ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

বিন কেন, ইচ্ছেমতো ময়লা ফেলতে দোষ কি? দায় ও দায়িত্ব

প্রকাশিত: ১০:৫৬, ১১ মার্চ ২০২০

বিন কেন, ইচ্ছেমতো ময়লা ফেলতে দোষ কি? দায় ও দায়িত্ব

রাজন ভট্টাচার্য ॥ তিন বন্ধু মিলে জমপেশ আড্ডা। এক পর্যায়ে কিছু খাবারের চিন্তা। আনা হলো আখ, কলাসহ রকমারি খাবার। চলল খাবার দাবার পর্ব। ফুটপাথে বসেই খাওয়া দাওয়া শেষ এক বন্ধুর প্রশ্ন কোথায় ময়লা রাখা হবে। অপর একজন বললেন, কেন? রাস্তায় ফেলে দিলেই হয়। আরেকজন হাসতে হাসতে সায় দিলেন। বললেন, সবাই রাস্তায় ময়লা ফেলছে। আমরা কেন নয়। ফেলে দাও কোন অসুবিধা হবে না। যে বন্ধু প্রশ্ন করেছিলেন কোথায় ফেলবেন তার জন্ম বাংলাদেশে। থাকেন বিদেশে। সেখানে তো এমন দৃশ্য নেই। ঢাকার দুই বন্ধুর কথা শুনে চোখ একেবারেই কপালে ওঠার মতো। সেই সঙ্গে প্রশ্নও দেখা দেয় এ কেমন শহর। যে শহরে নাগরিকের যথেচ্ছ মানসিকতা। নগর পরিষ্কার রাখার দায়িত্ব বলতে কি নাগরিকের কিছুই নেই। একটি গল্পের কথা বলা যায়। সেটি এমন চার বন্ধুর বিদেশ যাত্রা। অনেক কষ্ট করে আত্মীয়-স্বজনদের থেকে টাকা জোগাড় করে চার বন্ধু বিদেশ গেলেন। শখের বশেই ভ্রমণ। ভাল কথা। চারজনেই ঢাকার। বিশে^র উন্নত এক শহরে গেলেন তারা। সেখানে পৌঁছানোর পর দিন সকালে চার জন চার দিকে গেলেন নিজেদের লোকদের সঙ্গে দেখা করতে। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত। একজন ফিরলেন। বাকিদের খোঁজ নেই। মহাচিন্তিত একজন বন্ধু। খোঁজ নেয়ারও কায়দা নেই। এক পর্যায়ে হোটেলে টেলিফোন। তিন জনের আর্থিক জরিমানা ও দ-ের খবর এল। একি। এমন তো হওয়ার কথা নয়। কারণ তিন জনেই বিভিন্ন স্থানে খাবার খেয়ে ইচ্ছেমতো রাস্তা নোংরা করেছেন। কেউ কম, কেউ বেশি। যিনি বেশি করেছেন তার উভয় দ-। যিনি কষ্ট করে কম করেছেন তার গুনতে হয়েছে জরিমানা। তিন বন্ধুর খবর শুনে হোটেলে থাকা বন্ধু বলছিলেন, আমাদের ঢাকার রাস্তায় কত কিছু করি। কিচ্ছু হয় না রে। হা হা হা। এটা কোন শহর, কেমন শহরে এলাম। একেবারে বাজে শহর। কঠিন আইন। ভাল লাগেনি। চলে যাব। ওদের একটা বিহিত হলেই চলে যাব। আর আসব না কোনদিন। ময়লা যদি না ফেলা যায় তবে রাস্তা কেন? এত সময় গল্প হলেও রাজধানীর মানুষের ধ্যান-ধারণা একেবারেই সেকেলের। একটুও যেন দায়-দায়িত্ব কারও মধ্যে নেই। যেমন ইচ্ছে তেমনিভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে রাস্তা। শুধু তাই নয়, অভ্যাস গড়তে ঢাকার দুই সিটির পক্ষ থেকে বাসা বাড়ির সামনে পর্যন্ত মিনি ডাস্টবিন লাগানো হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল যত্রযত্র ময়লা না ফেলা। এতে রাস্তাঘাট ভাল থাকবে। শহর হবে পরিচ্ছন্ন। দুঃখ করে বলতে হয়, কদিনের মধ্যে সবকিছু উধাও হয়ে গেছে। নাগরিকদের ভাল রাখতে হাসতে হাসতে রাজা এত আয়োজন করলেন। অথচ সব কিছু ভেস্তে গেল। নাগরিকরা বুঝলেন না এটা তাদের স্বার্থে। ফল হলো উল্টো। হতাশ রাজা তাই নীরবে কাঁদেন। কার জন্য এত ত্যাগ। কষ্ট। অর্থ সংগ্রহ। নগরবিদরা বলছেন, বিশ্বের বিভিন্ন নগরীতে সাধারণ ময়লা ফেলতে মিনি ডাস্টবিন থাকে। নাগরিকরাও ডাস্টবিনের যথাযথ ব্যবহার করেন। ওসব দেশে যত্রতত্র ময়লা ফেলার চিত্র সচরাচর দেখা যায় না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রাস্তায় ফেলে দেয়া কাগজের টুকরো অন্য কেউ তুলে ওসব ডাস্টবিনে রাখার দৃশ্য চোখে পড়ে। এভাবেই গড়ে উঠছে পরিচ্ছন্ন নগর জীবন। যার ধারাবাহিকতায় রাজধানীতেও মিনি ডাস্টবিন প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছিল। ঢাকা দুই সিটি কর্পোরেশনও রাজধানীকে পরিচ্ছন্ন নগরী হিসেবে গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দিয়ে মাঠে নামে। সেই ধারাবাহিকতায়, দক্ষিণ ও উত্তর সিটি কর্পোরেশন নগরজুড়ে বসানো হয় মিনি ডাস্টবিন। তবে অল্প দিনের মধ্যে পুরো প্রকল্পই কার্যত ভেস্তে গেছে। শুরুতেই বেশিরভাগ মানুষ ডাস্টবিন ব্যবহার করেননি। এরপর চোরের উপদ্রব। অনেক বিনে আবর্জনা দিনের পর দিন জমে থাকতে দেখা গেছে। সব মিলিয়ে অল্প দিনের মধ্যেই ঢাকার রাস্তা থেকে হাওয়া প্রায় সব মিনি ডাস্টবিন! শুরু থেকেই এসব ডাস্টবিন চুরি হলেও এর ব্যবহারও হচ্ছিল- একথা অস্বীকারের সুযোগ নেই। প্রশ্ন হলো কেন পুরো প্রকল্পই হারিয়ে গেল। নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইচ্ছেমতো বিন বসানো ও নাগরিক সচেতনতা গড়ে না ওঠা ও চোরের উপদ্রব ঠেকাতে না পারায় বিনগুলো হাওয়া। তবে পরিচ্ছন্ন নগর জীবন গড়ে তুলতে এ ধরনের প্রকল্পের প্রয়োজন রয়েছে। রাজধানীর সবুজবাগ থানার ৫ নং ওয়ার্ডের আহাম্মদবাগের বাসিন্দা মিজানুর জানালেন, আমার বাসার গেটের সামনে একটি বিন বসানো হয়েছিল। আশপাশের বাসা বাড়ির বিভিন্ন বর্জ্য এতে রাখা হতো। কিন্তু নিয়মিত পরিচ্ছন্ন কর্মীরা ময়লা না নেয়ায় দুর্গন্ধ ছড়াত। ভাড়াটিয়ারা এ নিয়ে প্রতিদিনই অভিযোগ করতেন। এক পর্যায়ে আমি বিনটি উল্টো করে রশি দিয়ে বেঁধে রাখি। কয়েকদিন পর দেখি বিনটি নেই। এরপর স্ট্যান্ডগুলোও উধাও হয়ে যায়। মৌচাক এলাকার বাসিন্দা আলাল মিয়া জানালেন, ফুটপাথসহ আশপাশের অলিগলিতে পর্যাপ্ত সংখ্যক বিন বসানো হয়েছিল। এর ব্যবহারও কমবেশি দেখেছি। কিন্তু প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি বিনের সংখ্যা কমছে। এখন তো পুরো এলাকাই বিনশূন্য। বিনে রাখা ময়লা-আবর্জনা ফেলা হচ্ছে রাস্তায়। যে যার মতো ময়লা রাখছেন। সব মিলিয়ে অপরিচ্ছন্ন হচ্ছে রাজধানী। অথচ প্রায় ৪ কোটি টাকা খরচ করে দক্ষিণ সিটি ৫ হাজার ৭০০ ও ৭০ লাখ টাকা খরচ করে উত্তর সিটি এক হাজার মিনি ডাস্টবিন বসানো হয়। সব মিলিয়ে এ প্রকল্পে প্রায় ৬ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছিল। একেকটি ডাস্টবিনের নির্মাণে খরচ হয় সাড়ে ছয় হাজার থেকে ১২ হাজার টাকা। সরেজমিন ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি কর্পোরেশনের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, অলিগলিতে মিনি ডাস্টবিনের কোন চিহ্ন এখন আর নেই। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা কমোডর আবদুর রাজ্জাক শুরুর দিকে বলেছিলেন, স্থাপনের কয়েক দিনের মধ্যে চুরি হয়ে যাওয়ায় কিছু এলাকায় এখন ডাস্টবিন নেই। এগুলো প্রতিস্থাপনের পরিকল্পনা চলছে। চুরি প্রতিরোধের কৌশল নির্ধারণ করে পরবর্তীতে পদক্ষেপ নেয়া হবে। বাস্তবতা হলো, ফার্মগেট থেকে কাওরানবাজার মোড় পর্যন্ত আধা কিমি দূরত্বের ৪৮ বিন বসানো হয়েছিল। এখন বেশিরভাগই গায়েব। আসাদ গেট থেকে টেকনিক্যাল মোড় পর্যন্ত ৯০ বিনের বেশিরভাগই নেই। খিলগাঁও সিটি কর্পোরেশন মার্কেটের ব্যবসায়ী কামাল পাশা জানান, ফুটপাথ ঘেঁষে সড়কের দু’পাশে দোকানপাট হয়েছে। ব্যস্ততম এই সড়কে ফুটপাথ দিয়ে মানুষের চলাচলও অনেক বেশি। বিন থাকায় ময়লা-আবর্জনার দুর্গন্ধ ছড়াত। এতে আমাদের খুব অসুবিধা হতো। ব্যবসায়ীরাই তখন ময়লা রাখতে নিষেধ করেন। তিনি বলেন, বিন স্থাপনের আগে আমাদের কাছে পরামর্শ চাইলে এর সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা কঠিন কোন বিষয় ছিল না। এমন বাস্তবতায় দক্ষিণ ঢাকাকে পরিচ্ছন্ন রাখতে ফুটপাথে আরও দশ হাজার মিনি ডাস্টবিন স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে স্টিলের ডাস্টবিন চুরি হওয়ায় এ ধরনের ডাস্টবিন বসাতে আর আগ্রহী নয় উত্তরের সিটি কর্পোরেশন। নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, জনসচেতনতা তৈরি করা না গেলে এ ধরনের প্রকল্পে শুধু অর্থের অপচয় হবে। ১৬ সালে দক্ষিণ ঢাকার ৫৭টি ওয়ার্ডে বসানো স্টিলের মিনি ডাস্টবিনের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারেনি সিটি কর্পোরেশন। একই চিত্র উত্তরেও। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ক্রয় ও ভা-ার সূত্রে জানা গেছে, মিনি ডাস্টবিনের দুই প্রকল্প বাস্তবায়নের পর এ পর্যন্ত মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ অন্তত ১০ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। এ অবস্থায় ইউনিসেফের সহায়তায় দুই সিটির বস্তি এলাকায় নতুন করে আরও ২০ হাজার বিন বসানোর উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে দৈনিক প্রায় ৬/৭ হাজার টন বর্জ্য তৈরি হয়। সম্প্রতি ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব গবর্নমেন্ট এ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) এক গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকা শহরে কঠিন বর্জ্যরে পরিমাণ বেড়েছে ৬ হাজার ১১০ টন। এর মধ্যে ৩ হাজার ৭০ টন গৃহস্থালি, ১ হাজার ৯৮৩ টন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে এবং ১ হাজার ৫৫৫ টন সড়ক বর্জ্য উৎপাদিত হয়। এসব বর্জ্যরে প্রায় ৭৫ শতাংশ সিটি কর্পোরেশন সংগ্রহ করে। দুই সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগে প্রতিদিন রাস্তায় উৎপাদিত প্রায় এক হাজার ৫৫ টন বর্জ্য যাতে যত্রতত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে না থাকে সেজন্য মিনি ডাস্টবিন বসানো হয়েছিল। নাগরিক সচেতনতার অভাব, স্বেচ্ছাচারিতা, সিটি কর্পোরেশন আইন কঠিন না থাকাসহ নানা কারণে আশা জাগানিয়া কাজটি আর আলোর মুখ দেখেনি।
×