ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

গয়না, লাল বেনারসি সবই আছে-শুধু নেই প্রাণটা

প্রকাশিত: ১১:১৮, ১০ মার্চ ২০২০

গয়না, লাল বেনারসি সবই আছে-শুধু নেই প্রাণটা

মামুন-অর-রশিদ, রাজশাহী ॥ রাজশাহীর পদ্মা নদীতে বিয়ের দুটি নৌকা ডুবির পর গত তিনদিন ধরে একে একে যখন ভেসে উঠছিল শিশুসহ নারী ও পুরুষের লাশ। তখনও খোঁজ মিলছিল না নববধূ সুইটি খাতুন পূর্ণিমার। রবিবার পর্যন্ত আট জনের লাশ উদ্ধারের পর অনেকেই নিরাশ ছিল তার লাশ নিয়ে। স্বজনদের মধ্যে শঙ্কা ছিল সুইটির হয়তো পদ্মায় সলিল সমাধিই হয়ে গেছে। অবশেষে ঘটনার চারদিনের মাথায় ৬০ ঘণ্টা পর নৌকা ডুবির পয়েন্ট থেকে অন্তত ২৫ কিলোমিটার দূরে মিললো নববধূ সুইটির লাশ। এ নিয়ে বিয়ের নৌকা ডুবির ঘটনায় প্রাণ হারাল ৯ জন। সুইটির লাশ উদ্ধারের মধ্যদিয়ে উদ্ধার অভিযানের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়েছে সোমবার। সোমবার সকাল ৭টার দিকে পবা উপজেলার শ্যামপুর ঘাট থেকে নববধূ সুইটি খাতুন পূর্ণিমার লাশ উদ্ধার করে জেলেরা। যখন পদ্মা থেকে উদ্ধার করা হয় নববধূর লাশ তখন সবই ঠিকঠাক। হাতে মেহেদির রং, গায়ে গহনা, পরনে লাল বেনারসি। শুধু দেহটায় ছিল নিথর। জেলেরা জানায়, সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে রাজশাহী নগরীর সাহাপুর এলাকায় শাড়ি-গয়না পরা নববধূর লাশটি ভেসে ওঠে। গত শুক্রবার রাতে নৌকাডুবির পর থেকেই তাকে নিখোঁজ ঘোষণা করা হয়েছিল। এদিকে সকালে নববধূর লাশ উদ্ধারের পর পদ্মাপাড়ের বাতাস ভারি হয়ে উঠে স্বজনদের আহাজারিতে। এ ঘটনায় বেঁচে যাওয়া বর রুমন নব সঙ্গীর লাশ দেখে অনেকটাই নির্বাক হয়ে গেছে। একদিনের সংসার ছিল তাদের। একে অপরকে চেনাও হয়নি। হয়েছে কিছু কথা। আরও কথা বাকি, পরে হবে- এমন করেই হয়তো কেটেছে তাদের সংসারের প্রথম রাত। এর মধ্যেই যেন কত আপন হয়ে গেছে দুজন দুজনার। পরের দিনে কনের বাবার বাড়ি যাওয়ার ব্যস্ততা। মাঝ পথেই দুর্ঘটনা। প্রিয় মানুষটি ফাঁকি দিয়ে নিরুদ্দেশ। এমন সঙ্গীহারা হৃদয় বিদারক ঘটনার সাক্ষী বর আসাদুজ্জামান রুমন। রুমনের মেহেদী রাঙা হাত হয়েছে ধূসর বর্ণের। প্রিয়তমার বাঁধন ছিঁড়ে যাওয়া স্মৃতি পীড়া দিচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। তিনদিন পর বধূ সাজেই ফিরে এলো প্রিয় মানুষটি। তবে নিথর দেহে। পদ্মা পাড়ে প্রিয় মানুষের লাশ দেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন রুমন। রুমন সাংবাদিকদের বলেন, ‘নৌকায় উঠার আগে তার সঙ্গে শেষ কথা হয়। আমার ঘাটে আসার আগেই নৌকায় প্রায় সবাই উঠে গেছে। সুইটির ভগ্নিপতি রতন আলী বললো বউরে (সুইটি) কোলে নিয়ে নৌকায় ওঠো। পূর্ণিমা বলে তুমি থাকো, আমি দুলাভাইয়ের কোলে নৌকায় উঠবো। এটাই শেষ কথা তার সঙ্গে।’ রুমন বলেন, ‘কিছুদূর আসার পরে নৌকা ডুবে যাওয়ার সময় আমি কয়েকজনকে রশি বা ধাক্কা দিয়ে নৌকায় তুলে দিয়েছি। এরপরে একজন বললো সুইটিকে ধর। আমি পেছনে তাকিয়ে আর দেখতে পাইনি সুইটিকে। দুই মাস আগে রুমন ও সুইটির রেজিস্ট্রি বিয়ে হয়। তবে বিয়ের মূল অনুষ্ঠান হয়েছে গত বৃহস্পতিবার। পরের দিন শুক্রবার সন্ধ্যায় বউভাতের আনুষ্ঠানিকতা শেষে পদ্মার চরের খানপুর এলাকা থেকে দুইটি নৌকায় করে পবা উপজেলার ডাইঙ্গেরহাটের উদ্দেশে রওনা দেয় তারা। চরখিদিরপুর ও শ্রীরামপুর এলাকার মাঝ পদ্মায় দুইটি নৌকা ডুবে যায়। এতে ছিল ৩৬ যাত্রী। এর পর যৌথভাবে উদ্ধার অভিযান চালায় দমকল, বিজিবি, নৌ-পুলিশ ও বিআইডব্লিউটিএ ডুবুরি দল। উদ্ধার করা হয় ৯ জনের লাশ। সর্বশেষ উদ্ধার হয় নববধূ সুইটি খাতুন পূর্ণিমার লাশ। এর পর উদ্ধার অভিযান সমাপ্ত ঘোষণা করেন কর্তৃপক্ষ। নিহতের পরিবারকে ২০ হাজার টাকা করে অনুদান দেন জেলা প্রশাসন। রাজশাহীর অতিরিক্ত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক এবং উদ্ধার অভিযানের সমন্বয়ক আবু আসলাম বলেন, সাঁতার জানা সুইটি ভারি কাপড়-চোপড় পরিধান করে থাকায় তলিয়ে যায় পানিতে। ঘটনাস্থল থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে শ্যামপুর ঘাটে সুইটির লাশ ভেসে উঠেছে। লাশটি প্রথমে জেলেরা উদ্ধার করে দমকল কর্মীদের খবর দেয়। পরে তারা গিয়ে লাশ উদ্ধার করে নিয়ে এসে পরিবারের সদস্যদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। একই সঙ্গে উদ্ধার অভিযানও সমাপ্ত করা হয়। প্রসঙ্গত, শুক্রবার সন্ধ্যায় বউভাতের আনুষ্ঠানিকতা শেষে পদ্মার চরের খানপুর এলাকা থেকে দুইটি নৌকায় করে পবা উপজেলার ডাইঙ্গেরহাটের উদ্দেশে রওনা দেয় যাত্রীরা। চরখিদিরপুর ও শ্রীরামপুর এলাকার মাঝ পদ্মায় দুইটি নৌকা ডুবে যায়। এর পর থেকেই যৌথভাবে উদ্ধার অভিযান চালায় দমকল, বিজিবি, নৌ-পুলিশ ও বিআইডব্লিউটিএ ডুবুরি দল। এ ঘটনায় নিহতরা হলেন, কনে সুইটি খাতুন পূর্ণিমা (২০) তার বড় বোন শাহীনুর বেগমের স্বামী রতন আলী (৩০), তাদের মেয়ে মরিয়ম খাতুন (৫), চাচা শামীম হোসেন (৩৫), চাচি মিনা খাতুন (৩০), চাচাত বোন রশ্নি (৭), খালাত ভাই এখলাস আলী (২২), কনের ফুপাত বোন রুবাইয়া খাতুন স্বর্ণা (১২) ও খালা আঁখি খাতুন (২৫)।
×