ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর আলোর মুখ দেখছে

প্রকাশিত: ১১:১৬, ১০ মার্চ ২০২০

মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর আলোর মুখ দেখছে

ওয়াজেদ হীরা ॥ অবশেষে আলোর মুখ দেখতে যাচ্ছে চট্টগ্রামের মহেশখালীর মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্প। ক্রমবর্ধমান আমদানি-রফতানি পণ্যের হ্যান্ডলিং বাড়ানো এবং চট্টগ্রাম বন্দরের চাপ কমাতে এই উদ্যোগ নেয় সরকার। মাস্টারপ্ল্যান তৈরির প্রায় পাঁচ বছর পর ১৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে এই মেগাপ্রকল্প অনুমোদনের জন্য উঠতে যাচ্ছে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায়। অনুমোদন পেলে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে। পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানিয়েছে, আজ মঙ্গলবারের সভায় এটি উঠতে পারে। বিষয়টি নিয়ে পরিকল্পনা সচিব মোঃ নুরুল আমিন জনকণ্ঠকে বলেন, মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্পটি একনেকের মঙ্গলবারের তালিকায় রাখা আছে। এটিসহ আরও সাতটি প্রকল্প আছে বলে জানান তিনি। ইতোমধ্যেই একনেকে উঠানোর আগে পিইসি সভাসহ অন্যান্য সমস্ত প্রক্রিয়াও শেষ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। জানা গেছে, বর্তমানে দেশে যে কয়টি সমুদ্রবন্দর রয়েছে তার কোনটিই তেমন গভীর নয়। চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর অনেক বড় হলেও তেমন গভীর নয়। তাই বড় জাহাজগুলো বন্দরের জেটিতে ভিড়তে পারে না। ফলে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের অগ্রগতির জন্য এই গভীর সমুদ্রবন্দর তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৭ হাজার ৭শ’ ৭৭ কোটি ১৬ লাখ টাকা। এটি বাস্তবায়ন করবে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বর্তমানে দেশে যে কটি সমুদ্রবন্দর রয়েছে তার কোনটিই গভীর সমুদ্রবন্দর নয়। ফলে ডিপ ড্রাফটের ভেসেল এসব বন্দরের জেটিতে ভিড়তে পারে না। তাই ডিপ ড্রাফট ভেসেলের জেটি সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য মাতারবাড়িতে সমুদ্রবন্দর নির্মাণ বিষয়ে অগ্রাধিকারমূলক প্রকল্প নেয়া হয়। চলতি বছরের শুরুর দিকে কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়িতে গভীর সমুদ্রবন্দর এলাকা পরিদর্শন করেন নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। সে সময় তিনি মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ বর্তমান সরকারের বিশাল অর্জন বলে মন্তব্য করেন। নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী জনকণ্ঠকে বলেন, এটি আমাদের বিশাল অর্জন, আমরা গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ যুগে প্রবেশ করেছি। দীর্ঘদিন এজন্য প্রক্রিয়াধীন ছিল। জাইকা সার্ভে করেছে এবং এ বিষয়ে তাদের রিপোর্টে তুলে ধরেছে। একনেক সভায় পাস হওয়ার পর দ্রুত কাজ শুরু হবে। এটি আমাদের বিশাল অর্জন, আমরা গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ যুগে প্রবেশ করেছি। দেশের জন্য এটি হবে ঐতিহাসিক বিষয়। টার্মিনাল হলে বড় বড় জাহাজ আসবে, এক লাখ টন সম্পন্ন জাহাজ আসবে। সমুদ্রপথে আকর্ষণীয় ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হবে এটি। নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, এর মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্যে অর্থনীতিতে গতি তো আসবেই পাশাপাশি আমাদের আঞ্চলিক বাণিজ্যিক সম্ভাবনা বাড়বে। আমরা প্রায়ই বলি দেশ হবে সিঙ্গাপুর। এর মাধ্যমে মাতারবাড়ি হবে সিঙ্গাপুর বলেন তিনি। ২০১৬ সালে জাইকা একটি মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করে যাতে মাতারবাড়িতে কয়লা বিদ্যুত কেন্দ্র ও গভীর সমুদ্রবন্দরের সম্ভাবনার কথা বলা হয়। জাপানের কাশিমা ও নিগাতা (পূর্ব) নামের দুটি বন্দরের আদলে গড়ে তোলা হবে দেশের প্রথম এ গভীর সমুদ্রবন্দর। এ বন্দরে থাকবে একটি কনটেইনার টার্মিনাল ও একটি মাল্টিপারপাস টার্মিনাল। বন্দরটিতে ভিড়তে পারবে ১৬ মিটার গভীরতার জাহাজ। এ বন্দর চালু হলে একদিকে দেশের ক্রমবর্ধমান আমদানি-রফতানি পণ্যের হ্যান্ডলিং বাড়বে, অন্যদিকে চাপ কমবে চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর। জাইকার সার্ভে অনুযায়ী চট্টগ্রাম বন্দরে একটি জাহাজ সর্বোচ্চ ২ হাজার টিইইউএস কন্টেনার নিয়ে ভিড়তে পারে। অথচ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের কলম্বো, জহরলাল নেহেরু, করাচী ও চেন্নাই বন্দরে তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন জাহাজ ভিড়তে পারে। এ মাতারবাড়িতে অধিক ড্র্রাফটের জাহাজের সমুদ্রবন্দর নির্মাণ কন্টেনার পরিবহনে বাংলাদেশের জন্য উত্তম বিকল্প। মাতারবাড়ি সমুদ্রবন্দরে ৩০০ ও ৪৬০ মিটার দৈর্ঘ্যরে দুটি টার্মিনাল থাকবে। এসব টার্মিনালে ১৬ মিটার ড্রাফটের ৮ হাজার টিইইউএস কন্টেনারবাহী জাহাজ ভিড়তে পারবে। চট্টগ্রাম বন্দরে ১৯০ মিটার দৈর্ঘ্যরে এবং ৯ দশমিক ৫ মিটার ড্রাফটের বেশি জাহাজ ভিড়তে পারে না। যার ফলে মাদার ভেসেলগুলো বন্দরের জেটিতে আসতে পারে না। ফলে ফিডার জাহাজে করে কন্টেনার আনা-নেয়া করতে হয়। প্রতিদিন ৩৫০০ থেকে ৩৮০০ টিইইউএস আমদানি পণ্য কন্টেনার হ্যান্ডলিং হয়ে থাকে। মাতারবাড়ি সমুদ্রবন্দরের ১৬ মিটার গভীরতার জন্য মাদার ভেসেল ভেড়ার সুযোগ থাকায় একসঙ্গে ৮ হাজার কন্টেনারবাহী জাহাজ ভিড়তে পারবে। এর ফলে এখান থেকে ফিডার ভেসেলের মাধ্যমে দেশের অন্যান্য বন্দরে কন্টেনার পরিবহনের সুযোগ সৃষ্টি হবে। পরিকল্পনা কমিশনের একাধিক কর্মকর্তা জানান, প্রকল্পটি প্রস্তাব পাওয়ার পর ২০১৯ সালের ৯ সেপ্টেম্বর প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় দেয়া সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) পুনর্গঠন করা হয়েছে। ফলে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির মঙ্গলবার (একনেক) সভায় উপস্থাপন করা হবে বলে জানা গেছে। প্রকল্পের মূল কার্যক্রম হচ্ছে, বহুমুখী টার্মিনাল ও কন্টেনার টার্মিনাল নির্মাণ, কার্গো হ্যান্ডলিং যন্ত্রপাতি ক্রয়, প্রাসঙ্গিক সুবিধার ব্যবস্থা এবং সরঞ্জাম ক্রয়, সংযোগ সড়ক নির্মাণ এবং পরামর্শক সেবা দেয়া হবে।
×