ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

নীলফামারীর জয়চণ্ডি গ্রাম

মুজিববর্ষে বিষমুক্ত সবজি

প্রকাশিত: ০৯:৩২, ৮ মার্চ ২০২০

মুজিববর্ষে বিষমুক্ত সবজি

স্টাফ রিপোর্টার, নীলফামারী ॥ মানুষকে বিষমুক্ত শাকসবজি খাওয়ানোর সংকল্পে একজোট হয়েছেন নীলফামারী সদরের চিলাই জয়চণ্ডি গ্রামের কৃষকরা। এবারের শীত মৌসুম থেকে স¤পূর্ণ পরিবেশবান্ধব, রাসায়নিক সার ও রাসায়নিক বালাইনাশক ছাড়াই নিরাপদ সবজি আবাদ করছেন তারা। এতে উৎপাদন একটু কম হলেও মানুষকে বিষমুক্ত শাকসবজি খাওয়াতে পারছেন এই ভেবে গ্রামটির কৃষকরা নিজেদের গর্বিত মনে করছেন। নিরাপদ সবজি গ্রামের চারদিক সবুজ সবজির খেতে ভরে গেছে। নিয়ম অনুযায়ী বিষমুক্ত সবজি আবাদে গ্রামের দৃশপটের পরিবর্তন ঘটেছে। ফলে গ্রামটি এখন ‘নিরাপদ সবজির গ্রাম’ বা ‘অরগানিক কৃষি গ্রাম’ হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছে। প্রায় ২০ জন কৃষক এবার তাদের জমিতে চাষ করেছেন বিষমুক্ত শাকসবজি। সম্প্রতি জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের আয়োজনে নিরাপদ সবজি গ্রামটি পরিদর্শন ও কৃষকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়। জেলা প্রশাসক হাফিজুর রহমান চৌধুরী, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদীন, স্থানীয় সরকারের উপপরিচালক আব্দুল মোতালেব সরকার, পুলিশ সুপার মোকলেছুর রহমান, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) আজাহারুল ইসলাম, সিভিল সার্জন ডাঃ রনজিত কুমার বর্মণ, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রুহুল আমিন, সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শাহিদ মাহমুদসহ অনেকে গ্রামটির বিষমুক্ত সবজি খেতগুলো পরিদর্শন করে অভিভূত হন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক নিখিল চন্দ্র বিশ্বাস, সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কামরুল হাসান, এসএএও’র ডিপ্লোমা কৃষিবিদ নাজমুল হুদা মিঠুসহ কৃষি বিভাগের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাবৃন্দ। নিরাপদ সবজি গ্রামটি পরিদর্শন ও কৃষকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় জেলা প্রশাসক হাফিজুর রহমান চৌধুরী বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রহমানের জন্মশত বার্ষিকী সামনে রেখে আগামী ১৭ মার্চ/২০২০ থেকে ১৭ মার্চ/২০২১’এর মধ্যে জেলার ৬ উপজেলার ৬০টি ইউনিয়নে নিরাপদ সবজি গ্রাম এবং গ্রামের প্রত্যেক বাড়িতে নিরাপদ সবজি বাগান তৈরি করার প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। যেহেতু বাংলাদেশ সরকার একটি কৃষিবান্ধব সরকার। তাই কেমিক্যালমুক্ত সবজি আবাদ করে বাজারজাত করে মানবদেহে সঠিক পুষ্টি তৈরি হবে। আবাদকৃত সবজিগুলো বাজারজাতের ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে জেলার প্রত্যেকটি হাটবাজারে নিরাপদ সবজি কর্নার তৈরি করা হবে। যাতে সাধারণ মানুষ পুষ্টিকর, কেমিক্যাল ও ফরমালিন মুক্ত নিরাপদ সবজি আহার করতে পারেন। সরেজমিন দেখা যায়, গ্রামের চারদিক সবুজ সবজির খেতে ভরা। কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সদর উপজেলা কৃষি বিভাগের পরামর্শে গ্রামের ৫ একর জমিতে চাষ হচ্ছে বিষমুক্ত নানা রকম সবজি। আলু, শিম, টমেটো, ফুলকপি, বাঁধাকপি, ভুট্টা, মিষ্টিকুমড়া, লাউ, ধনেপাতা, বেগুন, লালশাক, করলা, পুইশাক, লাউসহ ইত্যাদি। কৃষিবান্ধব বাংলাদেশ সরকারের রূপকল্প ভিশন-২০২১ বাস্তবায়নে কৃষিকে উন্নতকরণে একটি যুগান্তকারী প্রদক্ষেপ নিয়ে নীলফামারীতে নিরাপদ সবজি গ্রাম বা অরগানিক কৃষি গ্রাম তৈরি করা হয়েছে। কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহারে কৃষি ব্যবস্থাকে আধুনিক, যুগোপযোগী ও গুণগত পরিবর্তন আনা হয়েছে। গ্রামের প্রবেশ মুখেই চোখে পড়ে বিশাল সাইবোর্ড ‘নিরাপদ সবজি গ্রাম’। জয়চ-ি কৃষক গ্রুপের সদস্য বিশ্বেশ্বর রায় (৫০) বলেন, আগে আমরা জমিতে রাসায়নিক সার ব্যবহার করতাম। কীটনাশক ¯েপ্র করতাম। এর মাধ্যমে বহু বছর হাইব্রিড জাতের শাকসবজি আবাদ করেছি। এতে ফলন বেশ ভাল হতো। তবে আমরা জানাতাম না, এসব ফসল বিষাক্ত এবং এসব খেয়ে মানুষ নানা রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হতেন। আমরা কৃষি বিভাগের কাছ থেকে জানতে পারি, রাসায়নিক সার, কীটনাশক প্রয়োগে জমির ফসল বিষে পরিণত হয় এবং মাটি উর্বরতা শক্তি হারিয়ে ফেলে। আমরা গেল বছর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি, আর মানুষকে বিষ খাওয়াব না। বর্তমানে আমাদের গ্রামের সবাই নিরাপদ সবজি আবাদে সংকল্পবদ্ধ হয়েছেন। তিনি জানালেন, বিষমুক্ত একটি পুঁইশাক গাছ থেকে এবার তিনি ১০ হাজার টাকা পুঁইশাক বিক্রি করেছেন। তার বিষমুক্ত ফুলকপি পাতাকপি, টমেটা, বেগুন বিভিন্ন গ্রামের মানুষজন এসে জমি থেকে ক্রয় করে নিয়ে যায়। বিষমুক্ত সবজির এত চাহিদা আগে বুঝতে পারিনি জানিয়ে এই কৃষক বললেন বিষমুক্ত সবজি উৎপাদন কিছুটা কম হলেও এখন নিজেদের গর্বিত মনে হচ্ছে যে আমরা বিষমুক্ত সবজি মানুষজনকে খেতে দিতে পারছি। এই গ্রামের চাষীরা সম্মিলিতভাবে গর্ত খুঁড়ে গৃহস্থালি বর্জ্য দিয়ে তৈরি করছেন কম্পোস্ট সার, ভার্মি কম্পোস্ট বা কেঁচো সার। এ ছাড়া বিভিন্ন প্রাকৃতিক উপাদান মিশিয়ে তৈরি করা হচ্ছে জৈব বালাইনাশক। এসব ফসলের জমিতে প্রয়োগ করে মিলছে ভাল ফল। গ্রামের সকল কৃষক যেন কেঁচো সার তৈরিতে বেশ দক্ষ হয়ে উঠেছেন। মাত্র ১৫ দিনের মাথায় জৈব প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ভার্মি কম্পোস্ট তৈরি করতে পারেন তারা। এ সার জমিতে প্রয়োগ করলে অনেক ভাল ফলন মেলে বলে জানালেন কৃষকরা। কিষানি মাধবী রানী রায় (৪২) বলেন, কৃষি বিভাগ থেকে জৈব চাষাবাদ বিষয়ে প্রশিক্ষণ পেয়েছি আমরা। ফসলের পরাগায়ণ কীভাবে ঘটাতে হয়, তা এখন আমরা জানি। প্রকৃতির কাছে আশায় না থেকে পরাগায়ণ প্রযুক্তি ব্যবহার করছি। এতে ফসল পুষ্ট হচ্ছে। জৈবপদ্ধতিতে চাষাবাদ করা জমিগুলো ঘুরে দেখা যায়, খেতের মাঝে মাঝে স্থাপন করা হয়েছে সেক্স ফেরোমন ফাঁদ। এটি হচ্ছে কীটপতঙ্গ দমনের জৈবপদ্ধতি। সেক্স ফেরোমন ব্যবহারের সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে এটি প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত, যা মানুষ বা পরিবেশের কোনরূপ ক্ষতি করে না। সুতরাং এটি পরিবেশবান্ধব। এই পদ্ধতিতে প্লাস্টিক বক্স ব্যবহার করা হয়। যার দুই পাশে তিন কোনা ফাঁক থাকে। পুরুষ পোকাকে আকৃষ্ট করতে স্ত্রী পোকার শরীর থেকে নিঃসৃত এক রকম প্রাকৃতিক রাসায়নিক পদার্থ বা স্ত্রী পোকার গন্ধ ব্যবহার করা হয় ফাঁদে। এর আকর্ষণে পুরুষ পোকা ফাঁদের দিকে ধেয়ে আসে এবং ফাঁদে পড়ে মারা যায়। এতে জমির ফসল নিরাপদ থাকে। অতীতে এসব কীট দমনে ব্যবহৃত হতো বিষাক্ত কীটনাশক। সেক্স ফেরোমন ফাঁদ বা গন্ধ ফাঁদ ব্যবহার করায় জমির ফসল নিরাপদ থাকছে। খাদ্যমান ও পুষ্টি সঠিকভাবে পাওয়া যাচ্ছে বলে জানায় কৃষি বিভাগ। সূত্রমতে, বিষমুক্ত ফসল উৎপাদনে খরচ একটু বেশি হয়। জৈব পদ্ধতিতে ১০ শতক জমিতে করলা উৎপাদনে খরচ ৪ হাজার টাকা। এ থেকে মিলেছে ৫৭০ কেজি করলা, যা বেচে আয় হয় ১৪ হাজার টাকা। এদিকে ২০ শতক জমিতে টমেটো উৎপাদনে খরচ হয়েছে ১০ হাজার টাকা। এ থেকে উৎপন্ন হয় প্রায় ১০০ মণ টমেটো। কম করে হলেও প্রতি মণ টমেটোর দাম ১ হাজার টাকা ধরে সে ক্ষেত্রে ২০ হাজার টাকা খরচ করে পাওয়া যাবে ১ লাখ টাকা। কৃষি বিভাগ বলছে, নিরাপদ সবজি বাজারজাত করতে সরকার এরই মধ্যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। ঢাকায় গড়ে তোলা হয়েছে নিরাপদ কৃষিবাজার। শীঘ্রই নীলফামারী জেলায় এ ধরনের বাজার সৃষ্টি করা হবে, যেখানে ১২ মাস নিরাপদ সবজি পাওয়া যাবে।
×