ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

৭ হাজার ঘর পুড়ে ছাই

রূপনগরের শিয়ালবাড়ি বস্তিতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড

প্রকাশিত: ১১:২৯, ১২ মার্চ ২০২০

রূপনগরের শিয়ালবাড়ি বস্তিতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ঢাকার রূপনগরের শিয়ালবাড়ি বস্তিতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে অন্তত সাত হাজার ঘর পুড়ে গেছে। এতে গ্ৃহহীন হয়ে পড়েছেন প্রায় ত্রিশ হাজার বস্তিবাসী। তবে কোন হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। নিকট অতীতে এতবড় অগ্নিকা-ের ঘটনা আর ঘটেনি। পুরো এলাকার এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে আগুনের হাত থেকে বাঁচানো জিনিসপত্র। সব হারানো বস্তিবাসীর আহাজারিতে পুরো এলাকায় হৃদয়বিদারক পরিবেশ বিরাজ করছে। ফায়ার সার্ভিসের সাতাশটি ইউনিট তিন ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। অগ্নিকা-ের কারণ জানতে পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে ফায়ার সার্ভিস সদর দফতর। তদন্ত কমিটিতে দ্রুততার সঙ্গে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে। বিকেলে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম। বুধবার সকাল প্রায় সাড়ে নয়টার দিকে আগুনের সূত্রপাত হয়। বস্তিতে ইউনিসেফের অর্থায়নে পরিচালিত সুরভী নামের একটি এনজিও পরিচালিত স্কুলের শিক্ষিকা আনিকা আক্তার (২৪) আগুন লাগার ঘটনার বর্ণনা দিলেন। জনকণ্ঠের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলছিলেন, বস্তিটির উত্তর দিকের রাস্তার কাছেই সুরভি এনজিওর পরিচালিত স্কুলটির অবস্থান। প্রতিদিনের মতো আমি স্কুলে পড়াচ্ছিলাম। তখন সকাল সাড়ে নয়টার মতো বাজে। আচমকা বস্তির ভেতর দিক থেকে আগুন আগুন বলে চিৎকার ভেসে আসতে থাকে। আমি দ্রুত শিশুদের নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেই। এরপর রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম, আগুন বস্তির উত্তর দিকের ঠিক মাঝ বরাবর রজনীগন্ধা মার্কেটের পূর্বদিক থেকে জ্বলছে। বস্তির মাঝ বরাবর আগুন লাগায় মুহূর্তেই তা চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। মাত্র আধঘণ্টার ব্যবধানে আগুন প্রায় পুরো বস্তির অর্ধেক ধরে যায়। আর সকাল সাড়ে দশটার দিকে পুরো বস্তিতে আগুন লেগে যায়। এ সময় বস্তিবাসীর চিৎকারে পুরো এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। হাজার হাজার বস্তিবাসী নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে ছুটতে থাকেন। প্রথমেই বস্তিবাসীরা শিশু সন্তানদের নিয়ে বের হন। এরপর সুযোগমতো কেউ কেউ ঘরের আসবাবপত্র বের করতে পারেন। তবে অধিকাংশ বস্তিবাসীই কোন ধরনের আসবাবপত্র বের করতে পারেননি। কোনমতে শুধু জীবন নিয়ে নিরাপদ জায়গায় যেতে সক্ষম হয়েছেন। সব হারিয়ে নিস্ব শিয়ালবাড়ি বস্তির বাসিন্দা আব্দুল জলিল (৫৫) রূপনগরের ১২ নম্বর সড়কে ফুটপাথে বসে কাঁদছিলেন। কাছে গিয়ে জানতে চাইতেই, একেবারে কেঁদে একাকার। বলছিলেন, আমার সব পুড়ে গেছে। কিছুই আর বাকি নেই। বাড়ি যাওয়ার ভাড়া পর্যন্ত নেই। বাড়ি নেত্রকোনা জেলার আটপাড়া থানাধীন বাওশা গ্রামে। গত পাঁচ বছর ধরে বস্তিটিতে বসবাস করছি। কাঁদছিলেন আর বলছিলেন, স্ত্রী আর চার সন্তান নিরাপদে ঘর থেকে বের হতে পেরেছে বলে প্রতিবেশীর কাছে শুনেছি। তবে বেলা একটা পর্যন্ত তাদের সঙ্গে তার দেখা হয়নি। বিকেলে মোবাইল ফোনে জানা গেছে, তার সঙ্গে পবিরারের সদস্যদের সাক্ষাত হয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষ জানায়, খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফায়ার সার্ভিসের প্রথমে ১১টি ইউনিট ঘটনাস্থলে হাজির হয়। তারা আগুন নেভাতে হিমশিম খাচ্ছিল। এজন্য পরে আরও ১৬টি ইউনিট পাঠানো হয়। সবমিলিয়ে ২৭টি ইউনিট টানা তিন ঘণ্টারও বেশি সময়ের চেষ্টায় ভয়াবহ আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স সদর দফতরের ডিউটি অফিসার এরশাদ হুসাইন জনকণ্ঠকে জানান, আগুনে কোন হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। তবে তাদের দুইজন কর্মী সামান্য অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তাদের রূপনগরের স্থানীয় হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়। তারা বর্তমানে সুস্থ। তিনি আরও জানান, বিকেল সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত ড্যাম্পিংয়ের কাজ করা হয়। যাতে বস্তির আর কোন জায়গা থেকে আবার আগুন ধরতে না পারে, এজন্য পানি দেয়া হয়। ঘটনা তদন্তে ফায়ার সার্ভিসের তরফ থেকে পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির প্রধান করা হয়েছে, ফায়ার সার্ভিসের এ্যাম্বুলেন্স শাখার উপ-পরিচালক নূর হাসানকে। কমিটির অন্য সদস্য হচ্ছেন, সহকারী পরিচালক নঈমুল হাসান ভূঁইয়া, উপসহকারী পরিচালক আনোয়ার হোসেন, মিরপুর ফায়ার স্টেশনের সিনিয়র স্টেশন মাস্টার মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন ও ওয়্যার হাউস পরিদর্শক গোলাম মোস্তফা। কমিটিতে দ্রুততার সঙ্গে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে বলেছেন ফায়ার সার্ভিসের উর্ধতন কর্মকর্তারা। সরেজমিনে দেখা গেছে, রূপনগরের প্রায় শেষ মাথায় রজনীগন্ধা মার্কেটের কাছে রাখা ফায়ার সার্ভিসের অগ্নিনির্বাপণ গাড়ির দরজা জানালার কাঁচ ভাঙ্গা। গাড়িটি তখনও সচল ছিল। গাড়ি থেকে পাইপের মাধ্যমে পানি নিয়ে বস্তিতে দেয়া হচ্ছিল। সেখানকার অধিকাংশ স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, আগুন নেভাতে আসতে ফায়ার সার্ভিসের দেরি হওয়ার অভিযোগে উত্তেজিত কিছু স্থানীয় জনতা ও বস্তিবাসী গাড়িটিতে ভাংচুর করেছে। তারা বলছিলেন, যতটুকু দেরি হয়েছে, তা রাস্তার যানজটের কারণে। কারণ আগুন লাগার পর উৎসুক জনতার কারণে রাস্তায় যানজট লেগেছিল। এজন্য স্বাভাবিক কারণেই বিশাল গাড়িগুলোকে ঘটনাস্থলে যেতে ব্যাপক হিমশিম খেতে হয়েছে। এছাড়ার বস্তির কাছে যাওয়ার রাস্তাগুলো সরু হওয়ার কারণে ফায়ার সার্ভিসের বড় বড় গাড়িগুলো বস্তির কাছাকাছি যেতে পারেনি। অনেক দূরে বড় বড় গাড়ি রেখে পাইপ দিয়ে বস্তিতে পানি দিতে হয়েছে। এজন্য আগুন নেভাতে অনেক বেগ পেতে হয়েছে। বিশেষ করে বড় রাস্তায় গাড়ি রাখতে হয়েছে ফায়ার সার্ভিসকে। সেখান থেকে বস্তির মাঝ বরাবর পর্যন্ত প্রায় কোয়ার্টার কিলোমিটার দূরত্ব। ফলে স্বাভাবিক কারণেই আগুন নেভাতে মারাত্মক বেগ পেতে হয়েছে ফায়ার সার্ভিসকে। আর পাইপের সঙ্গে অনেকগুলো পাইপ জোড়া লাগাতে হয়েছে। বস্তিবাসী ও স্থানীয় উত্তেজিত লোকজনদের অনেক অনুরোধ করার পরেও তারা একটি গাড়ির দরজা জানালা কাঁচ ভেঙ্গে দিয়েছে। জানা গেছে, জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের অন্তত বিশ বিঘা জমির ওপর বস্তিটি গড়ে উঠেছে। তাতে অন্তত দশ হাজার ঘর রয়েছে। বাঁশ কাঠ আর টিন দিয়ে ঘরগুলো তৈরি। আগুন বস্তিটির মাঝ বরাবর লেগে পুরো বস্তিতে ছড়িয়ে পড়ে। বস্তির আগুন এতটাই ভয়াবহ ছিল যে, আশপাশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তাৎক্ষণিকভাবে বন্ধ করে দেয়া হয়। বস্তি লাগোয়া বাড়ির বাসিন্দারা ভয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যান। আশপাশে থাকা দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। শিয়ালবাড়ি মোড় থেকে রূপনগরের রজনীগন্ধা মোড় পর্যন্ত যানবাহন চলাচল বন্ধ রেখেছিল পুলিশ। পুলিশকে সহায়তা করে আশপাশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। বিশেষ করে রোভার স্কাউটরা ফায়ার সার্ভিসকে আগুন নেভাতে সহায়তা করেন। সেখানে অবস্থিত ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস টেকনোলজির শিক্ষার্থীরা আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ, বস্তিবাসীদের এবং স্থানীয় জনগণকে সহায়তা করার পাশাপাশি নিজেরাও আগুন নেভানোর কাজ করেন। এদিকে ভয়াবহ অগ্নিকা-ের কারণে আশপাশের অধিকাংশ বাড়ির বাসিন্দারা ও মালিকরা বাড়ির নিচতলা খুলে দিয়েছেন। আশপাশের প্রতিটি বাড়ির নিচে বস্তিবাসীদের অধিকাংশই আশ্রয় নিয়েছেন। অনেকেই বস্তি থেকে উদ্ধার করা মালামাল রেখেছেন। বিকেল তিনটার পর থেকেই বাড়িগুলোর নিচে রাখা মালামাল সরিয়ে নিতে দেখা যায় বস্তিবাসীদের। বস্তিটির আশপাশে এমন কোন জায়গা নেই, সেখানে গৃহহীন বস্তিবাসীদের দেখা যায়নি। রাস্তার ওপর, রাস্তার পাশে, ফুটপাথ থেকে শুরু করে যেখানেই খালি জায়গা পেয়েছে, সেখানেই গৃহহীনরা আশ্রয় নিয়েছেন। এদিকে বস্তিটির পাশে একটি ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন করেছিলেন স্থানীয়রা। ওয়াজ মাহফিলে গরুর গোস্ত দিয়ে খিচুড়ি রান্না করে খাওয়ানোর কথা ছিল। এজন্য গরুও আনা হয়েছিল। গরুটি রাস্তার ওপরেই জবাই করা হয়েছে। সেই গরুর গোস্ত দিয়ে খিচুড়ি রান্না করে গৃহহীন বস্তিবাসীদের মধ্যে বিতরণ করা হবে বলে বলছিলেন স্থানীয় মুরুব্বি আওলাদ হোসেন। তিনি বলছিলেন, আমরা আরও গরু এনে তার গোস্ত দিয়ে খিচুড়ি রান্না করে বস্তিবাসীদের খাবারের ব্যবস্থা করার চেষ্টা করছি। এদিকে বুধবার বিকেল চারটার দিকে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলাম। তিনি বস্তিবাসীদের সান্ত¦না দিয়ে বলেন, বার বার আগুন লাগার বিষয়ের স্থায়ী সমাধান করতে বস্তির জমির মালিকদের সঙ্গে বসা এবং পুরো জমির ম্যাপ প্রধানমন্ত্রীর কাছে উপস্থাপন করা হবে। যাতে ভবিষ্যতে আর এমন ঘটনা না ঘটে। এমন ঘটনার স্থায়ী সমাধানের চেষ্টা চলছে। গৃহহীনদের সাময়িক থাকার ও খাবারের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। অন্যদিকে সন্ধ্যা ছয়টার দিকে পুরো এলাকায় যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক হয় বলে পুলিশ জানায়। পুলিশ আশপাশের সব রাস্তার বেড়িকেড তুলে নেয়। এবারই প্রথম অগ্নিকা-ের ঘটনাস্থল থেকে চারদিকে অন্তত আধা কিলোমিটার এলাকা কর্ডন করে রেখেছিল পুলিশ ও স্বেচ্ছাসেবীরা। এতে আগুন নেভানো সহজ হয়েছে। অন্যথায় আগুন নেভাতে আরও সময় লাগতে পারত।
×