ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

করোনা আতঙ্কে সাধারণ ভোক্তাদের উদ্বেগ, অস্থির কাঁচাবাজার

প্রকাশিত: ১০:৫৭, ১১ মার্চ ২০২০

করোনা আতঙ্কে সাধারণ ভোক্তাদের উদ্বেগ, অস্থির কাঁচাবাজার

এম শাহজাহান ॥ সাধারণ ভোক্তাদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় অস্থির কাঁচাবাজার। ঢাকাসহ সারাদেশে করোনা আতঙ্কে সব ধরনের কেনাকাটা বাড়িয়ে দিয়েছেন ভোক্তারা। ‘এই বুঝি ফুরিয়ে গেল’-এ ধরনের মনোভাব থেকে হুমড়ি খেয়ে কাঁচাবাজার ও পাড়া-মহল্লার দোকান থেকে কেনাকাটা করা হচ্ছে। বিশেষ করে স্যানিটাইজার ও মাস্কের মতো মেডিক্যাল পণ্য পাগলের মতো ফার্মেসি থেকে কিনে নিচ্ছেন সাধারণ মানুষ। এছাড়া চাল, ডাল, ভোজ্যতেল, পেঁয়াজ ও মাছ-মাংসের মতো নিত্যপণ্যের কেনাবেচা বেড়ে গেছে বাজারগুলোতে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাজারে কোন পণ্যের সঙ্কট নেই। এ কারণে চাহিদার তুলনায় বেশি পণ্য কেনাকাটার প্রয়োজন নেই কোন ভোক্তার। কারণ তাদের অতিরিক্ত কেনাকাটার সুযোগ নিচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করে বিভিন্ন পণ্যের দাম বাড়ানো হচ্ছে। এদিকে, গত রবিবার ঢাকায় তিন করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার পর থেকে সাধারণ ভোক্তাদের মধ্যে অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে। ওই দিন থেকে হুমড়ি খেয়ে কেনা হচ্ছে স্যানিটাইজার, মাস্ক, স্যাভলন ও হ্যান্ডওয়াশের মতো মেডিক্যাল পণ্য। এতে করে অসাধু ব্যবসায়ীরা কারসাজির সুযোগ পাচ্ছে। বাজারে কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করে ইতোমধ্যে বিভিন্ন জিনিসের দাম বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। যদিও করোনাভাইরাস থেকে মুক্ত থাকতে সব ধরনের স্যানিটাইজারের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার। চলছে মোবাইল কোর্টের ভ্রাম্যমাণ অভিযান। দাম বেশি নেয়ার অপরাধে অনেক ব্যবসায়ীকে জেল জরিমানা করা হচ্ছে। এছাড়া অহেতুক মাস্ক ব্যবহার ও অতিরিক্ত কেনাকাটা না করার পরামর্শ দিয়েছেন বাজার বিশেষজ্ঞরা। ব্যবসায়ীদের মতে, চাহিদার তুলনায় বাজারে সব ধরনের নিত্য ও ভোগ্যপণ্যের সরবরাহ এবং মজুত পরিস্থিতি কয়েকগুণ বেশি রয়েছে। এছাড়া ঢাকাসহ দেশের সব জেলা পর্যায়ের বাজারেও চাল, ডাল, ভোজ্যতেল, চিনি, আটা, পেঁয়াজ, আদা রসুনের মতো কোন পণ্যের সঙ্কট নেই। রোজা সামনে রেখে ইতোমধ্যে ব্যবসায়ীরা আমদানিকৃত সব পণ্যের মজুদ বাড়িয়ে দিয়েছেন। কিন্তু করোনা আতঙ্কে সব ধরনের কেনাকাটা বাড়িয়ে দিয়েছেন ভোক্তারা। রাজধানীর কাওরানবাজার, কাপ্তানবাজার, ফকিরাপুল বাজার, খিলগাঁও সিটি কর্পোরেশন মার্কেট এবং মালিবাগ কাঁচাবাজার ঘুরে দেখা গেছে, ক্রেতারা ইচ্ছেমতো বেশি করে কেনাকাটা করছেন। ব্যবসায়ীরাও এই সুযোগে বেশির ভাগ পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। এমনকি শাক-সবজির মতো পণ্যের দামও চড়া। এছাড়া গত কয়েক মাস ধরে মাছ-মাংসের দাম স্থিতিশীল থাকলেও এখন ভোক্তারা বেশি করে কেনাকাটা করে তা ফ্রিজে রেখে দিচ্ছেন। কাওরানবাজারে বাজার করছিলেন, ফার্মগেট ইন্দিরা রোডের বাসিন্দা শওকত আলী। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, করোনা আতঙ্ক থেকে একটু বেশি কেনাকাটা করা হচ্ছে। মাছ-মাংস ফ্রিজ করা হবে, যাতে ভবিষ্যতে আরও বেশি দামে কিনতে না হয়। তিনি বলেন, কিছু হলেই জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায়। আর এ কারণেই বাড়তি কেনা। তিনি আক্ষেপ করে জানালেন, ঢাকার ৯০ ভাগ মানুষ স্যানিটাইজারের সঙ্গে পরিচিত নয়। অথচ করোনা আতঙ্কে সবাই এই পণ্যটি ফার্মেসি থেকে নিয়ে নিয়েছে। কারও একটি প্রয়োজন হলে সে পাঁচটি নিয়েছে। এখন ফার্মেসিতে আর এই পণ্যটি নেই। তবে ভোগ্যপণ্যের ব্যবসায়ীরা বলছে, আগামী তিন থেকে চার মাস পর্যন্ত চলার মতো চাল, ডাল, ভোজ্যতেল, চিনি ও আটার মতো নিত্যপণ্যের মজুদ রয়েছে। এছাড়া সামনে ইরি ও বোরো কাটা শুরু হবে। চালের কোন সঙ্কট নেই। পেঁয়াজ উঠা শুরু হয়েছে। এছাড়া আমদানি কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। এছাড়া ভোজ্যতেলের আন্তর্জাতিক বাজার নি¤œমুখী। মালয়েশিয়াসহ ভোজ্যতেল উৎপাদনকারী দেশ তাদের তেল বিক্রি করতে পারছে না। এছাড়া সব ধরনের জ্বালানি তেলের দামে পতন। অর্থাৎ নতুন করে আরও কোন পণ্যের দাম বাড়ার কোন কারণ নেই। এ প্রসঙ্গে মৌলভীবাজারের ভোজ্যতেল ও চিনির পাইকারি ব্যবসায়ী হাজী মোহাম্মদ আলী ভুট্টো জনকণ্ঠকে বলেন, ভোজ্যতেল ও চিনির দাম বাড়ার আর কোন কারণ নেই। কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে এসব পণ্যের দামের পতন হয়েছে। মালয়েশিয়া তেল বিক্রি করতে পারছে না। তিনি বলেন, করোনা আতঙ্কে বেশি করে কারও পণ্য কেনার প্রয়োজন নেই। পাইকারি ও মিল মালিকরা পণ্য নিয়ে বসে আছেন, কিন্তু সেইভাবে বিক্রি হচ্ছে না। এ কারণে অহেতুক খুচরা পর্যায়ে বাড়তি কেনাকাটার প্রয়োজন নেই। তিনি বলেন, মানুষ আতঙ্ক থেকে দুএকটি পণ্যের বেশি কেনাকাটা হয়তো করছে। তবে এটার প্রয়োজন নেই, কারণ বাজারে পর্যাপ্ত ভোগ্যপণ্যের মজুদ রয়েছে। এদিকে, খুচরা পর্যায়ে চাল, ডাল, ভোজ্যতেল ও চিনির মতো পণ্যের বিক্রি কিছুটা বেড়েছে বলে জানিয়েছেন কাপ্তানবাজারের চাল ব্যবসায়ী মোঃ নূরুল ইসলাম। তিনি বলেন, গত কয়েক মাস ধরে চালের দাম একটু বাড়ে আবার একটু কমে। তবে গত সপ্তাহ থেকে বিক্রি একটু বেড়েছে। কেজি প্রতি ১-২ টাকা পর্যন্ত দাম বেড়েছে। তিনি বলেন, মোটা চায়না ইরি ও স্বর্ণাখ্যাত চাল ৩৫-৪২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। পাইকারি বাজারে চালের কোন ঘাটতি নেই, তাই বেশি করে চাল কেনার প্রয়োজন নেই। এ ছাড়া সামনে নতুন ধান কাটা শুরু হবে। ওই সময় জিনিসপত্রের দাম কমে আসবে। এদিকে সপ্তাহের ব্যবধানে নিত্যপণ্যের বাজারে বেড়েছে ভোজ্যতেল, গুঁড়োদুধ ও আলুর। তবে দাম কিছুটা কমেছে রসুন ও পেঁয়াজের। প্রতি কেজি দেশী রসুন ৮০-৯০ এবং আমদানিকৃত মোটা দানারটি ১৫০-১৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে খুচরা বাজারে। এছাড়া প্রতি কেজি দেশী ও আমদানিকৃত পেঁয়াজ ৭০-৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তবে ক্রেতারা কেনাকাটা যেভাবে বাড়িয়ে দিয়েছে তাতে এসব পণ্যের দাম বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। গ্রীষ্মকালীন সবজির সরবরাহ বাড়তে শুরু করেছে বাজারে। চড়া মূল্যে এসব সবজি কিনতে হচ্ছে ভোক্তাদের। শীতের সবজির সরবরাহ কমে আসায় বাজারে সব ধরনের সবজির দাম বাড়তি। এদিকে, একদিকে করোনা আতঙ্ক অন্যদিকে আগামী মাসে শুরু হচ্ছে রোজা। রোজার প্রায় দু’মাস বাকি থাকতে অধিকাংশ পণ্যের দাম বাড়তে শুরু করেছে। প্রতি লিটার খোলা সয়াবিনে ৭ টাকা দাম বেড়ে এখন তা খুচরা বাজারে ৯২-৯৩ টাকা এবং পামওয়েল সুপার ৬ টাকা দাম বেড়ে খুচরা বাজারে ৮১-৮৪ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কেজিতে ৩ টাকা দাম বেড়ে প্রতি কেজি আলু ১৮-২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে খুচরা বাজারে। এছাড়া প্রতি কেজি গুঁড়োদুধ ডিপ্লোমা ও ডানোতে ৪০ টাকা বেড়ে ৬২০-৬৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ইতোমধ্যে বাজারে অন্য ব্র্যান্ডের গুঁড়োদুধের দামও বাড়তে শুরু করেছে। নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধিতে নাখোশ ভোক্তারা। পেঁয়াজ ও রসুনের মতো পণ্যও বেশি করে কেনাকাটা শুরু হয়েছে। অথচ এসব পণ্যের পর্যাপ্ত সরবরাহ রয়েছে বাজারে। ভোক্তারা বেশি করে না কিনলে এসব পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে থাকবে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ক্যাব সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ভোক্তাকে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে। তাদের কারণে যেন পণ্যের দাম না বাড়ে। কেউ যাতে ১০ দিনের পণ্য একদিনে ক্রয় না করেন। এতে বাজারে বাড়তি চাহিদার সৃষ্টি হবে। আর এ সুযোগে ব্যবসায়ীরা পণ্যের দাম বাড়াবেন। ব্যবসায়ীদের এ সুযোগ দেয়া যাবে না। তিনি আরও বলেন, সরকারী তদারকি সংস্থাকেও সজাগ থাকতে হবে। করোনা ইস্যুতে কেউ যাতে দাম বাড়াতে না পারে। এছাড়া দেশে করোনাভাইরাস শনাক্তের খবর প্রকাশের পর এ সংক্রান্ত মেডিক্যাল সামগ্রীর চাহিদা বেড়ে গেছে। আর এর সুযোগ নিচ্ছেন বিক্রেতারা। তারা কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে এসব পণ্য কয়েকগুণ বেশি দামে বিক্রি করছেন। দোকানে ২০ টাকার মাস্ক বিক্রি হচ্ছে ২শ’ টাকায়। অনেক ফার্মেসি আবার এসব পণ্য পাওয়া যাচ্ছে না লিখে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দিচ্ছে। তবে বাড়তি দাম দিলে মিলছে এসব পণ্য। সরকার নির্ধারিত মূল্যে মেডিক্যাল পণ্য সামগ্রী বিক্রি করতে তাদের অনীহা রয়েছে। আর হ্যান্ডওয়াশতো উধাও হয়ে গেছে। রবিবার বিভিন্ন ধরনের তরল হ্যান্ডওয়াশ ১৩০ থেকে ১৫০ টাকায় বিক্রি হয়। কিন্তু মঙ্গলবার সেগুলো বিক্রি হয়েছে ২০০ থেকে ২৫০ টাকায়।
×