টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলার অজপাড়াগ্রামের নাম সাহাপুর। শিক্ষায় নারী জাগরণের ছোট্ট এ গ্রামটি এখন দেশের রোলমডেল। ১৯৪৭ সালের দিকে হিন্দু সম্প্রদায়ের সাহারা এ গ্রাম থেকে ভারতে পাড়ি জমালেও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাদীক্ষা সযতেœ লালন করে চলছে গ্রামবাসী।
উপজেলা শহর থেকে ছয় মাইল দূরে নিভৃত সাহাপুর গ্রামের প্রায় সবাই নি¤œমধ্যবিত্ত। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বিশ^বিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষকতার মহান পেশায় নিয়োজিত আছেন প্রায় জনা পঞ্চাশেক। আর এসব শিক্ষকই মূলত নারী শিক্ষার নেপথ্যে বিপ্লব ঘটিয়েছেন। মাত্র একজন ছেলে উচ্চশিক্ষায় বর্তমানে পড়াশোনা করলেও এই গ্রামের ৬জন মেয়ে মেডিক্যালে এবং ১১ জন মেয়ে দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চ শিক্ষায় পড়াশোনা করছেন।
এ গ্রামের সন্তান ছাকিবুন্নাহার বন্যা ময়মনসিংহ ত্রিশাল জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক। এ বিশ^বিদ্যালয় থেকেই তিনি প্রথম শ্রেণীতে প্রথমস্থান অধিকার করে রাষ্ট্রপতি স্বর্ণপদক পান। গ্রামের নিলুফার ইয়াসমিন ময়মনসিংহ মেডিক্যালে, মাহমিনা হোসেন মীম ঢাকা মেডিক্যালে, দারিদ্র্য কষাঘাতে জর্জরিত সুচিত্রা ধর রাজশাহী মেডিক্যালে, খুলনা বেসরকারী মেডিক্যালে সুরাইয়া সুলতানা প্রমি, রংপুর মেডিক্যালে আঁখি আখতার। ঢাকার একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা নিয়ে চীনে পিএইচডি করছেন জান্নাতুল নাহার লিজা। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন আমিনা তালুকদার রিতু। নিশাত তালুকদার এবং হোসনে আরা রিংকু ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে, তানিয়া ইয়াসমীন তনু, জান্নাতুল মাওয়া, কামরুন্নাহার পাপড়ী এবং সেতু তালুকদারসহ এক ডজন মেয়ে জাহাঙ্গীরনগর, খুলনা ও বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন। আর এই গ্রামের একমাত্র ছেলে শিক্ষার্থী মাহমুদুল হাসান তালুকদার পড়াশোনা করেন ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজে। এছাড়া গ্রামের দু’জন মেয়ে বাংলাদেশ পুলিশে, ১২জন নার্সিংয়ে এবং ১০ জন মেয়ে স্বাস্থ্য বিভাগসহ দেশের বিভিন্ন সরকারী প্রতিষ্ঠানে চাকরিরত। বর্তমানে এই গ্রামে শিক্ষার হার শতভাগ। অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক লুৎফর রহমান মনির বলেন, সুষ্ঠু শিক্ষাব্যবস্থার জন্য উনবিংশ শতাব্দীতে সাহাপুর গ্রামে সাহারা টোল প্রতিষ্ঠা করেন। টোলে শিক্ষকতা করতেন মা রোকেয়া খাতুন। বিনা বেতনে তিনি দীর্ঘদিন গ্রামে শিক্ষার আলো ছড়ান। সেখান থেকেই এ গ্রামে নারী শিক্ষার পথযাত্রা। সকলের অনুসরণীয় ছিলেন এ গ্রামের প্রথম স্কুল শিক্ষক আব্দুর রহিম। পরবর্তীতে রহিম স্যারকেই অনুসরণ করে সাহাপুর গ্রাম কালক্রমে পরিণত হয় শিক্ষকের গ্রামে। বর্তমানে এই গ্রামের ৪৯ জন শিক্ষকতায় নিয়োজিত রয়েছেন। ষাটের দশকে সাহাপুর প্রাইমারী স্কুলটি সরকারীকরণ করা হয়। গ্রামের এই প্রাইমারী স্কুল থেকেই হাতেখড়ি নিয়ে মেয়েরা উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছেন।
প্রবীণ স্কুল শিক্ষক আব্দুল সাত্তার জানান, তুলনামূলকভাবে ছেলে সন্তানদের বাড়তি আগ্রহ ব্যবসা বাণিজ্য, বিদেশ গমন, ঘর গৃহস্থালি এবং রাজনীতির প্রতি। গৃহিণীরা মেয়ে সন্তানদের যতটা সহজে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন, ছেলেদের ক্ষেত্রে ততটা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না। এজন্যই গ্রামে ছেলে এবং মেয়েদের মধ্যে শিক্ষায় বৈষম্য। স্কুল শিক্ষক এমএ মাসুদ বলেন, শিক্ষায় বর্তমানে গ্রামের ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের সংখ্যাই তুলনামূলকভাবে বেশি। সাহাপুর গ্রামে প্রাচীনকাল থেকেই নারী শিক্ষার বাড়তি পরিবেশ গড়ে উঠেছে এবং অভিভাবক সচেতনতার জন্য এখানে নারীদের শিক্ষা ও সচেতনতায় জয়জয়কার।
এ বিষয়ে গোপালপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার বিকাশ বিশ^াস জানান, ইউনিয়ন পর্যায়ের একটি গ্রামাঞ্চলে ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা শিক্ষায় অগ্রগামী খবরটি অনেক উৎসাহব্যঞ্জক এবং অনুপ্রেরণাদায়ক। সারাদেশের জন্য নারী শিক্ষায় সাফল্য লাভের দিকটি বিবেচনায় সাহাপুর গ্রামটি এখন রোল মডেল হিসেবে পরিচিত।
-ইফতেখারুল অনুপম,
টাঙ্গাইল থেকে
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: