ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

শেখ রেহানা, রাদওয়ান মুজিব ও পুতুলকে সঙ্গে নিয়ে কণ্ঠ মেলালেন প্রধানমন্ত্রী

তারুণ্যের উচ্ছ্বাসে মুখর জয় বাংলা কনসার্ট

প্রকাশিত: ১১:২০, ৮ মার্চ ২০২০

তারুণ্যের উচ্ছ্বাসে মুখর জয় বাংলা কনসার্ট

মনোয়ার হোসেন ॥ সাতই মার্চ ১৯৭১। এসেছিল বাঙালীর মুক্তির ডাক ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। জাতির জনকের সেই অবিনাশী কণ্ঠস্বরে জাতি খুঁজে পেয়েছিল শৃঙ্খল মুক্তির ঠিকানা। বিশ্ব মানচিত্রে বাঙালীর স্বাধীন রাষ্ট্র গড়ার বার্তা দেয়া সেই ঐতিহাসিক দিনটি ছিল শনিবার। সেই সূত্র ধরে এদিন গানে গানে ফিরে এলো একাত্তর। সংগ্রামমুখর খরিস্রোতা সেই সময়কে আলিঙ্গন করা হলো বর্তমান প্রেক্ষাপটে। সুরের সঙ্গে মেলবন্ধন ঘটলো বাঙালী জাতিসত্তার অবিনাশী চেতনার। এই প্রজন্মের একঝাঁক ব্যান্ডদলের নিজস্ব পরিবেশনার সঙ্গে গীত হলো স্বাধীন বাংলা বেতারের গান। আর সবটাই হলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক সাতই মার্চের ভাষণকে উপজীব্য করে। তারুণ্যের বাঁধভাঙ্গা উচ্ছ্বাসে পরিণত হওয়া সঙ্গীত আসরটি চলল দুপুর থেকে রাত অবধি। বনানীর আর্মি স্টেডিয়িামে অনুষ্ঠিত হলো জয় বাংলা কনসার্ট। বঙ্গবন্ধুর শততম জন্মবর্ষকে ঘিরে চলা আয়োজনের মাঝে এবারের সঙ্গীতায়োজনটি পেয়েছে ভিন্নমাত্রা। গান শোনার পাশাপাশি শেখ মুজিবকে নিয়ে নির্মিত হলোগ্রাফিক প্রজেকশনটি মুগ্ধ করেছে দর্শক-শ্রোতাকে। গ্যালারি থেকে মাঠ-সবটুকু জায়গাজুড়ে চোখে পড়েছে তারুণ্যের মুখরতা। গানের সুরে, নাচের তালে শূন্যে ভেসেছে শরীর। সঙ্গীতের সেই সরবতায় শামিল হয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কনসার্টটি উপভোগের পাশাপাশি তারুণ্যের ¯্রােতধারার সঙ্গে মিশে গিয়ে কণ্ঠও মিলিয়েছেন গানের সুরে। এ সময় তার সঙ্গী ছিলেন বঙ্গবন্ধুর আরেক মেয়ে শেখ রেহানা এবং দুই নাতি-নাতনিÑ রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ও সায়মা ওয়াজেদ পুতুল। স্বাধীনতার সাক্ষ্যবহ সঙ্গীতাসরটি উপভোগে ঢাকার নানা প্রান্ত থেকে জড়ো হয়েছিলেন শ্রোতারা। স্টেডিয়ামের বিশাল আঙিনা পরিপূর্ণ ছিল তাদের আগমনে। ঐতিহাসিক সাতই মার্চের দিনটিতে অগণন শ্রোতার উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত হলো এ কনসার্ট। ইতিহাস আলিঙ্গন করা সঙ্গীতায়োজনকে ঘিরে বয়ে গেছে প্রাণের উচ্ছ্বাস। সাতই মার্চ উপলক্ষে ষষ্ঠবারের মতো এ কনসার্টের আয়োজন করে সেন্টার ফর রিসার্চ এ্যান্ড ইনফর্মেশনের (সিআরআই) প্রতিষ্ঠান ইয়ং বাংলা। একাত্তরের সাতই মার্চ যে ভাষণের মাধ্যমে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন শেখ মুজিব, ৪৯ বছর পর সেই ভাষণটি ত্রিমাত্রিক প্রদর্শনী উঠে আসে এ আয়োজনে। হলোগ্রাফিক প্রদর্শনীর মাধ্যমে সেই ভাষণকে ফিরিয়ে আনা হয় কনসার্টে উপস্থিত হাজার হাজার দর্শক- শ্রোতার সামনে। কবি নির্মলেন্দু গুণের ‘স্বাধীনতা, ‘এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো’ কবিতার পঙ্ক্তিমালার উচ্চারণে সঙ্গে গ্রাফিক ভিডিও উপস্থাপনার মাধ্যমে শুরু হয় হলোগ্রাফি। এর পর ত্রিমাত্রিক উপস্থাপনায় পর্দায় হাজির হন বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে- শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। ধারা বর্ণনায় সাতই মার্চের ভাষণের আগে পারিবারিক প্রেক্ষাপট স্বকণ্ঠে তুলে ধরেন বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে। তাদের কথায় উঠে আসে, কীভাবে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুননেছা মুজিব ভাষণের ‘মনের কথা’ বলতে তার জীবনসঙ্গীকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। দুই বোনের বর্ণনার শেষ প্রান্তে কবি নির্মলেন্দু গুণের কবিতার শেষের কিছু অংশ পাঠ করেন শেখ হাসিনা। সেই সূত্রে উচ্চারিত হয়-অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন/ক্ষণ পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল/হৃদয়ে লাগিল দোলা, জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার ...। সম্মেলক কণ্ঠে জাতীয় সঙ্গীতের সুরে সূচনা হয় কনসার্টের। এর পর গান শুনিয়েছে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচটি ব্যান্ডদল। এর পর মঞ্চ মাতিয়েছে ফুয়াদ এ্যান্ড ফ্রেন্ড, এফ মাইনর, লালন, শূন্য নেমেসিস, চিরকুট, আরেবোভাইরাস, ক্রিপটিক ফেইট, ভাইকিংস, এ্যাভোয়েড রাফা, মিনারসহ বিভিন্ন ব্যান্ডদল। পুরো কনসার্টে গানের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর বেশ কিছু ঐতিহাসিক উক্তি দিয়ে সাজানো হয়েছে। বরাবরের মতো ষষ্ঠতম আয়োজনেও স্বাধীন বাংলা বেতারের গান শুনিয়েছে, শ্রোতার হৃদয় রাঙিয়েছে ব্যান্ড দলগুলো। বিশেষ আকর্ষণ হিসেবে দর্শককে মুগ্ধ বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে নির্মিত হলোগ্রাফিক প্রজেকশন। গানের পাশাপাশি ডিজিটাল স্ক্রিনে কিংবা শ্রোতার মুখে মুখে বারংবার উচ্চারিত হয়েছে বাঙালীত্বের অহঙ্কারমাখা সেই স্লোগান ‘জয় বাংলা’। বঙ্গবন্ধুর দেয়া ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’-এর উচ্চারিত সেই ঐতিহাসিক ভাষণ দেখা গেছে ডিজিটাল স্ক্রিনে। প্রায় দশ ঘণ্টার এ আয়োজনে প্রতিটি ব্যান্ডদলই নিজেদের পরিবেশনার সঙ্গে গেয়েছে স্বাধীন বাংলা বেতারের প্রেরণাদায়ী কিছু গান। পাবর্ত্য চট্টগ্রামের নারী শিল্পীদের ব্যান্ডদল এফ মাইনরের পরিবেশনাগুলো মুগ্ধতা ছড়িয়েছে শ্রোতার হৃদয়ে। ‘নোঙ্গর তোলো তোলো/সময় যে হলো হলো’ গানের আশ্রয়ে শুরু হয় তাদের পরিবেশনা। এর পর তারা শুনিয়েছে ‘সমস্ত রাত আগলে রাখি বাড়ি/সমস্ত দিন নিজের সঙ্গে আড়ি’। দলটির গাওয়া ‘হেথায় তোকে মানাইছে নারে/তুই লাল পাহাড়ের দেশে যা’ শুনে উচ্ছ্বসিত হয়েছে গানপ্রেমীরা। এছাড়াও দলটি শুনিয়েছে ত্রিপুরা ভাষার গান। স্বাধীন বাংলা বেতারের শিল্পী সুজেয় শ্যামের সুরে মিনার গেয়েছেন ‘রক্ত দিয়ে নাম লিখেছি বাংলাদেশের নাম’। এর পর শুনিয়েছে ‘তুৃমি চাইলে বৃষ্টি দেবো’, ‘যে ছিল মনের অচিনপুরে’ সহ কিছু গান। এ্যাভোয়েড রাফা শুনিয়েছে ‘চলো আরেকবার উড়ি’সহ কয়েকটি গান। ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে, রক্ত লাল রক্ত লাল’সহ কয়েকটি গান পরিবেশন করে ভাইকিংস। এরপর শ্রোতা-দর্শকরা শুনেছে এবং দেখেছে জাতির পিতা শেখ মুজিবের দেয়া ঐতিহাসিক সাতই মার্চের ভাষণ। ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ শিরোনামের সঙ্গীত দিয়ে পরিবেশনা শুরু করে ব্যান্ডদল শূন্য। এর পর দলটি গেয়েছে ‘চলো আজ ফিরে যাই গোধূলীর ওপারে’, ‘শত আশা’, ‘চাইলে তুমি হারিয়ে যাও’সহ কয়েকটি গান। ‘শোনো একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি প্রতিধ্বনি’ দিয়ে পরিবেশনা শুরু করে ব্যান্ডদল লালন। এর পর দলটি একে পরিবেশন করে ‘সময় গেলে সাধন হবে না’, ‘ক্ষ্যাপারে’, ‘পাগল ছাড়া দুনিয়া চলে না’সহ কয়েকটি গান। রেসকোর্স ময়দানে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ স্মরণ করে এবং সেই ভাষণের গুরুত্ব সম্পর্কে তরুণ প্রজন্মকে অবগত করার লক্ষ্যে বিগত ৫ বছরের ধারাবাহিকতা আর্মি স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হলো জয় বাংলা কনসার্টের ষষ্ঠ আসর। এবারও বড় পর্দায় দেখা গেছে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটির রঙিন সংস্করণের প্রদর্শনী। যখন এটি দেখানো হয় মনে হচ্ছিল যেন সাদা-কালো সেই অতি পরিচিত ঘটনাটি চোখের সামনে ঘটছে।
×