ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

যার কেউ নেই তার পাশে আলেয়া

প্রকাশিত: ০৯:৪০, ১৪ মার্চ ২০২০

যার কেউ নেই তার পাশে আলেয়া

উত্তরের বৃহত্তম স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে প্রায় অজ্ঞাত পরিচয়ে অনেক রোগী আসেন। মুমূর্ষু অবস্থায় কাউকে ফেলে রাখা হয় বারান্দায় কিংবা মেঝেতে। চিকিৎসা দূরের কথা, কেউ তাদের খোঁজও নেয় না। ওইসব রোগী হাসপাতালের এক কোণে পড়ে থাকে অযতœ-অবহেলায়। মলমূত্রের মধ্যে মাছি ভিন ভিন করে তারও শরীরে। পাশ দিয়ে কেউ গেলে নাকে রুমাল গুঁজেন। তাকিয়েও দেখে না কেউ। তবে একজন আছেন, তিনি খবর পেলেই এসব রোগীর পাশে ছুটে যান। তার নাম আলেয়া। গত ১৩ বছর ধরে এমনই মানবিক কাজ করে চলেছেন তিনি। এই আলেয়ার সেবায় সুস্থ হয়ে ওঠেন অযতেœ পড়ে থাকা রোগীরা। আলেয়া নিজ হাতে তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। এদের অনেকেই সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যায়। তাতেই আলেয়ার সুখ। দীর্ঘদিন ধরে দৈনিক মজুরিভিত্তিক শ্রমিক হিসেবে রামেক হাসপাতালে কাজ করে আসছেন আলেয়া বেগম। অল্প বেতনে কাজ করে মানুষের পাশে দাঁড়ানোটাই তার কাছে সুখের। এ পর্যন্ত ১৫০ জনের বেশি অজ্ঞাত রোগীকে সেবা করে সুন্থ করেছেন আলেয়া। এতদিনের কাজে কেউ তার পাশে দাঁড়ায়নি, এমনকি সাহস যোগায়নি। এমনকি নিজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও না। অবশ্য তাতে কোন কষ্ট নেই আলেয়ার। নীরবেই এ কাজ তিনি করে যাচ্ছেন ১৩ বছর ধরে। তবে এতদিন পরে নীরব মানব সেবায় জ¦লে থাকা তারাটিকে ঠিকই চিনতে পেরেছে স্কয়ার গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান রাঁধুনী। এবারের নারী দিবসে তাই রাঁধুনী কীর্তিমতী হিতৈষী নারীর সম্মাননা পেয়েছেন আলেয়া। গত শনিবার নারী দিবসে সম্মাননা তুলে দেওয়া হয় তার হাতে। প্রায় ১৩ বছরে দেড় শতাধিক মানুষকে সেবা দিয়েছেন অসহায় এই নারী। তাকে দেয়া হয় কীর্তিময়ী হিতৈষী সম্মাননা। অনুষ্ঠানে যখন তার সম্পর্কে বলা হচ্ছিল, তখন অনুষ্ঠানস্থলে নেমে আসে পিনপতন নীরবতা। পুরস্কার নেয়ার পর বক্তৃতায় তিনি নিজেও হন আবেগ আপ্লুত। রাজধানীর প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আলেয়া বেগমকে সম্মাননা হিসেবে ক্রেস্ট ও টাকার চেক (এক লাখ টাকা) তুলে দেওয়া হয়। পুরস্কার পাওয়া অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন তিনি। এমন নারীকে সম্মাননা দিয়ে উপস্থিত অতিথিরাও দাঁড়িয়ে হাততালি দেন, তাকে সম্মান জানান। সেখান থেকে ফিরে এসে আলেয়া বেগম জানান, এ সম্মাননা তার কাছে অনেক বড়। এতে তার কাজের স্পৃহা আরও বাড়বে। মানবসেবায় নিজ পরিসর থেকেই আরও মনোযোগী হবেন। আলেয়া জানান, রামেক হাসপাতালে এই অস্থায়ী চাকরি নেয়ার পর বিগত বছরগুলোতে তিনি ১৫০ জনেরও বেশি অজ্ঞাত রোগীকে সেবা দিয়ে সুস্থ করে তাদের পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছেন। অনেক সময়ই হাসপাতালে চিকিৎসার পাশাপাশি বাইরে থেকে কোন ওষুধ প্রয়োজন হলে অন্যান্য রোগীর স্বজনদের কাছ থেকে ১০-২০ টাকা করে তুলে তা দিয়ে ওষুধ কেনার ব্যবস্থা করেন। কখনও কখনও নিজের বেতনের টাকাও অজ্ঞাত ওই সব রোগীর পেছনে খরচ হয়। তবে স্বজনের কাছে ওদের তুলে দেয়ার সময়ও সে সব খরচের বিষয়টি নিয়ে তিনি কখনও কথা বলেন না। পুরো বিষয়টি তিনি নিঃস্বার্থ সেবা হিসেবেই নিয়েছেন। আলেয়া খাতুনের বাড়ি সিরাজগঞ্জ সদরের খাজা গ্রামে। হতদরিদ্র পরিবারের মেয়ে আলেয়ার সঙ্গে স্বামীর বনিবনা না হওয়ায় বিয়ের বছর কয়েক পরই ২০০৩ সালে রাজশাহী শহরে চলে আসেন তিনি। সঙ্গে নিয়ে আসা একমাত্র মেয়ে টুম্পাকে নিয়ে নগরীর হেতেম খাঁ এলাকায় বস্তির ভেতরে বাড়ি ভাড়া নিয়ে প্রথম দিকে পুরনো বই বাঁধাইয়ের কাজ করে সংসার চালাতেন। হাসপাতালের ডেইলি লেবার হিসেবে শ্রমিক সরবরাহকারী ঠিকাদারের মাধ্যমে আয়ার কাজ পান আলেয়া। এরপর থেকে মাসে এক হাজার ৫০০ টাকা বেতনে ওই চাকরির পাশাপাশি অজ্ঞাত রোগীদের সেবা-যতœ করে চলেছেন তিনি। আলেয়ার আক্ষেপ, পাঁচ বছর ধরে ঠিকাদারের মাধ্যমে অস্থায়ী ভিত্তিতে চাকরি করে আজও তিনি স্থায়ীভাবে নিয়োগ পাননি। ঠিকাদারের মাধ্যমে ডেইলি লেবার হিসেবে আয়ার চাকরি করায় কখনও কখনও ঠিকাদার তাকে বাদ দিয়েও দেন। আবার চিকিৎসকদের তদবিরের কারণে তাকে ফিরিয়ে আনা হয় হাসপাতালে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হাসপাতালে নাম পরিচয়হীন কঙ্কালসার রোগীদের ধীরে ধীরে সুস্থ করাই আলেয়ার কাজ। রোগীদের কারও পা ভাঙা, আবার কারও মেরুদ- ভাঙা। দীর্ঘদিন বিছানায় শুয়ে থেকে কারও বেড শুল (পিঠে ঘা) হয়ে গেছে। এত কিছুর পরেও সেবা দিয়ে রোগীগুলোকে বাঁচানোর চেষ্টা করেন আলেয়া। প্রতিদিন তিন বেলা ভাত খাওয়ানো। নিয়মিত গোসল করানোসহ সময়মতো পাশ ফিরিয়ে শোয়ানো সবকিছু সময়মতো আলেয়া করে থাকেন। আলেয়া জানান, তিনি অনেককে সুস্থ করে পরিবারের কাছে তুলে দিতে পেরেছেন। দীর্ঘ সেবার পর কাউকে সুস্থ করে যখন পরিবারের কাছে তুলে দিতে পারি তখন নিজের ভেতরে এক অন্য ধরনের আনন্দের অনুভূতি জাগে। আর এই আনন্দের অনুভূতি খুঁজতেই আমি বার বার এসব অজ্ঞাত রোগীর সেবা করি। তার এ কাজ অব্যাহত থাকবে বলে জানান আলেয়া বেগম। -মামুন-অর-রশিদ, রাজশাহী থেকে
×