদের এর বিরুদ্ধে সচেতন হতে হবে। আবার যেসব জাহাজ নদীতে চলাচল করে তার বর্জ্যও সদরঘাটে এসে নদীতে ফেলা হয়। এর বিরুদ্ধেও কোন পদক্ষেপ নেই। জাহাজের পোড়া মবিল তেল নদীতে ফেলা বন্ধ করতে হবে এখনি। এছাড়া যারা কঠিন বর্জ্য নদীতে ফেলছে তাদের প্রথমত এটি না ফেলার জন্য সচেতন করতে হবে। সচেতন করা না গেলে আইনের আওতায় এনে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এছাড়া ওয়াসা, পরিবেশ অধিদফতরসহ যেসব প্রতিষ্ঠান রয়েছে তাদের এ বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। সবাই একযোগে দায়িত্ব পালন করলে নদী দূষণ রোধ করা অসম্ভব কিছু নয়। তিনি বলেন সরকার নদী রক্ষায় একটি কমিশন গঠন করেছেন। কিন্তু কমিশনের কাজ হলো নদীর সীমান চিহ্নিত করা। কিন্তু দখল দূষণেরোধের কাজ এই কমিশনের নয়। সরকারী যেসব প্রতিষ্ঠান দায়িত্বপ্রাপ্ত রয়েছে তাদের যথাযথ ভূমিকা পালন করতে হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নদী উদ্ধারে এত আলোচনা সমালোচনার পরও অবস্থার যেন কোন পরিবর্তন নেই। দূষণকারীরা আইন প্রশাসনের তোয়াক্কা করছে না। যার যেমন ইচ্ছা নদীকে ভাগাড় হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এলাকাবাসী জানান, নদীর পাড়ের ময়লা স্তূপের কারণে চারদিকে প্রচ- দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। বসবাস, ব্যবসা-বাণিজ্য করা কঠিন হয়ে পড়ছে। দিন-রাত এসব আবর্জনার গন্ধ বাতাসে ভেসে নাকে এসে লাগছে। এলাকাবাসী জানান, ময়লার দুর্গন্ধের কারণে অনেকে নদীর তীরের মার্কেটগুলোতে যেতে চান না। সারাদিন গন্ধের মধ্যে দোকানগুলোতে বসে থাকাও কঠিন হয়ে পড়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পাড়ে সবচেয়ে বেশি বর্জ্য পড়ছে কেরানীগঞ্জের বিভিন্ন তৈরি পোশাক শিল্পের। এই বর্জ্যরে কারণে নদী তীর এখন ভাগাড়ে পরিণত হচ্ছে। এর বাইরেও বাসাবাড়ির কঠিন বর্জ্য বুড়িগঙ্গা পাড়ে ফেলা হচ্ছে। এছাড়া তীর অবস্থিত বিভিন্ন ডাইং শিল্পকলকারখানার তরল বর্জ্য সরাসরি নদীতে পড়ছে। ফলে বুড়িগঙ্গার পানি দিন দিন কালো রং ধারণ করছে। দূষিত পানির কারণে নদীর পাড়ে হেঁটে চলা মুশকিল। আবার পাড়ের কঠিন বর্জ্য পচেও চারদিকে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। ময়লা আবর্জনা ফেলার কারণে সদরঘাটের বিপরীতে অবস্থিত শুভাঢ্যা খাল এখন বন্ধের পথে। সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে শুভাঢ্যা খাল পুরোটা দখল করে স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে। স্থাপনার নিচ দিয়ে নালার মতো দূষিত পানি প্রবাহের পথ রয়েছে শুধু। এই নালা দিয়ে কেরানীগঞ্জের সব তরল বর্জ্য বুড়িগঙ্গায় জমা হচ্ছে। অথচ এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এক সময় এই শুভাঢ্যা খাল দিয়ে জাহাজ চলাচল করত। কিন্তু এখন এই খালের অস্তিত্ব আর নেই। সবই দখল করে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে। যেটুকু নালার মতো রয়েছে তা দিয়ে এলাকার সব দূষিত পানি নদীতে পড়ছে। এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মহল্লার কঠিন বর্জ্য ভ্যানে করে প্রতিনিয়ত ফেলা হয় নদীর দুইপাড়ে। আবার ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কের পাশে বুড়িগঙ্গার ব্রিজের নিচও ডাম্পিং স্টেশনে পরিণত করা হয়েছে। জিনজিরায় বাঁশপট্টি এলাকায় অর্ধেক নদী দখল করে আবর্জনা ফেলা হয়েছে। রসুলপুরে বর্জ্য আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত করা হয়েছে। বরিসুর বাজার এলাকায় নদীর তীরে এভাবে বর্জ্য ফেলায় চারদিকে দুর্গন্ধে চলাচল করা কঠিন হয়ে পড়েছে। খোলামোড়া এলাকায় দিনের বেলায় আবর্জনা ফেলা বসবাস করা কঠিন হয়ে পড়ছে। বাতাসে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ার কারণে রাতে ঘুমানোও কঠিন হয়ে পড়ছে। অথচ সরকার সারাদেশে নদী খাল ও জলাশয় রক্ষায় জিরো টলারেন্স নীতি নিয়েছে। সে অনুযায়ী অভিযান চালানো হচ্ছে। রাজধানীর আশপাশের বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ ও চট্টগ্রামের কর্ণফুলীসহ অন্যান্য নদী দখল ও দূষণমুক্ত এবং নাব্য ফিরিয়ে আনতে আগেই তৈরি করা হয়েছে একটি মাস্টারপ্ল্যান। মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে অভিযান শুরু হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই অবস্থার মধ্যে ঢাকার প্রাণ বুড়িগঙ্গায় যেভাবে আবর্জনা ফেলা হচ্ছে তাতে সরকারের নদী রক্ষা কার্যক্রম কতটা সফলতা পাবে তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
×