ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

দাম্পত্য অশান্তির শিকার

প্রকাশিত: ০৮:৫৫, ১০ মার্চ ২০২০

দাম্পত্য অশান্তির শিকার

রাজধানীর খিলগাঁওয়ের মোল্লা ভবনের একটি ফ্ল্যাটে শুক্রবার সংঘটিত ঘটনাটি যেমন মর্মান্তিক, তেমনি হৃদয়বিদারক। ১২ ও ৭ বছর বয়সী দুই শিশু কন্যাকে একজন মা গলা কেটে শুধু হত্যাই করেননি, তাদের আগুনে পুড়িয়ে দেয়ারও চেষ্টা করেছেন। এরপর নিজের শরীরে আগুন লাগিয়ে চেষ্টা করেছেন আত্মহত্যার। সম্ভবত নিজ সন্তানসহ নিজে এই সমাজ-সংসার থেকে মুক্তি অর্থাৎ জ্বালা-যন্ত্রণা নিবারণের নিমিত্ত এই হত্যাকা-। ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ বঁটিসহ একটি সুইসাইডাল নোট উদ্ধার করেছে। শরীরের প্রায় বিশ ভাগ অগ্নিদগ্ধ সন্তানঘাতী মা বর্তমানে তীব্র যন্ত্রণায় ছটফট করছেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের বার্ন ইউনিটে। বর্তমানে জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে একজন মায়ের বেঁচে থাকার আকুতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নিজ হাতে দুই সন্তানকে পৈশাচিকভাবে হত্যার মর্মন্তুদ স্মৃতি। মহিলার চিরকুটে এবং আত্মীয়স্বজনের ভাষ্যে জানা যায়, তীব্র অর্থ সঙ্কটে ভুগছিলেন তিনি। স্বামী ব্যবসার সূত্রে থাকতেন মুন্সীগঞ্জে। কালেÑভদ্রে আসতেন ঢাকায়। ঠিকমতো টাকা-পয়সা দিতেন না সন্তানদের লেখাপড়া ও সংসার চালানোর জন্য। মনোমালিন্য চলছিল দীর্ঘদিন থেকে। শোনা যাচ্ছিল বিচ্ছেদের কথাও। আত্মীয়স্বজনদের কাছ থেকেও তেমন সাহায্য-সহযোগিতা ও সহানুভূতি পাওয়া যাচ্ছিল না। অতঃপর নিতান্ত বাধ্য হয়েই মহিলা বেছে নিয়েছেন সমাজ-সংসার থেকে পরিত্রাণের পথ। তাই হয়ত নিজ হাতে সন্তানদের হত্যা করে নিজে আত্মহত্যার মাধ্যমে জ্বালা-যন্ত্রণা জুড়াতে চেয়েছিলেন। অনুরূপ ঘটনা ঘটেছে মাগুরায়, ৩ বছরের কন্যা সন্তানকে ভবিষ্যত অনিশ্চিত ভেবে হত্যা করেছেন এক মা। কিন্তু প্রশ্ন, এভাবে কি আদৌ মুক্তি সম্ভব? ঘটনাটি যতই মর্মান্তিক ও হৃদয়বিদারক হোক না কেন তা নানা দিক থেকে নানাভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখা যেতে পারে। বিষাদ সিন্ধুর রূপকার মীর মশাররফ হোসেন আক্ষেপ করে লিখেছেন, এ জগতে অর্থই যত অনর্থের মূল। মহিলা তীব্র অর্থকষ্টে ভুগছিলেন। সন্তানদের লেখাপড়াসহ সংসার চালাতে গিয়ে রীতিমতো বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন তিনি। স্বামী ছাড়াও অন্য কারও কাছ থেকে সহায়তা পাচ্ছিলেন না। অনিশ্চিত ও অনাগত ভবিষ্যত ভেবে তিনি রীতিমতো দিশাহারা হয়ে পড়েছিলেন। যে কারণে নিজ হাতে দুই সন্তানকে নৃশংসভাবে হত্যার পর নিজে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করেছেন আত্মহত্যার মাধ্যমে। সন্তানের প্রতি মায়ের চিরকালীন অপত্য ¯েœহ তাকে নিষ্ঠুর-নির্মম হতে বাধা দেয়নি একটুও। স্বীকার করতে হবে যে, আমাদের দেশ ও সমাজে পারিবারিক অশান্তি- উপদ্রব বাড়ছে দিন দিন। তুচ্ছ বিষয়ে দাম্পত্য কলহ, পারস্পরিক সন্দেহ-অবিশ্বাস, পরকীয়া, একাধিক বিবাহ, বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক, জমিজমা সংক্রান্ত বিবাদ, আত্মীয়স্বজনদের ইন্ধন ইত্যাদি নানাভাবে পারিবারিক ও দাম্পত্য সম্পর্কে অশান্তি ও উপদ্রব সৃষ্টি করে। আর এরই বহির্প্রকাশ ঘটে থাকে স্বামী কর্তৃক স্ত্রী হত্যা, স্ত্রী কর্তৃক স্বামী হত্যা, স্বামী-স্ত্রী দু’জন অথবা একজন কর্তৃক নিষ্ঠুরভাবে সন্তান হত্যার মাধ্যমে। অন্যদিকে বিপথগামী সন্তান কর্তৃক বাবা-মাকে হত্যার উদাহরণও মেলে। তদুপরি, জমিজমা সংক্রান্ত মামলায় প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে গিয়ে পিতা কর্তৃক পুত্রকে নৃশংস ও নিষ্ঠুরভাবে হত্যার ঘটনাও ঘটেছে। এ থেকে পরিত্রাণের উপায় খুঁজে বের করতে হবে সমাজবিজ্ঞানী ও সংশ্লিষ্টদের। শিশুর প্রতি সহিংসতার মাত্রা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এক বছরের ব্যবধানে শিশুর প্রতি সহিংসতা বেড়েছে ২০ শতাংশ। ২০১৯ সালে ৩ হাজার ৬৫৩ শিশু বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন ও সহিংসতার শিকার হয়েছে। প্রতিমাসে গড়ে নির্যাতনের শিকার হয়েছে ৪৫৭ শিশু। আগের বছরে প্রতিমাসে শিশু নির্যাতনের সংখ্যা ছিল ৩৮১। এর পাশাপাশি বাড়ছে শিশু ধর্ষণ ও হত্যা। শিশু নির্যাতন, ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনাকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়ে দ্রুত সময়ে বিচার কার্যক্রম সম্পন্ন করার পাশাপাশি শিশু নির্যাতন বন্ধে জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণের পরামর্শ দিয়েছেন সংসদ সদস্যসহ বিভিন্ন বেসরকারী সংস্থার প্রতিনিধিরা। তারা শিশু আইন-২০১৩ বাস্তবায়ন, ২০২৫ সালের মধ্যে শিশুশ্রমমুক্ত দেশ গড়ার নতুন কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন এবং বাল্যবিবাহ রোধে প্রণীত আইন, নীতিমালা ও জাতীয় পরিকল্পনার সঠিক বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন সমাজবিজ্ঞানীকে। শিশু নির্যাতন রোধে ঐতিহ্যসম্মত পারিবারিক, সামাজিক ও ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলাও বাঞ্ছনীয়।
×