ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মাদকবিরোধী অভিযানে ভাটা

ইয়াবার চালান ঠেকানো যাচ্ছে না, বেপরোয়া চোরাকারবারিরা

প্রকাশিত: ১১:১৭, ১০ মার্চ ২০২০

ইয়াবার চালান ঠেকানো যাচ্ছে না, বেপরোয়া চোরাকারবারিরা

শংকর কুমার দে ॥ সর্বনাশা মরণ নেশা ইয়াবা আসছেই। কিছুতেই ঠেকানো যাচ্ছে না ইয়াবার চালান। ইয়াবা চোরাকারবারিরা বেপরোয়া। সারাদেশে গত দুই বছরে ইয়াবা কারবারির বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের সময় বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে ছোটবড় চার শতাধিক মাদক কারবারি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের জালে আটকা পড়েছে পাঁচ হাজারের বেশি। গত দুই বছরে আটক করা হয়েছে প্রায় আট কোটি ইয়াবা, যার বাজারমূল্য দেড়শ’ কোটি টাকা। এই বিষয়ে মামলা হয়েছে প্রায় বিশ হাজার। তবু ঠেকানো যাচ্ছে না ইয়াবার চালান। দেশে নিয়মিতই ঢুকছে সর্বনাশা মাদক ইয়াবা। ইয়াবা মাদকবিরোধী অভিযানে আগের মতো ক্ষিপ্রতা নেই, অনেকটাই ভাটার টান পড়েছে, এমনটাই তথ্য পাওয়া গেছে। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে এ খবর জানা গেছে। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, ইয়াবা মাদক কারবারিদের আত্মসমর্পণের পর ধারণা করা হয়েছিল, এই অপরাধী চক্রের নেটওয়ার্ক ভেঙে যাবে। বন্ধ হবে ইয়াবা আসাও। কিন্তু সে আশায় গুড়ে বালি। আত্মসমর্পণের দিন থেকে অদ্যাবধি প্রতিদিনই ইয়াবা ধরা পড়ছে। শুধু কক্সবাজার জেলায় পুলিশের তালিকাভুক্ত ইয়াবা কারবারির সংখ্যা ১ হাজার ১৫১। কিন্তু তালিকার বাইরেও হাজারখানেক ইয়াবা কারবারি চক্র সক্রিয়। তাদের রসদ জোগাচ্ছে গডফাদাররা। এই চক্রের কেউ আত্মসমর্পণ করেনি। এটাকে ইয়াবা কারবার বন্ধ না হওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ মনে করা হচ্ছে। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশের ৮০ লাখ মাদকসেবীর মধ্যে ৭০ লাখই ইয়াবায় আসক্ত। এগুলো বর্তমানে সর্বনিম্ন ১৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সে হিসাবে বলা যায়, ইয়াবা ঘিরে দেশে ১৪ হাজার কোটি টাকার অবৈধ লেনদেন হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জোরদার অভিযান ও ‘বন্দুকযুদ্ধে’র কারণে ১০২ ইয়াবা কারবারি এক বছর আগে ২০১৯ সালে টেকনাফ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে অস্ত্র, ইয়াবাসহ আত্মসমর্পণ করে। আত্মসমর্পণের পর তাদের কারাগারে পাঠানো হয়। তারা এখন কক্সবাজার জেলে। পুলিশের তালিকাভুক্ত ১ হাজার ১৫১ ইয়াবা কারবারির মধ্যে নিয়ন্ত্রণকারী বা গডফাদার আছে ৭৩ জন। গডফাদারদের মধ্যে আত্মসমর্পণ করেছে ৩০ জন। ৪৩ জন এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে। গত বছরের ৪ মে থেকে দেশজুড়ে মাদকবিরোধী অভিযানে বন্দুকযুদ্ধে শুধু কক্সবাজারেই ৫৩ জনের মৃত্যু হয়। তারপরও গডফাদার ছাড়া শুধু তালিকাভুক্ত অধরা কারবারিই আছে এক হাজারের মতো। এই তালিকার বাইরে নতুন অনেক ব্যবসায়ী তৈরি হয়েছেন, যারা গোপনে ইয়াবা কারবার চালিয়ে যাচ্ছেন। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, টেকনাফে ২০১৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি যেদিন ইয়াবা কারবারিরা পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করে সেদিনই জেলার তিনটি স্থান থেকে ৫ লাখ ৬০ হাজার ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। এরপর টেকনাফের নাজিরপাড়া থেকে বিজিবি ২০ হাজার ইয়াবা উদ্ধার করে। এর আগেরদিন র‌্যাব উদ্ধার করে ৪০ হাজার ইয়াবা। তার আগের দিন রামুর পাহাড় থেকে উদ্ধার হয় ৪ লাখ ৪০ হাজার এবং সমুদ্রের নৌকা থেকে পাওয়া যায় ১ লাখ ইয়াবা। যেসব গডফাদার বাইরে আছে, তারাই ইয়াবা চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ করছে বলে পুলিশের দাবি। পুলিশ সদর দফতরের এক কর্মকর্তা বলেন, ইয়াবা কারবারির বিষয়ে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াত কোন ভেদাভেদ নেই, সবাই কাঁচা টাকা কামানোর ক্ষেত্রে রসুনের কোয়া। ইয়াবা কারবারিদের তালিকায় যাদের নাম আছে তারা রাজনৈতিক দলের অনেক নেতা-কর্মী আছেন। কিন্তু এই অভিযানে তাদের গায়ে হাত পড়েনি। আবার তারা আত্মসমর্পণও করেননি। রাজনৈতিক পরিচিতি থাকার সুবাদে তারা দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। এতে যেমন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ আছে, তেমনি বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতের নেতাকর্মীও আছেন। রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীর পরিচয়ের বাইরে আছেন এমপি থেকে শুরু করে পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদের জনপ্রতিনিধি। তারা আত্মসমর্পণ করেননি। এ অবস্থায় ইয়াবা বন্ধ হবে এমন আশা করাটা দুরাশা মাত্র। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, ইয়াবাসহ সর্বনাশা মাদকের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স নীতি’ ঘোষণা করে সরকার। নিয়মিত অভিযান, গ্রেফতার, ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মাদক কারবারিদের প্রাণ হারানোর ঘটনার পরও গত দুই বছরে ইয়াবা উদ্ধারের পরিমাণ আগের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। এই মাদক আসছে মিয়ানমার থেকে কক্সবাজারের টেকনাফ হয়ে। ইয়াবা পাচারের রুট পরিবর্তন করে কখনও সমুদ্র দিয়ে, কখনও আকাশপথে পাচার করছে। ঘন ঘন রুট পরিবর্তন উদ্বেগজনক। গত ২ বছরে ১২৩ জন মাদক ব্যবসায়ী এখানে আত্মসমর্পণ করেছে। অন্যদের ধরতেও নিয়মিত অভিযান চালানো হচ্ছে। বেসরকারী সংস্থা আইন ও শালিস কেন্দ্র বলছে, ২০১৮ সাল থেকে পরিচালিত মাদকবিরোধী অভিযানে অন্তত ৪০০ জন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন, গ্রেফতার হয়েছেন পাঁচ হাজার। নিহতদের মধ্যে ২১১ জন কক্সবাজারের ইয়াবা কারবারি ছিলেন, যাদের মধ্যে আবার ৬২ জন মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা। আর যারা গ্রেফতার হয়েছেন, তাদের মধ্যে কেবল কক্সবাজার থেকেই পাকড়াও হয়েছেন দুই হাজার ৩৮৮ জন। এ সময় তাদের কাছে মিলেছে প্রায় এক কোটি ৭০ লাখ ইয়াবা। এত কিছুর পরও গত দুই বছরে দেশে প্রায় ৮ কোটি পিসের মতো ইয়াবা উদ্ধার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
×