ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

পলাশ-শিমুল

প্রকৃতির রূপকন্যা যেন অভিমানী, গুটিয়ে নিচ্ছে নিজেকে ...

প্রকাশিত: ১১:১৫, ১০ মার্চ ২০২০

প্রকৃতির রূপকন্যা যেন অভিমানী, গুটিয়ে নিচ্ছে নিজেকে ...

বিশ্বজিৎ মনি ॥ উপ-মহাদেশের প্রখ্যাত শিল্পী লতা মুঙ্গেশকরের গাওয়া ‘ও পলাশ ও শিমুল আমার এই মন তুমি রাঙ্গালে’ গানটি আজও বাঙালীর মনে দাগ কাটে। শীতের পরেই ঋতুরাজ বসন্ত আগমনের সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতিতে লেগে যায় এই পলাশ-শিমুলের ছোঁয়া। সেই সঙ্গে বাঙালীর হৃদয়ে দোলা দিয়ে যায় গানটি। এসময় প্রতিটি গাছেই আসতে শুরু করে নতুন পাতা। প্রকৃতিতে দক্ষিণা বাতাসে আ¤্রমুকুলের ম ম ঘ্রাণে মুগ্ধ চারদিক। কোকিলের সুমিষ্ট কুহুতানে ফাগুনের উত্তাল বাসন্তী হাওয়া দিচ্ছে দোলা। গাছে গাছে জেগে উঠেছে সবুজ পাতা। আমের মুকুল, পলাশ আর শিমুল ফুল দেখে বোঝা যায় শীত বিদায় নিয়ে এসেছে ফাগুন। ঋতুরাজ বসন্তের আগমনে আবহমান গ্রামবাংলার প্রকৃতিকে রাঙিয়ে ফুটে ওঠে নয়নাভিরাম পলাশ আর শিমুল ফুল। কিন্তু কালের বিবর্তনে নওগাঁ জেলার বিভিন্ন উপজেলায় আগুন ঝরা ফাগুনে চোখ ধাঁধানো গাঢ় লাল রঙের অপরূপ সাজে সজ্জিত পলাশ আর শিমুল গাছ এখন বিলুপ্তপ্রায়। বিগত এক-দেড় যুগ আগেও জেলার বিভিন্ন গ্রামের অধিকাংশ বাড়ির আনাচে কানাচে আর রাস্তার ধারে প্রচুর শিমুল গাছ দেখা যেত। তেমনি দেখা যেত পলাশ গাছ। প্রতিটি গাছে গাছে প্রস্ফুটিত পলাশ আর শিমুল ফুলই স্মরণ করিয়ে দিত বসন্ত এসে গেছে। পলাশ আর শিমুল গাছের শাখাগুলো বসন্তের আগমনে লাল শাড়ির ঘোমটা পরা গ্রাম্য নববধূর সাজে সজ্জিত হতে দেখা যায়, যা দর্শনে হতাশ প্রেমিকের মনেও জাগিয়ে তোলে আশা। অন্যান্য গাছের তুলনায় শিমুল গাছ অনেক উঁচু হওয়ায় বহু দূর থেকে এ মনোরম দৃশ্য চোখে পড়ে। জোয়ার এনে দেয় কবির কল্পনার জগতে। কেবল সৌন্দর্যই বিলায় না শিমুল গাছের রয়েছে নানা উপকারিতা ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব¡। জানা যায়, প্রাকৃতিকভাবে তুলা আহরণের অন্যতম অবলম্বন শিমুল গাছ। এ গাছের সব অংশেরই রয়েছে ভেষজ গুণ। আয়ুর্বেদিক চিকিৎসকরা এখনো নানা রোগের চিকিৎসায় এ গাছের বিভিন্ন অংশ ব্যবহার করে। শিমুল গাছের বৈজ্ঞানিক নাম ‘বোমবাক্স সাইবা লিন’। এটি বোমবাকাসিয়াক পরিবারের উদ্ভিদ। বিজ ও কা-ের মাধ্যমে এর বংশবিস্তার হয়। রোপণের ৫-৬ বছরের মধ্যে শিমুল গাছে ফুল ফোটে। ৯০ থেকে ১০০ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়। সেই তুলনায় বেশ মোটাও হয়। নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করে শিমুল গাছ দেড় শ’ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকে। শীতের শেষে পাতা ঝরে পড়ে। বসন্তের শুরুতেই গাছে ফুল ফোটে। আর এ ফুল থেকেই হয় ফল। চৈত্র মাসের শেষের দিকে ফল পুষ্ট হয়। বৈশাখ মাসের দিকে ফলগুলো পেকে শুকিয়ে গিয়ে বাতাসে আপনা আপনিই ফল ফেটে প্রাকৃতিকভাবে তুলার সঙ্গে উড়ে উড়ে দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে পড়া বিজ থেকেই এর জন্ম হয়। অন্যান্য গাছের মতো এ গাছ কেউ শখ করে লাগায় না। নেয়া হয় না কোন যতœ। অযতœ আর অনাদরে প্রাকৃতিকভাবেই গাছ বেড়ে ওঠে। এ গাছের প্রায় সব অংশই কাজে লাগে। এর ছাল, পাতা ও ফুল গবাদিপশুর খুব প্রিয় খাদ্য। বালিশ, লেপ ও তোশক তৈরিতে শিমুল তুলার জুড়ি নেই। অথচ বর্তমানে মানুষ এ গাছকে তুচ্ছ মনে করে কারণে অকারণে কেটে ফেলছে। খড়ি হিসেবে বিক্রি করছে ইটভাঁটিতে। অতীতে ব্যাপকহারে নির্মাণ কাজ, টুথপিকসহ নানা ধরনের প্যাকিং বাক্স তৈরি ও ইটভাঁটির জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার হলেও সেই তুলনায় রোপণ করা হয়নি। ফলে আজ বিলুপ্তির পথে। শিমুল গাছ উজাড় হওয়ার ফলে পরিবেশের ওপরে পড়েছে নেতিবাচক প্রভাব। এ গাছ অনেক উঁচু হওয়ায় কাক, কোকিল, চিল, বকসহ বিভিন্ন ধরনের পাখি বাসা বেঁধে বসবাস করত। এ গাছ উজাড় হওয়ার ফলে এসব পাখিরা আবাসস্থল হারিয়ে পড়েছে অস্তিত্ব সঙ্কটে। গাছ না থাকায় আবাসস্থলের অভাবে ধীরে ধীরে এসব পাখিরাও হারিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে এই শিমুল গাছ রক্ষায় এখনই কোন ব্যবস্থা না নিলে এক সময় উপকারী গাছের তালিকা থেকে এ গাছটি হারিয়ে যাবে। ভবিষ্যত প্রজন্ম হয়তো জানতেও পারবে না বাংলার মাটিতে শিমুল বা পলাশ নামের কোন গাছ ছিল।
×