ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

শিক্ষাঙ্গনে করোনা আতঙ্ক

প্রকাশিত: ১১:০১, ১১ মার্চ ২০২০

শিক্ষাঙ্গনে করোনা আতঙ্ক

বিভাষ বাড়ৈ ॥ করোনাভাইরাস নিয়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে। বিশ^ব্যাপী করোনাভাইরাসের উদ্বেগজনক প্রভাবের মধ্যেই দেশে রোগী শনাক্তের পর স্কুল, কলেজ বিশ^বিদ্যালয়সহ সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই শিক্ষার্থী, শিক্ষক অভিভাবকদের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়েছে আতঙ্ক। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জনসমাগম এড়নোর নির্দেশ দিলেও প্রতিষ্ঠান বন্ধে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ না আসায় আতঙ্ক নিয়েই শিক্ষাঙ্গনে আসছে শিক্ষার্থীরা। অনেকেই ক্লাস করছে সতর্কতা হিসেবে মাস্ক পরে। আতঙ্ক আছে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়েও। এদিকে সকল স্কুল-কলেজের জন্য সতর্কতা জারি করেছে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা (মাউশি) অধিদফতর। গত দুদিন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান প্রধান, শিক্ষার্থী অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে অনেকটা আতঙ্কের চিত্রই পাওয়া গেছে। অধিকাংশ শিক্ষার্থী ও অভিভাবক বিশে^র অন্যান্য অনেক দেশের মতো আপাতত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের দাবি জানালেও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কোন নির্দেশ না আসায় প্রতিষ্ঠান প্রধানরাও কিছু বলতে পারছেন না। আতঙ্কের কথা সকলে বললেও তারা দাবি করেছেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় বন্ধের আদেশ না দিলে আমরা কিছু করতে পারছি না। তবে শিশুদের কথা চিন্তা করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অনেক প্রধান শিক্ষকই দ্রুত স্কুল বন্ধের দাবি জানিয়েছেন। আতঙ্ক ও দাবির মধ্যেই মঙ্গলবার শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি বলেছেন, বিশেষজ্ঞদের মতামতের প্রেক্ষিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। করোনাভাইরাস সম্পর্কে জাতীয় পর্যায়ে বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠান আইইডিসিয়ারের মতামত অনুযায়ী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করার মতো এখনও পরিস্থিত তৈরি হয়নি। শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিবে। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ বিষয়ে সচেতনতামূলক প্রয়োজনীয় নির্দেশনা পাঠানো হচ্ছে। মন্ত্রীর বক্তব্যের পরই বুধবার করোনাভাইরাস সংক্রান্ত লক্ষণ উল্লেখ করে সতর্কতা জারি করেছে মাউশি অধিদফতর। দেশের সব স্কুল-কলেজের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে সচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে মাউশি এ বিজ্ঞপ্তি জারি করে। মাউশির মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. সৈয়দ মোঃ গোলাম ফারুক স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, মাউশির অধীন দেশের সব সরকারী-বেসরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্টদের করোনাভাইরাসের ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে সচেতন ও সচেষ্ট থাকা প্রয়োজন। করোনাভাইরাস আক্রান্তের লক্ষণ, যেভাবে ছড়ায় এবং এর প্রতিকার উল্লেখ করে সজাগ থাকার আহ্বান জানানো হয়েছে বিজ্ঞপ্তিতে। পরিস্থিতি মোকাবেলায় আইইডিসিআর করোনাভাইরাসের তথ্য সংবলিত নির্দেশনা মেনে চলার অনুরোধ এবং আতঙ্ক ও ভীত না হওয়ার আহ্বানও জানানো হয়েছে। কেউ আক্রান্ত হলে কিংবা সম্ভাব্য লক্ষণ দেখা গেলে আইইডিসিআর করোনা কন্ট্রোল রুমে যোগাযোগ করতে অনুরোধ করা হয়েছে বিজ্ঞপ্তিতে। তবে প্রতিষ্ঠান খোলা থাকায় প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষক কর্মচারীরা আছেন আতঙ্কে। অনেক প্রতিষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশ মেনে লোকসমাগম এড়াতে শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধের দাবি তুলেছেন প্রধান শিক্ষক ও অধ্যক্ষের কাছে। তবে প্রত্যেক প্রধান শিক্ষক ও অধ্যক্ষই বলেছেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় নির্দেশ না দিয়ে তাদের কিছু করার নেই। এমন অবস্থার মধ্যে বুধবার প্রায় প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একই চিত্র দেখা গেছে। কিছু প্রতিষ্ঠানে উপস্থিতি কিছুটা কম ছিল। মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল এ্যান্ড কলেজে গিয়ে দেখা যায় অধিকাংশ শিক্ষার্থীই প্রতিষ্ঠানের দেয়া শতর্কতামূলত আদেশ মেনে মাস্ক পরে এসেছে। তবে অভিভাবকরা ছিলেন আতঙ্কে। শিশু সন্তানকে স্কুলে প্রবেশ করিয়ে বাইরে অপেক্ষা কলছিলেন মা রেবেকা। তিনি বলছিলেন, চিন্তায়তো আছিই। স্কুলটা কয়েকটা দিন বন্ধ খরলে কি এমন ক্ষতি হয়। নানা কথা শুনে এমনতিই ভয়ে আছি। এভাবে পড়ালেখা করা যায়? অধ্যক্ষ ড. শাহান আরা জনকণ্ঠকে বলেছেন, আতঙ্ক নিয়েই সকলে আসছে। আমরা শতর্কতামূলক নির্দেশ দিয়েছি। করোনাভাইরাস নিয়ে করণীয় কি, সেই লিফলেট দিয়েছি, গেটেও পোস্টারিং করেছি। অনেক শিক্ষার্থী মাস্ক পরে এসেছে। তবে সকলেই আতঙ্কে আছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সকলে আতঙ্কে থাকলেও আমরাতো প্রতিষ্ঠান বন্ধ করতে পারি না। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত দিলে আমরা তা বাস্তবায়ন করব। একই চিত্র দেখা গেল একটু বড়দের প্রতিষ্ঠান তেজগাঁও কলেজেও। উপস্থিতি নিয়ে অনার্স মাস্টার্স পর্যায়ের প্রতিষ্ঠানে ততটা কঠোর বিধি বিধান না থাকায় এখানে উপস্থিতি কমে গেছে। সকলে তেজগাঁও কলেজে গিয়ে দেখা যায় প্রচুর শিক্ষার্থী সতর্কতা হিসেবে মাস্ক পরে এসেছে। অনার্সের শিক্ষার্থী রাজিব বলছিলেন, কি করব। ভয়তো পাচ্ছিই। কলেজ খোলা থাকায় আসতে হয়েছে ভয় নিয়েই। অনেকেই তো আসেনি ভয়ে। অনেক দেশেই তো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছে। বন্ধ রাখলে অন্তত অনেক মানুষের ঘর থেকে বের হওয়া লাগে না। লোকসমাগমে আসতে হতো না। অধ্যক্ষ অধ্যাপক মোঃ আব্দুর রশিদ বলছিলেন, সকলের মাঝেই আতঙ্ক আছে। আতঙ্ক নিয়েই সকলে কলেজে আসছে। কিন্তু শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আদেশ ছাড়াতো আমরা প্রতিষ্ঠান বন্ধের ঘোষণাও দিতে পারি না। ভিকারুন নিসা নূন স্কুল এ্যান্ড কলেজের চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রীর মা রোকসানা বুধবার সন্ধ্যায় ফোন করে স্কুল বন্ধের কোন খবর আছে কিনা জানতে চান। কোন তথ্য নেই জানালে হতাশ হয়ে তিনিস বলেন, ভাই এভাবে স্কুল খোলা রাখার কি দরকার। দেশের প্রত্যেকটা মানুষ ভয়ে আছে। কটা দিন স্কুল বন্ধ রাখলে কি এমন ক্ষতি হয়। বহু দেশেই তো স্কুল বন্ধ রাখা হয়েছে। খোলা রাখায় আজও মেয়েকে স্কুলে নিয়ে এসেছি। ভিকারুন নিসা নূন স্কুল এ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ফওজিয়া রেজওয়ান বলেন, মন্ত্রণালয় থেকে যে নির্দেশনা দেবে তা বাস্তবায়ন করা হবে। আমাদের নানা পদক্ষেপ নেয়ার মতো সক্ষমতা রয়েছে। শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের নানাভাবে সচেতন করা হবে। পাশাপাশি প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখতে মন্ত্রণালয় নির্দেশনা দিলে সেটি কার্যকর করা হবে। শিক্ষার্থী অভিভাবকদের চরম উদ্বেগের কথা জানালেন রাজধানীর শ্যামলী আইডিয়াল পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ এম এম সাত্তার। বাংলাদেশ বেসরকারী পলিটেকনিক শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট অধ্যক্ষ এম এ সাত্তার বলেছেন, মারাত্মক আতঙ্ক সকলের মাঝে। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা কথা বলছেন। সকলেই আমরা তাকিয়ে আছি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দিকে। তারা যেখাবে বলবে সেভাবে আমরা পদক্ষেব নেব। এদিকে শিশুদের কথা চিন্তা করে অবিলম্বে প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধের দাবি জানিয়েছেন বাংলাদেশ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রধান শিক্ষক সমিতির সভাপতি বদরুল আলম মুকুল। রাজধানীর আবদুল হামিদ দর্জি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এ প্রধান শিক্ষক বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী লোকসমাগম এড়ানোর কথা বলেছেন। কিন্তু স্কুল খোলা রাখছে লোকসমাগমতো হবেই। এটা হলেই তো ভয় থাকবে। তাদের মা-বাবা আতঙ্কে আছে। অনেকেই স্কুলে আসছে না। ফোন দিয়ে জানাচ্ছে ভয়ের কথা। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। তাই আমি মনে করি বাচ্চাদের কথা আগে ভাবা দরকার। জানা গেছে, সারাদেশে ৬৫ হাজারের বেশি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চার কোটি শিক্ষার্থী রয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক মোঃ ফসিউল্লাহ বলেছেন, বিষয়টি নিয়ে আমরা সজাগ। এ বিষয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সচেতনতা তৈরিতে পদক্ষেপ নেয়া হবে। এ বিষয়ে আতঙ্ক না ছড়িয়ে সবার সচেতন হওয়া জরুরী। দেশের পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে কী করণীয় সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। এদিকে আতঙ্ক আছে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়েও। তবে বন্ধের দিকে না গিয়ে সকলকে সচেতন রাখার পক্ষে উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোঃ আখতারুজ্জামান। তিনি জনকণ্ঠকে বলেছেন, শিক্ষিত মেধাবী সন্তানরা হচ্ছে আমাদের শিক্ষার্থীরা। সকলকে ঘরে আটকে রাখার চিন্তাটা হচ্ছে খারাপ। তার চেয়ে আমার আহ্বান হবে, সকলে যার যার জায়গায় যেন সচেতন থাকে, সতর্ক থাকে।
×