ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

শাকিল আহমেদ মিরাজ

পঞ্চম শিরোপায় ল্যানিংদের বাজিমাত

প্রকাশিত: ১২:০৩, ১১ মার্চ ২০২০

পঞ্চম শিরোপায় ল্যানিংদের বাজিমাত

পুরো টুর্নামেন্টে ভাল খেলেও ফাইনালে নার্ভ ফেল! শিরোপার মঞ্চে চূড়ান্ত লড়াইয়ে ৮৫ রানের বড় হার ভারতের। প্রথমবার নারী টি২০ বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠে স্বপ্ন দেখছিল উইমেন ইন ব্লু। শেষ পর্যন্ত হারমাপ্রিত কাউরদের কাঁদিয়ে পঞ্চমবারের মতো চ্যাম্পিয়ন দুরন্ত-দূর্বার অস্ট্রেলিয়ান মেয়েরা। উল্লেখ্য, ছেলেদের পর এবার মেয়েদের ক্রিকেটেও অস্ট্রেলিয়া রাজত্ব। ওয়ানডে বিশ্বকাপে অজিরা-পুরুষ ক্রিকেট পাঁচবার শিরোপা জিতেছে। ১৯৮৭, ১৯৯৯, ২০০৩, ২০০৭, ২০১৫ সালে। দেশটির মেয়েরা এবার পঞ্চমবার টি২০ বিশ্বকাপ জিতে ছেলেদের এই অনন্য নজিরের সঙ্গে একই স্থানে উঠে এলো। ২০০৭ সালে ছেলেদের প্রথম টি২০ বিশ্বকাপেই শিরোপা জিতে বাজিমাত করেছিল মহেন্দ্র সিং ধোনির দল। দেশটির মেয়েরা এবারই প্রথম ফাইনালে উঠেও পারল না। ২০০৯, ২০১০ ও সর্বশেষ ২০১৮ সালে সেমি থেকে বিদায় নেয় ভারত। ২০০৯ সালে প্রথম নারী টি২০ বিশ্বকাপে চাম্পিয়ন হয়েছিল ইংল্যান্ড। আর অস্ট্রেলিয়া এর আগে সাফল্য পায় ২০১০, ২০১২, ২০১৪ ও ২০১৮ সালে। মাঝে ২০১৬Ñএ শিরোপা যায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ মেয়েদের ঘরে। মেলবোর্নে রবিবার টি২০ বিশ্বকাপের গ্র্যান্ড ফাইনালে শুরুতেই হারমানপ্রিতদের ¯œায়ুর পরীক্ষায় ফেলে অজি ব্যাটরারা। এ্যালিসা হিলি (৭৫) ও বেথ মুনির (৭৮*) ধুন্ধুমার ব্যাটিংয়ে নির্ধারিত ২০ ওভারে ৪ উইকেটে ১৮৪ রানের পাহাড় গড়ে আয়োজক দেশটির মেয়েরা। যে পাহাড়ে উঠতে গিয়ে রীতিমতো ধ্বংসস্তূপে পরিণত ভারত যেন হারার আগেই হেরে বসে। ৫ বল বাকি থাকতে গুটিয়ে যায় ৯৯ রানে! সপ্তম বিশ্বকাপে এসে প্রথমবারের মতো ফাইনালে উঠে স্বপ্পভঙ্গের বেদনায় পোড়ে বিরাট কোহলির দেশের মেয়েরা। ৮৫ রানের বিশাল জয়ে নারীদের ক্রিকেটে রেকর্ড ৮৬ হাজার দর্শকের সামনে পঞ্চম শিরোপার উল্লাসে মেতে ওঠে মেগ ল্যানিংয়ের অস্ট্রেলিয়া। দুরন্ত ব্যাটিংয়ে ম্যান অব দ্য ফাইনাল এ্যালিসা হিলি। ৬৪.৭৫ গড়ে সর্বোচ্চ ২৫৯ রান করে টুর্নামেন্টসেরা বেথ মুনি। স্ত্রী এ্যালিসার ফাইনাল দেখতে দক্ষিণ আফ্রিকায় ওয়ানডে সিরিজ থেকে ছুটি নিয়ে মেলবোর্নে উড়ে এসেছিলেন মিচেল স্টার্ক। স্বার্থক অস্ট্রেলিয়ান পেসার! স্বামীর জন্য হিলি যেন সাজালেন নৈবেদ্য, ৭ চার ও ৫ ছক্কায় খেললেন ৩৯ বলে ৭৫ রানের মনোমুগ্ধকর ইনিংস। দুর্দান্ত ফর্মে থাকা বেথ মুনির ব্যাট থেকে এসেছে ৫৪ বলে ১০ চারে ৭৮ রানের অপরাজিত ইনিংস। নারীদের টি২০ বিশ্বকাপের ইতিহাসে ফাইনালে এটিই সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত সংগ্রহের রেডর্ক। অফিসিয়াল হিসেবে এদিন ফাইনালে দর্শক ছিল ৮৬ হাজার ১৭৪ জন। ক্রিকেট তো বটেই, অস্ট্রেলিয়ায় মেয়েদের যে কোন ক্রীড়া ইভেন্টে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দর্শকের রেকর্ড এটি। টস জয়, ব্যাটিং, বোলিং, ফিল্ডিংÑ এক কথায় পঞ্চম শিরোপা জয়ের দিনে সবকিছুই হয়েছে অস্ট্রেলিয়া মনের মতো। হিলি-মুনির ১১৫ রানের উদ্বোধনী জুটিই ছিল ম্যাচে ভাগ্য নির্ধারক। প্রথম ওভার থেকেই তা ব চালান মেয়েদের ক্রিকেটের অন্যতম বিধ্বংসী ব্যাটার হিলি। ইনিংসের পঞ্চম বলে ৯ রানে জীবন পেয়ে তিনি হয়ে ওঠেন অপ্রতিরোধ্য। মাত্র ৩০ বলে হিলি স্পর্শ করেন হাফসেঞ্চুরি। মেয়েদের ক্রিকেটে তো বটেই, ছেলেদের ক্রিকেটেও কোন আইসিসি টুর্নামেন্টের ফাইনালে এর চেয়ে কম বলে হাফসেঞ্চুরি আর নেই। দ্বাদশ ওভারে থামে হিলির ঝড়। আগের ওভারেই শিখা পান্ডেকে হ্যাটট্রিক ছক্কা মারেন হিলি। পরের ওভারে রাধা যাদবকে আবার ছক্কায় ওড়াতে গিয়ে ধরা পড়েন লং অনে। হিলির বিদায়ের পর অধিনায়ক মেগ ল্যানিং টিকতে পারেননি বেশিক্ষণ। দ্রুত ফেরেন এ্যাশলি গার্ডনারও। এক ওভারে দুই জনকে ফিরিয়ে অস্ট্রেলিয়ার রানের গতিতে কিছুটা রাশ টানেন অফ স্পিনার দিপ্তি শর্মা। কিন্তু একপ্রান্তে রানের চাকা ঠিকই সচল রাখেন মুনি। ৮ রানে জীবন পাওয়া এই ব্যাটার ৪১ বলে পূর্ণ করেন হাফসেঞ্চুরি। বড় লক্ষ্য তাড়ায় মেগান শুট, জেস জোনাসেনদের আগুনে বোলিংয়ে পুড়ে ভারতীয় ব্যাটিং। হারমানদের ব্যাটিংয়ে স্পষ্ট ছিল চাপের প্রভাব। রান রেটের দাবি মেটাতে গিয়ে নিয়মিত বিরতিতে উইকেট হারায় তারা। প্রথম পাঁচ ব্যাটারের একজন ছুঁতে পেরেছেন দুই অঙ্কে। মাথায় বলের আঘাতে তানিয়া ভাটিয়া মাঠ ছাড়েন। পরে তার পরিবর্তে ব্যাটিংয়ে নামেন রিচা ঘোষ করেন ১৮ রান। অলরাউন্ডার দিপ্তির ৩৩ রানের ইনিংস কেবল হারের ব্যবধানই কিছুটা কমিয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার হয়ে শুট ৪ ও জোনাসেন নিয়েছেন ৩ উইকেট। সাত আসরে একটা দল পাঁচবার চ্যাম্পিয়ন, ভাবা যায়? অভাবিত কাজটা করে যারপরনাই গর্বিত ল্যানিং, ‘এই দলটা নিয়ে আমি খুব গর্বিত। আমরা উত্থান পতনের ভেতর দিয়ে এসেছি। (ভারতের কাছে) প্রথম ম্যাচ হারার পর চ্যাম্পিয়ন হওয়াটা বিশেষ কিছু। ঘরে-বাইরে আমাদের কাছে অনেক প্রত্যাশা ছিল।’ বলেন চ্যাম্পিয়ন অধিনায়ক। গ্রুপপর্বে যে ভারতের কাছে হারতে হয়েছিল, সিডনিতে ৮৫ রানের বিশাল জয়ের পথে সেই তাদের রীতিমতো বিধ্বস্ত করেছে অজিরা। বুঝিয়ে দিয়েছে যে কোন ঘারনার ক্রিকেটে বড় ম্যাচের বড় দল অস্ট্রেলিয়া। টস জয় থেকে শুরু করে ব্যাটিং, বোলিং, ফিল্ডিং কিংবা আগ্রাসনÑ কোন দিক থেকে প্রতিপক্ষকে পাত্তা দেয়নি অস্ট্রেলিয়া। রেকর্ড ৮৬ হাজার দর্শকের সামনে পঞ্চম শিরোপার উল্লাসে মেতে ওঠেন ল্যানিং, হিলি, বেথ মুনি, মেগান স্কুটরা। মাত্র ৩৯ বলে ৭ চার ও ৫ ছক্কায় ৭৫ রানের দুর্দান্ত ইনিংস খেল ম্যান অব দ্য ফাইনালের পুরস্কার জেতা হিলি বলেন, ‘এটা ছিল অবিশ্বাস্য। সবাইকে ধন্যবাদ। এটা আমার জন্য বিশেষ কিছু। আমি কেবল দর্শকদের আনন্দ দিতে চেয়েছিলাম।’ স্ত্রী এ্যালিসার ব্যাটিং দেখতে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের শেষ ওয়ানডের আগেই দেশে ফিরে আসেন অস্ট্রেলিয়ার ফাস্ট বোলার মিচেল স্টার্ক। বউয়ের ব্যাটের ঝড় তিনি দেখেছেন গ্যালারিতে বসে। ৬৪.৭৫ গড়ে সর্বোচ্চ ২৫৯ রান করে টুর্নামেন্টসেরা বেথ মুনি। ইনজুরির কারণে অভিজ্ঞ অলরাউন্ডার এ্যালিস পেরির অনুপস্থিতিতে এ সাফল্য দলীয় প্রচেষ্টার ফল বলে অভিহীত করেন অস্ট্রেলিয়ান অধিনায়ক মেগ ল্যানিং। ল্যানিং-হিলিরা যখন উচ্ছ্বসিত তখন বিমর্ষ ভারত অধিনায়ক হারমানপ্রিত কাউর। প্রথমবার ফাইনালে উঠেও যে শিরোপাটা অধরা রয়ে গেল বিরাট কোহলির দেশের মেয়েদের। তবে হতাশা ভুলে ভবিষ্যতের আলো দেখছেন হারমানপ্রিত, ‘গতবারের টি২০ বিশ্বকাপে আমরা সেমিফাইনাল পর্যন্ত পৌঁছেছিলাম। এবার ফাইনাল খেললাম। আমার মনে হয়, ঠিক পথেই আমরা এগিয়েছি। আসল ম্যাচগুলোয় কীভাবে খেলতে হবে, সেই বিষয়ে আমাদের এবার থেকে নজর দিতে হবে।’ তিনি আরও যোগ করেন, ‘আমাদের দুর্ভাগ্য যে ক্যাচ ছেড়েছি। আগামী দেড় বছর খুব গুরুত্বপূর্ণ। ফিল্ডিংয়ে আমাদের নজর দিতে হবে। এই দলটার উপরে আমার অগাধ আস্থা রয়েছে।’ ফাইনালে অজিদের কাছে এমন হতশ্রী হার প্রসঙ্গে হারমানপ্রিতের বক্তব্য, ‘খেলায় হার-জিত রয়েছে। সবকিছু থেকেই শিক্ষা নিতে হয়।’
×