ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

শ্রিংলার সঙ্গে বৈঠকটিও বাতিল হয়ে যায়

প্রকাশ্যে ভারতবিরোধিতা আর আড়ালে তোষণ-বিএনপির নীতি

প্রকাশিত: ১১:২০, ৮ মার্চ ২০২০

প্রকাশ্যে ভারতবিরোধিতা আর আড়ালে তোষণ-বিএনপির নীতি

শংকর কুমার দে ॥ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার আশায় ‘প্রকাশ্যে ভারত বিরোধিতা, আড়ালে ভারত তোষণ- তৈলমর্দনে’ নেমেছে বিএনপি’ এমনটাই গোয়েন্দা সংস্থার দাবি। ঢাকায় সফররত ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলার সঙ্গে বিএনপির কূটনীতিক উইংয়ের প্রতিনিধি দলের বৈঠকটি বাতিল করে ভারত সরকার। এখন আবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আসন্ন ঢাকায় সফরের সময়ে সাক্ষাত প্রার্থী হওয়ার জন্য পর্দার অন্তরালে দৌঁড় ঝাপ শুরু করেছে বিএনপি। এটাই হচ্ছে বিএনপির ভারত বিরোধী রাজনীতির কৌশল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের প্রাক্কালে সে দেশের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলার ঢাকায় সফর বিষয়ক প্রতিবেদনে এই ধরনের তথ্য তুলে ধরেছে গোয়েন্দা সংস্থা। গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চারদলীয় জোট ক্ষমতায় থাকাকালীন পাকিস্তান প্রীতি দেখাতে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটায় বিএনপি। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর এখন তার মাশুল গুণছে কড়ায় গ-ায়। বারবার চেষ্টা করেও আর ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নতি করতে পারেনি বিএনপি। নানা ইস্যুতে ছাড় দিয়ে ভারতের আস্থা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে তারা। কিন্তু তাও ব্যর্থ। ব্যর্থতার সর্বশেষ প্রমাণ, গত মঙ্গলবার সকালে ঢাকা সফররত ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলার সঙ্গে বিএনপির কূটনীতিক উইংয়ের প্রতিনিধি দলের বৈঠক হওয়ার কথা থাকলেও শেষ মুহূর্তে তা বাতিল হওয়ার ঘটনাটি। বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতোই বিএনপির সঙ্গে অনুষ্ঠিতব্য বৈঠকটি আকস্মিকভাবে বাতিল করে দেয় ভারত সরকার। গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়, দিল্লীতে মুসলমানদের ওপর সহিংসতায় উদ্বেগ জানিয়ে সম্প্রতি বিবৃতি দিয়েছে বিএনপি। এরপর এক অনুষ্ঠানে শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আগমন নিয়ে প্রশ্ন তোলেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এ ছাড়া বৈঠক হলেও সেখানে বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে দিল্লীর ঘটনা তুলে ধরার বিষয়টি নিয়ে সন্দিহান ছিল ভারত সরকার। এসব কারণেই বৈঠকটি বাতিল হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বৈঠকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও কূটনীতিক উইংয়ের প্রধান আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু ও সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদের থাকার কথা ছিল। বিএনপির একান্ত আগ্রহ থকার পরও গত মঙ্গলবারের বৈঠকটি বাতিল করে দেয় ভারতীয় দূতাবাস। গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়, বৈঠক বাতিলের পর পরবর্তী কৌশল নিয়ে আলোচনা করছেন বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ। তারা এখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকায় সফরের সময়ে অল্প সময়ের জন্য হলেও সাক্ষাতের জন্য জোর লবিং শুরু করেছে বিএনপি। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বিএনপির নেতৃবৃন্দের সাক্ষাত করিয়ে দেয়ার জন্য আন্তর্জাতিকভাবে লবিং করছেন লন্ডনে পলাতক সাজাপ্রাপ্ত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। দুর্নীতির অভিযোগে সাজাপ্রাপ্ত কারাবন্দী বিএনপির চেয়ারম্যান বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য ভারতের দ্বারস্থ হতে চায় বিএনপি। বেগম জিয়ার মুক্তির জন্য ভারত যেন বাংলাদেশ সরকারকে চাপ দেয়, বিএনপির মনোভাব এমনই। গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারত গত ১২ বছর ধরে অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়ে চলেছে আওয়ামী লীগকেই। আওয়ামী লীগ ভারত বিরোধিতার জন্য এমন নীতিতে বিশ্বাসী নয়। যেটা ন্যায় ও ন্যায্য, সেটা ভারতের কাছে বরাবরই তুলে ধরছে আওয়ামী লীগ। উলফাদের বাংলাদেশ থেকে উৎখাতে ভারতকে সহযোগিতা, সন্ত্রাস বিরোধী সহঅবস্থান ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনে আওয়ামী লীগ ধারাবাহিকভাবেই কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু প্রকাশ্যে ভারত বিরোধিতা ও আড়ালে ভারতের তোষন-তৈলমর্দন নীতির কারণে ভারতের আস্থা হারাচ্ছে বিএনপি। বিএনপির নেত্রীর মুক্তি ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন হওয়ার জন্য এতদিন ইউরোপ, আমেরিকাসহ প্রভাবশালী দেশগুলোর কাছে লবিং করে এসেছে বিএনপি। কিন্তু শেষ বেলায় এসে দেখা যায়, ভারতকে টপকিয়ে কেউই কিছু করে দিতে চাচ্ছে না। আর এ কারণেই বিএনপি এখন প্রকাশ্যে ভারত বিরোধিতা করলেও আড়ালে ভারত তোষণ ও তৈলমর্দন নীতিতে অবস্থান নিয়েছে বলে গোয়েন্দা সংস্থার দাবি। গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপির বিরুদ্ধে ছিল ভারতের কংগ্রেস সরকারের ভূমিকা। বিএনপির আশা ছিল, মোদি সরকার আসার পর বাংলাদেশ ইস্যুতে দেশটির মনোভাব পরিবর্তন হবে। সর্বশেষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে মোদি সরকারের অকুণ্ঠ সমর্থন প্রত্যাশা করেছিল বিএনপির হাইকমান্ড। সে আশা আর পূরণ হয়নি বিএনপির। এখন তো ভারতের সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের (সিএএ) ঘটনায় দিল্লীর সহিংসতার বিরুদ্ধে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশই বিবৃতি দিচ্ছে। আওয়ামী লীগ সরকারের নীতি নির্ধারক মহলও একাধিকবার ভারতের সঙ্গে নাগরিকত্ব আইনের বিষয়টি আলোচনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। ভারতের এসব ইস্যুতে উদ্বেগ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে বিএনপিও। বিএনপি প্রকৃতপক্ষে গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকে ধীরে ধীরে ভারতের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বক্তব্য দিতে শুরু করেছে। সীমান্ত হত্যা, ভারতের সিএএ, এনআরসি এবং সর্বশেষ দিল্লীর সহিংসতার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অবস্থান নিয়েছে বিএনপি। সিএএ নিয়ে সংসদে দেয়া ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর বক্তব্যের তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়ে তা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে বিএনপি। সিএএ ও এনআরসির ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে দেশটির সরকার দাবি করলেও তা মানতে নারাজ বিএনপি। গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা বলেন, বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে ভারত সরকারের আমন্ত্রণে দিল্লী সফর করেছিলেন ২০১২ সালের অক্টোবরে। ওই সফরকে ইতিবাচক ধরে এগিয়ে ছিল বিএনপি। যার কারণে ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কারাবন্দী হওয়ার আগ পর্যন্ত ভারতের বিরোধিতা বা সমালোচনা করে কোন বক্তব্য বা বিবৃতি দেননি খালেদা জিয়া। কিন্তু বেগম খালেদা জিয়া বড় ভুলটি করেন ২০১৩ সালের মার্চ মাসে। তখন ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। জামায়াত হরতাল ডাকায় ভারতের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বৈঠক বাতিল করেছিলেন খালেদা জিয়া। সেটাই হয়েছিল তার রাজনৈতিক জীবনের অনভিজ্ঞতার কাল। ওই বৈঠক বাতিল নিয়ে এখনও শুধু দলটির মধ্যে নয়, নানা মহলে বিশেষ করে কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক মহলে এখনও নানা আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। ভারতের রাষ্ট্রপতির তখনকার বাংলাদেশ সফরের সময়ে জামায়াত হরতাল দিবে এটাই স্বাভাবিক। কারণ বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছে জামায়াত। জামায়াতের পাতা ফাঁদে পা দিয়েছে বিএনপি।
×