ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

লালনের আখড়াবাড়িতে দৃষ্টিনন্দন একতারা, আজ ভাঙ্গছে সাধুরহাট

প্রকাশিত: ১২:১০, ৯ মার্চ ২০২০

 লালনের আখড়াবাড়িতে  দৃষ্টিনন্দন একতারা, আজ ভাঙ্গছে সাধুরহাট

এমএ রকিব কুষ্টিয়া থেকে ॥ ‘একতারা’। তারের মধ্যে মনের আকুতি, হৃদয়ের অভিব্যক্তি। তারের মধ্যে সুর ঝঙ্কারে বিলাপ অনুভূতি। মনের আকুতিতে সমাজের জঞ্জাল দূর করার চেষ্টা। যা মানবতা ও নৈতিকতার চেষ্টা হিসেবে আদি সময় হতে আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছেন বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহ। সেই থেকেই বাউল গানের অপরিহার্য বাদ্যযন্ত্র হয়ে রয়েছে এই ‘একতারা’। বাউল ছাড়া যেন বাদ্যযন্ত্রটি অন্য কোন শিল্পীর হাতে একেবারেই বেমানান। তিনি যতগুণী শিল্পীই হোন না কেন। এবার লালন ‘দোল পূর্ণিমা’ উৎসবে দূর-দূরান্ত থেকে আসা দর্শনার্র্থীদের নজর কাড়ে ভাস্কর্য দৃষ্টিনন্দন এই একতারা। অনেক দর্শনার্থীই একতারাটির পাশে দাঁড়িয়ে নিজেদেরকে করেছেন ক্যামেরাবন্দী। তুলছেন বিভিন্ন ভঙ্গিতে ‘সেলফি’। এদিকে আজ সোমবার বিকেলে ‘অষ্টপ্রহর সাধুসংঘ’ বা ‘পূর্ণ সেবা’ গ্রহণের মধ্য দিয়ে শেষ হচ্ছে সাধুদের দেড় দিনের মূল উৎসব। ভেঙ্গে যাচ্ছে সাধুরহাট। এরপর গুরু, শিষ্য, ভক্ত ও সেবাদাসীদের সঙ্গে নিয়ে সাঁইজির পুণ্যভূমি কুষ্টিয়ার বারামখানা ত্যাগ করবেন সাধুরা। তবে কেউ কেউ আবার থেকে যাবেন মঙ্গলবার শেষ দিন পর্যন্ত। সোমবার ভোরে গোষ্ঠী গানের মধ্য দিয়ে শুরু হয় বাউলদের দ্বিতীয় দিনের আচার অনুষ্ঠান। এরপর চলতে থাকে দিনব্যাপী পরবর্তী কার্যক্রম। ‘একতারা’ আজ বাংলার লোকজ এক বাদ্যযন্ত্র। একটি তারবিশিষ্ট বলেই এটি একতারা নামে অভিহিত। তবে একতারা আবিষ্কারের ইতিহাস সুনির্দিষ্টভাবে জানা না গেলেও ধারণা করা হয় অন্তত ১০০০ বছর ধরে এই বাদ্যযন্ত্রটি ব্যবহার হয়ে আসছে। তবে অনেক বাউল শিল্পীই মনে করেন, সাধক লালন শাহের কালেই জন্ম একতারার। তাদের ধারণা, ফকির লালন শাহ তার মনের ভেতর উদয় হওয়া কথাগুলো ভক্তদের মধ্যে প্রচারের সময় কথাগুলো আরও মধুময় করে তোলার জন্য কথার ভাঁজে ভাঁজে তালের অনুভব থেকেই একতারার জন্ম। তবে জন্ম যখনই হোক না কেন, আমাদের দেশীয় সংস্কৃতির স্বকীয়তা আর ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় এই বাদ্যযন্ত্রটি অকৃত্রিমভাবে বহমান রয়েছে একতারা নামে। যন্ত্রটির বাদন ভঙ্গি আর সুরের মূর্ছনায় আজও খুঁজে পাওয়া যায় মাটির ঘ্রাণ। আর এই বাদ্যযন্ত্রটি দিয়ে বাউল-সাধকরা সুরের যে বৈচিত্র্য ফুটিয়ে তোলেন তা সত্যিই বিস্ময়কর। জীবন কাব্যকে লৌকিক মন্ত্রে আবদ্ধ করে সাধন ও সিদ্ধির মাধ্যমে উপায় খুঁজতে লালনের একতারা সব সময় মানুষের মনে প্রাচুর্যের স্পর্শ করে গেছে। কালের প্রবাহে তাই ভাব শক্তির বিদ্রোহে এখনও এই একতারা সুরের শক্তিতে উপায়ক বিষয় হিসেবে লালন গানে ভাব এবং ভক্তিকে সংরক্ষণ করে চলেছে। ‘এখনও একতারা’য় লালন কথা কয়’ অনেকে অনেক বলে, সব কথা কি রাখা যায়’ লালন ছিলেন জ্ঞানের পাখি, গানের পাখি, গান শুনিয়ে করত সুখী’ একতারা হাতে বাউল শিল্পীর এমন গানই বলে দেয় ফকির লালন শাহের কাছে একতারা ছিল কত প্রিয়। একতারা হাতে তিনি দরাজ কণ্ঠে গানের সুর তুলতেন। লালন ফকিরের সেই স্মৃতিকে ধরে রাখতেই একতারার আদলে এবার কুষ্টিয়ায় তারই আঁখড়াবাড়ি চত্বরে স্থাপন করা হয়েছে দৃষ্টিনন্দন বড় আকৃতির ভাস্কর্য ‘একতারা’। কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসন ও লালন একাডেমির উদ্যোগে স্থাপিত দৃষ্টিদনন্দন এই একতারা এবার লালন স্মরণোৎসবে দূর-দূরান্ত থেকে আসা দর্শনার্র্থীদের নজর কাড়ে। বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহ পাকা লাউয়ের ‘বস’ দিয়ে তৈরি একতারা হাতেই গান গাইতেন। তাইতো বাউল গানের বিশেষ করে লালনের গানের অন্যতম অনুষঙ্গ একতারাটি মাজারের ঠিক সামনেই স্থাপন করা হয়েছে। বিশাল আকৃতির এই একতারাটি নির্মাণের ফলে মাজারের সৌন্দর্য্য যেমনি বেড়েছে; তেমনি দূর-দূরান্ত থেকে আসা দর্শনার্র্থীদের কাছেও পেয়েছে বিশেষ গুরুত্ব। অনেক দর্শনার্থীই ভাস্কর্য এই একতারার পাশে দাঁড়িয়ে ক্যামেরাবন্দী করছেন নিজেদের ছবি। তুলছেন বিভিন্ন ভঙ্গিতে ‘সেলফি’। মাজারে প্রবেশ করতে প্রথমেই দর্শনার্থীর চোখে পড়ে লালনের এই একতারা। লালন একাডেমি সূত্র জানায়,‘ জেলা প্রশাসক ও লালন একাডেমির সভাপতি আসলাম হোসেনের পরিকল্পনায় উদ্যোগ নিয়ে মাজারের সামনে গত ডিসেম্বরে শুরু হয় ভাস্কর্য একতারা নির্মাণের কাজ। পুরো কাঠামোটি কংক্রিটের ঢালায় দিয়ে তৈরি। মাঠি থেকে কাঠামোসহ একতারাটির উচ্চতা ১৬ ফুট। লাউ পাকলে যে রং হয় সেই রং দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এই একতারা। তাতে এক হাতের আঙ্গুল রয়েছে একতারার তারে। লালন একাডেমির এডহক কমিটির সদস্য সেলিম হক বলেন, একতারাটি তৈরি করতে সময় লেগেছে প্রায় ১৫ দিন। কাজটি করেছেন কুষ্টিয়ারই সন্তান জাকারিয়া ইসলাম মিতুল। একতারা নির্মাণের কাজটি দেখভাল করা লালন একাডেমি সদস্য সচিব সহকারী কমিশনার এবিএম আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘একতারা বাউল গানের প্রধান অনুষঙ্গ। আর লালন তার গানে একতারায় সুর তুলতেন। একতারা হাতে তিনি গানের মজমা বসাতেন। তাই লালনের সেই স্মৃতিকে ধরে রাখতেই মাজার প্রাঙ্গণে একটি একতারা নির্মাণ করা হয়েছে। এতে সৌন্দর্য্য বৃদ্ধির পাশাপাশি দর্শনার্থীরা ঘুরতে এসে আনন্দ পাবে। মাজারে ঢোকার পরই চোখে পড়বে দৃষ্টিনন্দন এ একতারা। ১ জানুয়ারি একতারাটি দর্শনার্থীদের দেখার জন্য উন্মোক্ত করে দেয়া হয়।
×