ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বস্তিতে আগুন লাগে নিয়মিতই ॥ দায় ও দায়িত্ব

প্রকাশিত: ১১:২৮, ১২ মার্চ ২০২০

বস্তিতে আগুন লাগে নিয়মিতই ॥ দায় ও দায়িত্ব

রাজন ভট্টাচার্য ॥ ফের রাজধানীর বস্তিতে ঘটল অগ্নিকা-ের ঘটনা। প্রায় নিয়মিতই বস্তিতে আগুন লাগার ঘটনা দেশী ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের ‘খবর’ হয়ে সামনে আসে। সাম্প্রতিক সময়ে এর ভয়াবহতা বেড়েছে। যেমন বাড়ছে বস্তিবাসীর সংখ্যা। তেমনি বাড়ছে দুর্ঘটনার মাত্রাও। গত কয়েক বছরে বস্তির আগুনে সাধারণ মানুষ সর্বস্বান্ত হওয়ার পাশাপাশি আছে হতাহতের ঘটনা। এই প্রেক্ষাপটে বিশাল এই জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সবচেয়ে বড় কথা হলো ঢাকাকে একটি উন্নত ও আধুনিক নগরী হিসেবে গড়ে তোলার মহাপরিকল্পনা নিয়ে কাজ চলছে। বাস্তবায়ন হচ্ছে একের পর এক প্রকল্প। অন্যদিকে বাড়ছে বস্তি। শহরের আনাচে-কানাচে থাকা এসব বস্তি ও সেখানে বসবাসরত মানুষের জীবনমান উন্নয়নে অগ্রগতি বলার মতো কিছু নেই। কিছু বস্তি এলাকায় ভবন নির্মাণের জন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সাইনবোর্ড ঝুলছে দীর্ঘ সময়। বস্তির মানুষের জীবনমান উন্নয়নে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীন সিটি কর্পোরেশন রয়েছে। দুই সিটিতে রয়েছে আলাদা বস্তি উন্নয়ন বিভাগও। তাছাড়া গত প্রায় ২০ বছর ধরে নগরীর বস্তি উন্নয়ন নিয়ে নানা পরিকল্পনা বা আলোচনার কথা শোনা যায়। এমনকি জীবনমান উন্নয়নে ফ্ল্যাট দেয়ার কথাও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। কিন্তু আদৌ কি বস্তিবাসীর জীবনমানে দৃশ্যমান কোন পরিবর্তন এসেছে? কিন্তু উন্নত নগরী গড়ে তোলায় প্রতিযোগিতায় যখন ঢাকা শহরকে নিয়ে কাজ চলছে, তখন বস্তিবাসীকে বাদ দিয়ে তা কখনই পরিপূর্ণ হবে না। তাই বস্তির মানুষের জীবনমান উন্নয়নে দ্রুত কাজ শুরুর তাগিদ দিয়েছেন নগরবিদরা। তারা বলছেন, সাধারণত নি¤œ আয়ের মানুষ বেঁচে থাকার সংগ্রামে ঢাকার বিভিন্ন বস্তিতে আশ্রয় নিয়েছেন। তাদের একটি বড় অংশ সিটির নাগরিক। তাই বিশাল এই জনগোষ্ঠীকে উন্নয়নের মূল উন্নয়ন পরিকল্পনায় আনতে হবে। আনলেই হবে না, তাদের ঘিরে প্রকল্পগুলো আলোর দিকে নিয়ে যেতে হবে। অন্যথায় পিছিয়ে পড়া এই জনগোষ্ঠী এক সময় বড় মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। তাছাড়া একদিকে উন্নয়নের সাজে সাজবে ঢাকা। বস্তি বস্তির মতোই রয়ে যাবে। তাহলে সেটি হবে আলো নিচে অন্ধকারের মতো ঘটনা। তাই উন্নয়ন মহাযজ্ঞে বস্তি উঠিয়ে আধুনিক বসবাসের ব্যবস্থার বিকল্প নেই। সর্বশেষ বুধবার মিরপুরে রূপনগর আবাসিক এলাকায় ঝিলপাড় বস্তির পশ্চিম অংশে বড় ধরনের অগ্নিকা-ে পুড়ে গেছে কয়েকশ ঘর। ফায়ার সার্ভিস নিয়ন্ত্রণ কক্ষের কর্মকর্তা রাসেল শিকদার জানান, সকাল পৌনে ১০টার দিকে রূপনগরের ‘ত’ ব্লকের ওই বস্তিতে আগুনের সূত্রপাত হয়। ফায়ার সার্ভিসের ২৫টি ইউনিট পৌনে তিন ঘণ্টার চেষ্টায় নিয়ন্ত্রণে আনে। আগুনের মাত্রা বেড়ে গেলে বস্তির পাশের একটি ছয়তলা ভবনেও তা ছড়িয়ে পড়ে। ফায়ার সার্ভিস আসতে দেরি করেছে অভিযোগ তুলে তাদের একটি গাড়ি ভাঙচুর করে উত্তেজিত জনতা। এ এলাকার সাবেক কাউন্সিলর হাজী রজ্জব হোসেন জানান, বস্তির ওই অংশে হাজারের বেশি ঘর আছে। এর মধ্যে অন্তত দুই শতাধিক ঘর পুড়ে গেছে বলে তারা ধারণা করছেন। তিনি বলেন, রজনীগন্ধা মার্কেট থেকে ওই বস্তির দূরত্ব সিকি কিলোমিটারের মতো। এ কারণে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি সেখান দিয়েই ঢোকার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু মানুষের ভিড়ের কারণে রাস্তা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় গাড়ি ঢুকতে বিলম্ব হয়েছে। তাতে কাজেও বিঘœ ঘটেছে। আরামবাগ পয়েন্ট দিয়ে ঢুকলে ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের কাজে সুবিধা হতো। ঘটনাস্থলে উপস্থিত ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা জানান, সংকীর্ণ গলি গিয়ে তাদের গাড়ি নিয়ে পৌঁছাতে বেগ পেতে হয়েছে। কাছাকাছি পানির উৎস না পাওয়ার কারণেও কাজে বিঘœ ঘটেছে। রূপনগর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) দীপক কুমার দাশ বলেন, আগুনে দুই শতাধিক ঘর পুড়ে গেছে। হতাহত হওয়ার ঘটনা ঘটেনি। বলেন, এই বস্তিতে মূলত রিক্সাচালক, দিনমজুর, পোশাক কারখানার কর্মীদের মতো নিম্ন আয়ের লোকেরা থাকেন। আগুন লাগার সময় তাঁদের অনেকেই কর্মস্থলে ছিলেন। আগুন লাগার কারণ তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায়নি। ক্ষয়ক্ষতির পুরো চিত্র পেতে সময় লাগবে। রাজধানীর বস্তির সংখ্যা সর্বশেষ ২০১৪ সালে বস্তি শুমারি করেছিল পরিসংখ্যান ব্যুরো। এরপর এ সংক্রান্ত আর কোন তথ্য নেই। প্রতিবছর নদী ভাঙ্গন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ অথবা শুধু কাজের খোঁজেই হাজার হাজার মানুষ ঢাকা আসছেন। এর একটি বড় অংশ বস্তিতে আশ্রয় নেন। অল্প টাকায় বাসা ভাড়া পাওয়া যায়, মূলত এরকম চিন্তা থেকেই তারা সেখানে বসবাস করেন। আবার অনেকে থাকেন একেবারেই বিনামূল্যে। ২০১৪ সালে বস্তি শুমারি অনুযায়ী ঢাকা শহরের দুই সিটি কর্পোরেশনে মোট ৩ হাজার ৩৯৪টি বস্তি রয়েছে। সেখানে মোট ঘরের সংখ্যা প্রায় এক লাখ ৭৫ হাজারের মতো। এই জরিপ অনুযায়ী সেসময় সাড়ে ৬ লাখের মতো লোক এসব বস্তিতে বসবাস করেন। পাঁচ বছর পর সেটা কত হয়েছে তা নিশ্চিত নয়। অর্ধেকের বেশি বস্তি সরকারী জমিতে তৈরি। ৬৫ শতাংশ বস্তিবাসী ভাড়া থাকেন। ২০১৪ সালের শুমারি অনুযায়ী সারা দেশে বস্তিবাসীর সংখ্যা প্রায় সাড়ে ২২ লাখ। অধ্যাপক মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম বলেন, বস্তিবাসীর সংখ্যা বাংলাদেশে ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। ১৯৯৭ সালের এর পর বস্তি শুমারি হয়েছে ২০১৪ সালে। সরকারী হিসেবেই এই সময়ের মধ্যে বস্তির সংখ্যা ছয়গুণ বেড়েছে। বাংলাদেশে কোন পরিকল্পনা যখন করা হয় তখন এই বিশাল জনসংখ্যার কথা খুব একটা মাথায় রাখা হয় না। তিনি বলছেন, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় রয়েছে কিন্তু তাদের কাজে সমন্বয়হীনতার রয়েছে। বস্তির মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণে দায়িত্ব কার, কাজগুলো কিভাবে হবে? উন্নয়ন পরিকল্পনায় এদের ধরা হয় না। তাদের সেবা নিশ্চিত করবে কে? তিনি বলছেন, বস্তিতে বিভিন্ন সেবা পেতে তারাও কিন্তু অর্থ খরচ করে। কিন্তু সেটি সরকারের খাতায় হিসাব হয় না। তিনি প্রশ্ন তুলছেন, শুমারি করার সময় বস্তির সংজ্ঞা কিভাবে নির্ধারণ করা হয়? এই সংজ্ঞার কারণে সংখ্যায় হেরফের হবে বলে তিনি মনে করেন। ২০১০ সালে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ দীর্ঘদিন কাজ করার পর ঢাকা শহরের যে বিশদ নগর পরিকল্পনা বা ড্যাপ গ্যাজেট আকারে প্রকাশ করে, তাতেও শহরের নিম্ন আয়ের মানুষ, বিশেষ করে বস্তিবাসীদের বিষয়টি উপেক্ষা করা হয়েছে। বছরের পর বছর নিম্ন আয়ের যেসব মানুষ অস্বাস্থ্যকর, ঝুঁকিপূর্ণ এবং নাগরিক সুযোগ সুবিধা বঞ্চিত অবস্থায় এসব বস্তিতে বসবাস করছেন, তারা এখন নগরজীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। সম্প্রতি জাতীয় সংসদে এক প্রশ্নের জবাবে স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাজুল ইসলাম বলেন, ঢাকা শহরে মোট ৩ হাজার ৩৯৪টি বস্তিতে ৬ লাখ ৪৬ হাজার ৭৫ জন বসবাস করছেন। মন্ত্রী বলেন, এসব বস্তিতে ৬ লাখ ৪৬ হাজার ৭৫ জন লোক বসবাস করছেন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো পরিচালিত ২০১৪ সালের জরিপ অনুযায়ী ঢাকা শহরের দুই সিটি কর্পোরেশনের বস্তিতে মোট খানা রয়েছে ১ লাখ ৭৫ হাজার ৯৩০টি। এর মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনে বস্তির সংখ্যা ১ হাজার ৬৩৯টি, মোট খানা, ১ লাখ ৩৫ হাজার ৩৮০টি ও জনসংখ্যা ৪ লাখ ৯৯ হাজার ১৯ জন। আর ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে বস্তির সংখ্যা ১ হাজার ৭৫৫টি, খানার সংখ্যা ৪০ হাজার ৫৯১টি ও জনসংখ্যা ১ লাখ ৪৭ হাজার ৫৬ জন। মন্ত্রী বলেন, বস্তিতে বসবাসকারী দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দেয়ার লক্ষ্যে সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচী অব্যাহত রয়েছে। সিটি কর্পোরেশনের বস্তি উন্নয়ন কর্মকর্তারা বলছেন, ডিএফআইডির অর্থায়নে ২০১৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত গত তিন-চার বছরে প্রায় ৬০টি বস্তিতে উন্নয়ন কাজ করেছেন তারা। বর্তমানে বস্তি নিয়ে কাজ করছে এমন এনজিওগুলোর কাজ মনিটরিং করছেন। তিন মাস অন্তর অন্তর তাদের কাজ পর্যালোচনা ও সমন্বয় করতে মিটিংও করছেন। গত বছরের আগস্ট মাসে মিরপুরের রূপনগর থানাধীন ঝিলপাড় বস্তিতে আগুন লাগে। রাত ৮টার দিকে আগুন লাগার পর ফায়ার সার্ভিসের ১৭টি ইউনিটের চেষ্টায় আড়াই ঘণ্টা পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। ততক্ষণে আগুনে অন্তত ২০ থেকে ২৫ হাজার ঘর পুড়ে যায়। এরপর চলন্তিকা বস্তিতে আগুন লাগে, এতে পুড়ে যায় অন্তত ৩ হাজার ঘর। গত ৮ ফেব্রুয়ারি ভোরে বনানীর টিএ্যান্ডটি কলোনির বস্তিতে আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। এতে অন্তত ২০০ ঘর পুড়ে যায়। এতে কয়েক হাজার মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েন।
×