ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশ লেখিকা সংঘের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদ্্যাপন

প্রকাশিত: ১১:২৩, ৮ মার্চ ২০২০

বাংলাদেশ লেখিকা সংঘের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদ্্যাপন

স্টাফ রিপোর্টার ॥ গান, কথামালা আর পদক প্রদানের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশ লেখিকা সংঘের ৪৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদ্যাপন করা হয় শনিবার সকালে। জাতীয় জাদুঘরের কবি সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে সাহিত্য পদক প্রদান করা হয় শিশুসাহিত্যিক রফিকুল হক দাদুভাই, কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক ও সাহিত্যিক তাহমিনা কোরাইশীকে। কবি তাইবুন নাহার রশীদ স্বর্ণপদক প্রদান করা হয় লেখিকা সংঘের সভাপতি দিলারা মেসবাহকে। অনুষ্ঠানে সম্মানিত অতিথি ছিলেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী ও কথাসাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হক। এছাড়া আরও বক্তব্য রাখেন লেখিকা সংঘের প্রধান উপদেষ্টা বেগম রাজিয়া হোসাইন, উপদেষ্টা সমন্বয় প্রফেসর অনামিকা হক লিলি ও ভারতের কথাসাহিত্যিক চুমকী। শুভেচ্ছা স্মারক প্রদান করা হয় হাসিনা মতিনকে। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন লেখিকা সংঘের সভাপতি দিলারা মেসবাহ। সম্মানিত অতিথির বক্তব্যে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী বলেন, আজ ৭ মার্চ আমাদের জাতির জন্য একটি উল্লেখযোগ্য দিন। আমাদের মহান নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই দিনে উচ্চারণ করেছিলেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম’। ঠিক সেই দিন থেকে নয়, ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ থেকেই আমরা নতুনভাবে রক্তের ভাষাকে খুনের ভাষা হিসেবে চিহ্নিত করে একটি দেশের আকাক্সক্ষা করেছিলাম। আর তার স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বাংলাদেশ লেখিকা সংঘের এই আয়োজনকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে করছি। আমি এর সঙ্গে আমাকেও যুক্ত করতে চাই। যেহেতু এই সংঘের সঙ্গে গত দু’বছর যাবত আমি বেশ জড়িয়ে আছি। আমি তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়, শুভেচ্ছা পেয়েছি। সেজন্য আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। প্রাপ্তি এবং অপ্রাপ্তি নিয়ে নানা কথা থাকে। আজ যারা পুরস্কার পেয়েছেন সবাইকে আমার আন্তরিক অভিনন্দন। এখানে লেখক-লেখিকা বলে কথা নয়, কথা হচ্ছে সৃষ্টির। আপনার সন্তান যখন ভূমিষ্ঠ হয় তখন আপনি তার প্রথম উচ্চারণ যেটি শোনেন, যে ক্রন্দন শোনেন সেটি হচ্ছে ‘মা’। সেটি একটি কবিতা, একটি সাহিত্য, একটি সৃষ্টি। এই সৃষ্টি একদিন ধ্বংসের দিকে যাবে। আপনি জানেন সেও একদিন মৃত্যুমুখে পতিত হবে। কিন্তু এর ভেতর থেকে যে অর্জনগুলো সে তুলে নিয়ে আসবে তাই আমাদের জীবন, তাই আমাদের সাহিত্য, তাই আমাদের আচার। এখানে কোন প্রকার ধৃষ্টহীনতা ও কোন প্রকার অবহেলা সহ্য করবে না। প্রকৃতি বড় নির্মম। প্রতিটি ধ্বংসের সঙ্গে সৃষ্টি জড়িত এবং সৃষ্টির সঙ্গে ধ্বংস জড়িত। এ কথাটি অন্তত আমরা বিবেচনায় নেব। যেহেতু আগামী বছর আমাদের স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পার করব। এই বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ এবং আমাদের স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর আমরা কি হিসেব নিকেশের ভেতর নেব না? ১৯৪৭’র দেশ ভাগের পর থেকে ১৯৭১। এ সময় থেকে বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে এই বঙ্গীয় অঞ্চলের লোক অন্য ভূমি থেকে কতটুকু পিছিয়ে গেল কিংবা এগিয়ে গেল এটা বিবেচ্য নয়। আমরা কিন্তু যে দ-টি হাতে নিয়েছি সেই দ-ের শীর্ষে রয়েছে লাল এবং সবুজ একটি পতাকা। আমরা কণ্ঠে যে সঙ্গীতটি নিয়েছি সেটি আমার সোনার বাংলা। সর্বোপরি আমরা ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের একটি ভূখ- নিয়ে, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে, বাংলাদেশের জনগণ নিয়ে, বাঙালীর অস্তিত্ব নিয়ে সারা পৃথিবীতে ভ্রমণ করছি। আমাদের ভ্রমণ সঙ্কটময়। আগামী পঞ্চাশ বছর আমাদের স্থাপনার অংশটুকুকে দৃঢ় করা ও আমাদের সমস্ত ভ্রান্তি থেকে সরে এসে পরবর্তী প্রজন্ম যে বিলাস অংশটুকু নিচ্ছে তা আমাদের জন্য সঙ্কারই। আসুন বন্ধুরা, মায়েরা, বোনেরা ও ভাইয়েরা সব ভ্রান্তি দূর করে আমাদের সৃষ্টির জন্য, দেশের গৌরবের জন্য আমাদের বাঙালী সত্ত্বার জন্য আমরা সত্যবাদী ও দেশপ্রেমিক হই। কথাসাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হক বলেন, দীর্ঘ ৪৭ বছর ধরে একটি সংগঠন টিকে থাকা খুব কঠিন একটি বিষয়। অনেকে বলছেন মেয়েদের লেখা কেউ পড়তে চায় না ছুঁয়েও দেখে না। আমি মনেকরি খেলার জগত অত্যন্ত নির্মম একটি জগত। বহু বছর ধরে মানুষ খাতায় নাম ওঠাতে পারে না। মেয়েদের খেয়াল রাখতে হবে যে সত্যিকার লেখা হচ্ছে কি না। শুধুমাত্র বইয়ের সংখ্যা বাড়িয়ে লাভ নেই। সেক্ষেত্রে মেয়ে লেখকদের আরও সচেতন হতে হবে। আর লেখিকা সংঘ নামটা আমার পছন্দ নয়। আমি সব সময় বলেছি ‘আ’ কারটা বাদ দিতে হবে। আমাদের লেখক হতে হবে। আমাদের সাহিত্যের মূল ধারার সঙ্গে মিশতে হবে। এ বড় কঠিন সাধনার জগত। আমার টাকা পয়সা যতই থাক কিন্তু আমি লেখক হিসেবে নাম করতে পারব না যদি না আমার ভেতর সেই এলিমেন্ট থাকে। ৪৭টি বছর ধরে একটি সংঘ টিকে আছে এবং দেশের বিভিন্ন জায়গায় শাখা পত্তন করেছে এটা যেন তেন কথা নয়। এর ভেতর একটা ইন্টারনাল ফোর্স না থাকলে এটা এতদিন ধরে রাখা যেত না, এতদূর এগুতে পারত না। সে জন্য আমি বলব লেখিকা সংঘের যে শক্তিমত্তা আছে, যে সাহস আছে, সংগঠনকে চালিয়ে নেবার জন্য যে কৃতিত্ব তাদের আছে অবশ্যই তাদের আমি ধন্যবাদ দেব। আমাদের মূল লক্ষ্য হলো সাহিত্য করা। সেই সাহিত্যকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। কেউ যেন বলতে না পারে এটা একটা মেয়েদের লেখা, এটা বোঝাই যায় এটা মেয়েদের কাজ। যেন সবাই বলে যে একজন লেখক লিখেছেন। এর আগে জাতীয় সঙ্গীতের মধ্যদিয়ে শুরু হয় অনুষ্ঠান। রজনী কান্তের ‘তুমি নির্মল কর মঙ্গল কর মলিন মর্ম মুছায়ে’ গানটি পরিবেশন করেন রোমেনা হক রুমা। শোক প্রস্তাব পাঠ করেন শাহান আরা জাকির। এ সময় লেখিকা সংঘের সঙ্গে জড়িত যারা প্রয়াত হয়েছেন তাদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। স্বাগত বক্তব্য দেন লেখিকা সংঘের প্রধান পৃষ্টপোষক সেলিনা খালেক। লেখিকা সংঘের সদস্য অভিধানের মোড়ক উন্মোচন করেন অতিথিরা। বার্ষিক প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন লেখিকা সংঘের সাধারণ সম্পাদক ড. লিপি মনোয়ার। এরপর সাহিত্য পদকপ্রাপ্তদের হাতে সম্মাননা ক্রেস্ট তুলে দেন অতিথিরা। সাহিত্য পদক প্রাপ্তির পর অনুভূতি প্রকাশ করে তাহমিনা কোরাইশী বলেন, আমি ভীষণ খুশি। এক প্রকার আবেগাপ্লুত। সাহিত্য পদক প্রাপ্তির পর অনুভূতি প্রকাশ করে কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক বলেন, বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ প্রদত্ত পদক পাওয়া আমার জীবনের একটা স্মরণীয় ঘটনা। আমরা যারা লিখি অথবা লিখি না, কাজ করি অথবা করি না তাদের জীবনে দুটোই জোটে পুরস্কার এবং তিরস্কার। আজ পুরস্কার পেলাম এজন্য খুবই ভাল লাগল। এই পুরস্কারে অনেক অনুপ্রাণিত বোধ করছি। সাহিত্য পদক প্রাপ্তির পর অনুভূতি প্রকাশ করে শিশু সাহিত্যির রফিকুল হক দাদু ভাই কবিতার ছন্দে বলেন, আমি বাংলায় কথা বলি, আমি বাংলার আলপথ দিয়ে হাজার বছর ধরে চলি, চলি পলিমাটি কোমলে আমার চলার চিহ্ন ফেলে তেরশত নদী শুধায় আমাকে কোথা থেকে তুমি এলে? আমি তো এসেছি চর্যাপদের অক্ষরগুলো থেকে আমি তো এসেছি শওদাগরের বিনয় বহর থেকে। আমি তো এসেছি পালগৃহ নামে চিত্রকলার থেকে। আমি তো এসেছি রাষ্ট্রভাষার লাল রাজপথ থেকে। আমি তো এসেছি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর থেকে।
×