ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

৫১ ব্যক্তির তালিকা ছয় বছর লালফিতায় বন্দী

বাতিল হয়নি ৪৩৮ রোহিঙ্গার এনআইডি

প্রকাশিত: ০৯:০৮, ১৪ মার্চ ২০২০

বাতিল হয়নি ৪৩৮ রোহিঙ্গার এনআইডি

এইচএম এরশাদ, কক্সবাজার ॥ কক্সবাজার ও চট্টগ্রামে বসবাসকারী পুরনো রোহিঙ্গা নেতা ছলাহুল, ইব্রাহিম আতিক, ইদ্রিস, আয়াছ, ছালামত, ব্যবসায়ী নুর কামাল, শেখ সাদী ও হাসিমসহ ৪৩৮ আরাকান বিদ্রোহী ক্যাডারের জাতীয় পরিচয়পত্র বাতিল হয়নি ছয় বছরেও। এদের জঙ্গীপনাসহ বিভিন্ন কাজকর্মে সহযোগিতাকারী স্থানীয় কতিপয় জনপ্রতিনিধিসহ রোহিঙ্গাবান্ধব ৫১ ধান্ধাবাজ ব্যক্তির বিরুদ্ধেও কোন আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। ফলে এদেশের নাগরিক দাবিদার ওইসব রোহিঙ্গা নেতা প্রত্যাবাসনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিসহ আশ্রিত রোহিঙ্গাদের নাটেরগুরু হিসেবে কাজ করছে। সন্ত্রাসী রোহিঙ্গাদের অবৈধ অস্ত্রের যোগান দিচ্ছে। সূত্রে জানা যায়, রোহিঙ্গাদের ভোটার ও জাতীয় পরিচয়পত্র পাইয়ে দেয়ার পেছনে সহযোগিতা ও তদ্বিরকারী রোহিঙ্গাবান্ধব ওই ৫১ ব্যক্তির বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে ইতোপূর্বে উচ্চমহল থেকে নির্দেশনা ২০১৪ সালে সংশ্লিষ্ট দফতরে পৌঁছানো হয়েছিল। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে কক্সবাজারে প্রেরিত ৫১ ব্যক্তির তালিকাটি বর্তমানে লালফিতায় ফাইলবন্দী হয়ে রয়েছে। এদের বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি দেখে ওই রোহিঙ্গা জঙ্গীরা জাতীয় পরিচয়পত্র বহন করে নিজেদের স্থানীয় বাসিন্দা বলে দাবি করে চলছে। ইতোপূর্বে জেএমবির সঙ্গে যুক্ত হয়ে বিভিন্ন স্থানে নাশকতা, ডাকাতি, অপহরণ, সড়কে গাছের গুঁড়ি ফেলে প্রতিবন্ধকতা ও হত্যাকা- ঘটিয়েছে ওই ক্যাডাররা। রোহিঙ্গা সমস্যাকে জিইয়ে রাখতে আরএসও ক্যাডার ও আন্তর্জাতিক কয়েকটি সাহায্য সংস্থার (এনজিও) উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। সরকারের সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ওসব পুরনো রোহিঙ্গা নেতা এবং এনজিও কর্মকর্তাদের অপতৎপরতার কারণে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সহজতর করা সম্ভব হচ্ছে না বলে জানা গেছে। অভিযোগ রয়েছে, রোহিঙ্গাবান্ধব ৫১ ব্যক্তি এবং ৪৩৮ রোহিঙ্গা বিদ্রোহীর বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় ভাবিয়ে তুলেছে ওয়াকিবহাল মহলকে। তাই শীঘ্রই তাদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনার দাবি উঠেছে বিভিন্ন মহল থেকে। সরকারী সম্পদ বনভূমি দখল ও পরিবেশ প্রতিবেশ ধ্বংস করে লিংকরোড মুহুরিপাড়া, (সরকারী কলেজের পেছনে) জঙ্গী ছলাহুল বন বিভাগের ৭ একর, রামু খুনিয়াপালং এলাকায় মৌলবি আয়াছ ৩ একর জায়গায় নির্বিঘেœ একাধিক স্থাপনা গড়ে তোলার পেছনে ওই ৫১ ব্যক্তির সহযোগিতা থাকার তথ্য পেয়েছিল গোয়েন্দা সংস্থা। সংশ্লিষ্ট দফতরে কতিপয় অসৎ কর্মকর্তাকে মোটা অঙ্কের ঘুষ দিয়ে বনজসম্পদ দখল করে ওসব জায়গায় শিক্ষার নামে রোহিঙ্গা একতা সৃষ্টির লক্ষ্যে আরএসও’র অর্থায়নে গড়ে তোলা হয়েছে একাধিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। বন বিভাগের রেঞ্জ ও বিট কর্মকর্তারা জানান, এগুলো অন্তত কয়েক বছর আগের স্থাপনা। এসব উচ্ছেদ করতে হলে ম্যাজিস্ট্রেট-পুলিশ লাগবে। রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও) প্রধান মাস্টার আইয়ুবের সেকেন্ড ইন কমান্ড মৌলবি কামাল হোছাইন নিজেকে পার্বত্য নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম কচুবনিয়ার বাসিন্দা ও বাংলাদেশী নাগরিক দাবি করছে। অঢেল টাকা খরচ করে বাংলাদেশী পরিচয়পত্র (আইডিকার্ড) বানিয়েছেন তিনি। অথচ কামাল মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য বুচিদং এলাকার মৃত আবুল কাশেমের পুত্র। দেশের বিভিন্ন জায়গায় ওই কামালের নামে একাধিক ব্যাংক একাউন্টও রয়েছে। কামাল মিয়ানমারের নাগরিক হলেও বাংলাদেশী নাগরিক বলে দাবি করে মাদ্রাসায় পাঠদানের নামে চালিয়ে যাচ্ছে নিয়মিত প্রশিক্ষণ। তিনি মানবপাচারকারী ও অবৈধ হুন্ডি ব্যবসায়ী হিসেবেও চিহ্নিত। সূত্র জানায়, মৌলবি কামাল চরম জালিয়াতির মাধ্যমে নিজের সেই রোহিঙ্গা পরিচয় গোপন করে বাংলাদেশী আইডি কার্ড বানালেও মুছতে পারেনি তার আসল পরিচয়। তিনি উখিয়ার কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্পের তালিকা অনুযায়ী মিয়ানমারের নাগরিক। ক্যাম্পে তার রেজিস্ট্রেশন নং-এমআরসি নং-৪৮৪৫৩। ওই ক্যাম্পেই তার স্ত্রীসহ পুরো পরিবারের বসবাস আছে। সরকারী-এনজিও প্রদত্ত রসদও হাতিয়ে নিচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, মৌলবি কামাল হোছাইন অস্ত্রের প্রশিক্ষক মাস্টার আইয়ুবের অন্যতম প্রাণশক্তি। এদিকে কক্সবাজারে বিভিন্ন স্থানে ঘাপটি মেরে থাকা আরএসও ক্যাডার অনেকে ছদ্মবেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা, ইমাম, শিক্ষার্থী এবং বিভিন্ন এনজিওতে কর্মচারী হিসেবে চাকরি করছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলার বিভিন্ন স্থানে বেসরকারী কেজি স্কুল, সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, অর্ধশতাধিক মাদ্রাসা, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, বেসরকারী কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিচয় গোপন করে নিয়মিত পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছে রোহিঙ্গা বংশোদ্ভূত যুবকরা। বিদেশী এনজিও সংস্থার মদদ ও আর্থিক সহায়তায় কতিপয় লোভী শিক্ষকের কারণে কৌশলে ঐসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ওরা অনায়াসে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। পরে এসএসসি, এইচএসসি পাস করে রোহিঙ্গারা নির্বিঘেœ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পৌঁছে যাচ্ছে। ওরা নিজেদের বাংলাদেশী দাবি করে পরীক্ষা পাসের সনদ দেখিয়ে জাতীয় সনদও হাতিয়ে নিয়েছে। স্থানীয়দের মেয়ে বিয়ে করে শক্তি সঞ্চার করেছে রোহিঙ্গা শিক্ষার্থীরা। মিয়ানমারে নিপীড়িত মুসলিম হিসেবে সহানুভূতি দেখিয়ে মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্থান দেয়া হলেও ওসব রোহিঙ্গা শিক্ষার্থী একদিন এ দেশের জন্য বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন এলাকার শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিবর্গ। রোহিঙ্গা শিক্ষার্থী উচ্চতর ডিগ্রী নিয়ে কোনভাবে দেশের বিভিন্ন দফতরে নিয়োগ পেলে আগামীতে হুমকির সম্মুখীনসহ বেকায়দায় পড়তে হবে জাতিকে। বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিকাংশ বিভাগে যেসব রোহিঙ্গা শিক্ষার্থী ভর্তি রয়েছে, তারা ক্যাম্পের বাইরে বসতি গেড়েছে। বান্দরবান, কক্সবাজার ও চট্টগ্রামে জায়গা-জমি কিনে ঘর-বাড়ি নির্মাণ করে এরা কোটি টাকার মালিক বনে গেছে। ইতোপূর্বে জমি-জমার খতিয়ান দেখিয়ে ওরা জাতীয় সনদ হাতিয়ে নিয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন শিক্ষক জানান, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রোহিঙ্গা শিক্ষার্থীদের ভর্তি হওয়াটা অসম্ভব কিছু না। কেননা তারা ভর্তি হওয়ার সময় বাংলাদেশী নাগরিক হিসেবে সনদ প্রদান করছে। সঙ্গে সুপারিশ থাকছে রাজনৈতিক নেতার। প্রাইমারি লেভেল থেকে ওরা পড়ালেখা শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত কিভাবে এসেছে? এটাই প্রশ্ন। মিয়ানমার সীমান্ত থেকে নির্দ্বিধায় কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম পর্যন্ত পৌঁছাতে তাদের সহযোগিতা করেছে কারা? ওসব দালালদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া দরকার বলে সচেতন মহলের দাবি।
×