ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রোজায় বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার কঠোর

প্রকাশিত: ১১:২৭, ১২ মার্চ ২০২০

রোজায় বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার কঠোর

ওয়াজেদ হীরা ॥ আগামী এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে শুরু হচ্ছে সিয়াম সাধনার মাস মাহে রমজান। এর আগে প্রথম ও মধ্য সপ্তাহে শব-ই-বরাত ও পহেলা বৈশাখেও দ্রব্যমূল্যের চাহিদা থাকে বেশ। মানুষের চাহিদাকে কেন্দ্র করে অসাধু ব্যবসায়ীরা প্রতিবছরই চেষ্টা চালায় নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বাড়াতে। অতিরিক্ত টাকায় পণ্য কিনতে নাভিশ্বাস উঠে ক্রেতাদের। রমজানের আগে দেশে মরণব্যাধি করোনাভাইরাসের ছোবল মানুষের মনে আতঙ্ক অনেকটা বাড়িয়েছে। তবে বাজার নিয়ন্ত্রণে কঠোর সরকার। রোজাকে সামনে রেখে ইতোমধ্যেই ব্যাপক প্রস্তুতি নেয়া শুরু হয়েছে। আগাম প্রস্তুতি আর চাহিদার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি সরবরাহ থাকবে বলে চিন্তার কারণ নেই বলছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতে নিত্যপণ্যের সরবরাহ বাড়ানোর প্রস্তুতি শুরু হয়েছে বলে জানা গেছে। কয়েক বছর ধরেই আগাম প্রস্তুতি নিলেও শেষের দিকে এসে বাজার অনেকটাই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছিল। তবে গত বছর রোজায় শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অসাধু ব্যবসায়ীরা তেমন সুবিধা করতে পারেনি। প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের সরাসরি তত্ত্বাবধানে নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখার বিষয়টি শুরু চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে কাজ করে। ফলে জনগণ কিছুটা স্বস্তিও পেয়েছিল। এ বছরও জনগণকে রোজায় স্বস্তি দিতে চায় সরকার। বাজারে কোন পণ্যের ঘাটটি রাখতে চায় না একই সঙ্গে যেন দাম না বাড়ে কোন পণ্যের সে বিষয়টিও নিশ্চিত করতে বদ্ধপরিকর। এবারও একটু আগেভাগেই প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। বিভিন্ন সংস্থা, ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করছে। তবে ভাল ব্যবসায়ী ও সাধারণ জনগণের দাবি এখন থেকেই কড়া মনিটরিং রাখতে হবে যাতে করোনার অযুহাতে পণ্যের বাজার লাগাম ছাড়া না হয়। একই সঙ্গে এখন থেকেই যেন একটু একটু করে মূল্য বাড়ানোর পাঁয়তারা না চলে। ব্যাপক প্রস্তুতি রয়েছে ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)। রমজান এবং বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি জনকণ্ঠকে বলেন, রমজান ঘিরে আমাদের প্রস্তুতি অনেক ভাল গতবারের চেয়েও দশগুণ বেশি পণ্য নিয়ে বাজারে থাকব। যেমন গত বছর পেঁয়াজ ছিল ৩ হাজার টন এবার ৩০ হাজার টন রাখব হাতে। একইভাবে অন্যান্য পণ্য তেল, ছোলা খেজুর বেশি করে আমাদের হাতে রাখব যেন সঙ্কট না হয়। টেন্ডার হয়ে গেছে টিসিবি কোথা থেকে আনবে সব প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। যদিও পেঁয়াজ উৎপাদন শুরু হয়েছে। ছোলা গত বার দেড় হাজার টন ছিল এবার আট হাজার টন আমরা হাতে রেখেছি। আমাদের যথেষ্ট সরবরাহ থাকবে কোন অসাধু ব্যবসায়ী যেন সুযোগ না খুঁজে আমরা সতর্ক আছি। এছাড়াও সাম্প্রতিক সময়ের করোনাভাইরাসেও কোন প্রভাব পড়বে না বলেও মনে করেন তিনি। বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, অন্য যে কোন সময়ের চেয়ে এবার আমরা টিসিবিকে রমজান কেন্দ্রিক পণ্য বিক্রির কার্যক্রম জোরদার করতে বলেছি। খোলা ট্রাকে বিক্রির জন্য ইতোমধ্যে টিসিবি বেশকিছু পণ্য সংগ্রহ করেছে, আরও সংগ্রহ করতে বলা হয়েছে। বেসরকারী খাতের ব্যবসায়ীদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে পণ্যের আমদানি ও মজুত বাড়ান। যাতে ওই সময় দেশের মানুষ এসব পণ্য ন্যায্য দামে কিনতে পারেন। এসব উদ্যোগের ফলে রমজানে বাজার স্বস্তিতে থাকবে বলে জানান বাণিজ্যমন্ত্রী। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, করোনাভাইরাসের প্রভাব মোকাবেলা করে মুজিববর্ষ আর রমজান মাসে পণ্যমূল্য স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ টিসিবিকে ব্যাপক প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছে। এবারই প্রথমবারের মতো সংস্থাটি নিজেই রমজানের পণ্য আমদানি জন্য এরই মধ্যে দরপত্র আহ্বান করেছে। সব মিলিয়ে এবার রমজানের আগেই অন্যবারের চেয়ে প্রায় দশগুণ বেশি পণ্য নিয়ে টিসিবিকে মাঠে নামতে বলা হয়েছে। ইতোমধ্যেই গত ৪ মার্চ রমজানে ভোগ্যপণ্যের বাজারদর নিয়ন্ত্রণ রাখাসহ অন্যান্য ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। বৈঠকে নিত্যপণ্যের মজুত ও সরবরাহ, ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে এবং জনদুর্ভোগ লাঘবে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে বলা হয়। বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়কে নিত্যপণ্যের মজুত, সরবরাহ ও ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার বিষয়টি কঠোরভাবে বাস্তবায়নেরও নির্দেশ দেয়া হয়। এছাড়া খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধে জেলা প্রশাসন, খাদ্য মন্ত্রণালয় ও নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষকে দায়িত্ব দেয়া হয়। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে এসব বিষয়ে সার্বক্ষণিক খোঁজখবর রাখতে বলা হয় ওই বৈঠক থেকে। প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব ড. আহমদ কায়কাউসের সভাপতিত্বে ওই সভায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের উর্ধতন কর্মকর্তা, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিব এবং প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। এদিকে টিসিবির মুখপাত্র মোঃ হুমায়ূন কবির জনকণ্ঠকে বলেন, আমাদের সকল প্রস্তুতিই গুছিয়ে এনেছি কিছু পাইপলাইনে আছে। সামনে আমাদের মুজিব জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে একটি বরাদ্দ দেয়া হবে এরপরই আমরা রমজানের বিক্রি শুরু করব। এবছর আমাদের পণ্য স্টকে বেশি আছে ফলে ডিলার সংখ্যা বিক্রির জন্য ট্রাকের সংখ্যাও বাড়বে বলে জানান এই কর্মকর্তা। তবে রমজানে মানুষের স্বস্তি দিতে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে পুরো প্রস্তুতি রয়েছে বলেও জানান তিনি। টিসিবি সূত্রে জানা গেছে, অসাধু ও অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করে বাজার অস্থিতিশীল করতে না পারে সে জন্য বড় পরিসরে টিসিবির মাধ্যমে পেঁয়াজ, ছোলা, চিনি, মসুর ডাল, ভোজ্য তেল ও খেজুর বিক্রি করা হবে। এবারই প্রথম পেঁয়াজের বাজার অস্থিতিশীল হওয়ায় এ পণ্যটিও টিসিবি পণ্যে যুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে খেজুর ছাড়া বাকি পণ্য বাফার স্টক (আপৎকালীন মজুতের গুদাম) হিসেবে সারা বছরই ৫০০ থেকে এক হাজার টনের বেশি মজুত থাকে। চলতি বছরও একই পরিমাণ মজুত রয়েছে। সূত্রে আরও জানা গেছে, গত ফেব্রুয়ারির শুরুর দিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় রোজার বাড়তি চাহিদা পূরণে কয়েক গুণ পণ্য আমদানির নির্দেশ পায় টিসিবি সে অনুযায়ী, পণ্য আমদানি ও স্থানীয় বাজার থেকে ক্রয়ের প্রক্রিয়া শুরু করে টিসিবি। এরই মধ্যে একটি আন্তর্জাতিক টেন্ডারের মাধ্যমে আড়াই হাজার টন ছোলা আমাদির অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এ বছর ছোলা আমদানির লক্ষ্য ধরা হয়েছে মোট আট হাজার টন। যা গত বছর ছিল এক হাজার ৫০০ টন। এর বাইরে অন্যান্য পণ্য আমদানি করতে আরও দুটি টেন্ডার দেয়া হয়েছে। টিসিবি সূত্রে আরও জানা যায়, গত বছর ১০০ টন খেজুর আমদানি হলেও এ বছর খেজুর আমদানি করা হবে ৩০০ থেকে ৫০০ টন। এছাড়াও ভোজ্য তেল বছরব্যাপী আমদানি করছে টিসিবি। গত বছর টিসিবি ভোজ্য তেল আমদানি করে তিন হাজার টন। এবার তা বাড়িয়ে সাত হাজার টন আমদানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। গত বছর চিনির আমদানি ছিল সাড়ে তিন হাজার টন। এ বছর তা পাঁচ থেকে ১০ গুণ বাড়ানো হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে চিনির আমদানি ছাড়াবে ২৫ হাজার টন। এছাড়া মসুর ডাল গত বছর ছিল দুই হাজার ৫০০ টন। চলতি বছর এ পণ্যটির আমদানিও কয়েক গুণ বাড়ানো হচ্ছে। এছাড়াও রাজধানীর খোলা বাজারে টিসিবির পণ্য বিক্রির জন্য ট্রাকের পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ করে ৩৫০টি করা হচ্ছে। এর বাইরে ১০টি সেলস সেন্টার, নতুন চারটি ক্যাম্প অফিস এবং আটটি আঞ্চলিক অফিসের মাধ্যমেও এসব পণ্য সরবরাহ করা হবে টিসিবি।
×