সমুদ্র হক, বগুড়া অফিস ॥ বগুড়া নগরীতে বায়ুদূষণের মাত্রা অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে। দিনে দিনে এই মাত্রা অসহনীয় হয়ে নগরী ও আশপাশের এলাকায় স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এখনই অনিয়ন্ত্রিত। বেড়েছে বায়ু দূষণজনিত নানা রোগ ব্যাধি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরিবেশ সুরক্ষা সংস্থার তৈরি বায়ুর মান সূচকে (এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স সংক্ষেপে এ কিউ আই) বাংলাদেশের দূষিত নগরীর অন্যতম তালিকায় স্থান পেয়েছে বগুড়া। গত তিন মাসে বগুড়া নগরীর একিউআই ২০৪ থেকে ২৯০’র মধ্যে ওঠানামা করেছে। আন্তর্জাতিক সূচকে বগুড়া নগরীর এই মাত্রা উদ্বেগজনক খুবই অস্বাস্থ্যকর ও ঝুঁকিপূর্ণ। নিয়ন্ত্রণ করা না হলে বায়ুদূষণ আরও বেড়ে ভয়ঙ্কর পরিণতিতে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়তে পারে।
বগুড়ায় অবস্থিত পরিবেশ অধিদফতরের রাজশাহী বিভাগীয় কার্যালয়ে গেল ডিসেম্বর মাসে এ কিউ আই কেন্দ্র স্থাপন করে প্রতিদিন বায়ুর মান পর্যবেক্ষণ শুরু হয়েছে। বগুড়ার নগরীর বায়ু সূচক কোনদিনই গ্রহণযোগ্য অবস্থায় থাকে না। ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত বিভিন্ন দিনে ঝুঁকিপূর্ণ সর্বোচ্চ মাত্রা রেকর্ড করা হয় ১৬ দিন। গেল ডিসেম্বর মাসে ২ দিন, জানুয়ারি মাসের ৬ দিন, ফেব্রুয়ারি মাসের ৮ দিন। এই সময়ে সর্বনিম্ন এ কিউ আই ছিল ২০৪ এবং সর্বোচ্চ ছিল ২৯০। এ কিউ আইয়ের এই মাত্রা ঝুঁকির। যুক্তরাষ্ট্র পরিবেশ সুরক্ষা সংস্থা বাতাসে দৃশ্যমান ক্ষতিকর বস্তুকণার উপস্থিতি বিবেচনায় এ কিউ আই ছয়টি ক্যাটাগরি নির্ণয় করেছে। এ কিউ আই ৩০০’র বেশি হলে খুবই বিপজ্জনক। ৫০’র নিচে থাকলে স্বাস্থ্যকর। ৫০ থেকে ১০০’র মধ্যে থাকলে গ্রহণযোগ্য তবে সাবধানতা অবলম্বন দরকার। এ কিউ আই ১০১ থেকে ১৫০’র মধ্যে থাকলে সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য অস্বাস্থ্যকর। ১৫১ থেকে ২০০’র মধ্যে থাকলে সকলের জন্য অস্বাস্থ্যকর। ২০১ থেকে ৩০০’র মধ্যে থাকলে শিশু বয়স্ক এবং অসুস্থ রোগীর জন্য স্বাস্থ্য ঝুঁকি বেশি। এ কিউ আই ৩০০’র বেশি হলে যে কোন মুহূর্তে ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনে।
বগুড়ায় যারা বাস করছেন তারা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের মধ্যে আছে। বগুড়ায় এ কিউ আই ২০০ থেকে ৩০০’র কাছাকাছি থাকায় শিশু থেকে বয়স্ক এবং অসুস্থ রোগী আছে স্বাস্থ্য ঝুুঁকির মধ্যে। বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ ডাঃ রেজাউল আলম জুয়েল বলেন, হাসপাতালে যত রোগী ভর্তি হচ্ছে তার একটি অংশ বায়ুদূষণ জনিত রোগ ব্যাধিতে আক্রান্ত। জেলার সিভিল সার্জন গাউসুল আজিম চৌধুরী জানান, নগরীর তুলনায় গ্রাম পর্যায়ে বায়ু দূষণজনিত রোগীর সংখ্যা কম। জেনারেল হাসপাতাল (মোহাম্ম্দ আলী হাসপাতাল), উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে বায়ু দূষণজনিত যে সব রোগী আউটডোরে চিকিৎসা নিতে আসে তাদের সাবধানতায় থাকতে বলা হয়। প্রয়োজনে ওষুধ দেয়া হয়। বগুড়ায় বায়ুদূষণের অন্যতম কারণগুলো হলো পৌর এলাকার মধ্যে কয়েকটি ইটভাঁটি। অনেক আবাসিক এলাকায় ভাংড়ি গলানোর ফাউন্ড্রি শিল্প বসেছে। হালকা শিল্প লেদ মেশিন বসেছে কয়েকটি এলাকায়। ফিটনেসবিহীন যানবাহনের কালো ধোঁয়া ছড়িয়ে দিচ্ছে। নগরীতে ছোট যানবাহন চলাচলের ক্ষমতার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। বর্জ্য ব্যবস্থা এতটাই ভেঙ্গে পড়েছে যে প্রধান সড়কের ধারে অনেকটা জায়গাজুড়ে ড্রেনের তরল বর্জ্য পড়ে থাকে দিনের পর দিন। নাজুক ড্রেনেজ ব্যবস্থায় সামান্য বৃষ্টিতে প্রধান সড়কে পানি জমে যায়। নিচু এলাকা জলাবদ্ধ হয়ে পড়ে। রোদ ওঠার পর বাতাসে সকল বস্তুকণা যুক্ত হয়ে বেড়ে যায় দূষণ। নগরীর পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া করতোয়া নদী বর্জ্য ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে।
ভবন নির্মাণের সময় রাস্তার ধারে ইটভাঙ্গা মেশিনে খোয়া তৈরি হয়। ইটের ও বালির ট্রাক শহরের ভেতর দিয়ে চলাচল করে। সকল ক্ষুদ্র বস্তুকণা উড়ে নগরীর বায়ুকে দূষণ করে। এ ছাড়াও বগুড়া উত্তরবঙ্গের মধ্য নগরী হওয়ায় প্রতিদিন ১১ জেলার ভারি যানবাহন চলাচলে ধূলা উড়িয়ে বায়ুদূষণ করছে।
পরিবেশ অধিদফতরের রসায়নবিদ জানান, বাতাসে ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র বস্তুকণা পিএম (পার্টিকুলেট ম্যাটার বা পার্টিক্যাল পলুশন) ১০ মাত্রা হচ্ছে প্রতি কিউবিক মিটারে ৫০ গ্রাম যা বগুড়ার বায়ুকে যারপর নেই দূষিত করছে। নির্মল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ প্রকল্প থেকে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, বগুড়া, সিলেট, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, বরিশালে বায়ুর মান পর্যবেক্ষণ কার্যক্রম শুরু হয়। দূষণে সবচেয়ে এগিয়ে আছে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ। আন্তর্জাতিকভাবে বায়ুর মান পর্যবেক্ষণে বিশে^র সবচেয়ে দূষিত নগরী ভারতের নয়াদিল্লী। এরপর নেপালের কাঠমান্ডু এবং তৃতীয় অবস্থানে বাংলাদেশের ঢাকা। দেশে অন্যতম বায়ুদূষণের তালিকায় যুক্ত হয়েছে বগুড়া নগরী। পরিবশে অধিদফতর রাজশাহী বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালক আশরাফুজ্জামান জানান, বাতাসে দূষণ মাত্রার জন্য দায়ী ক্ষুদ্র ও ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বস্তুকণার পরিমাণ বেড়ে যাওয়া। বগুড়া নগরী ও আশপাশে বায়ুদূষণ বেড়ে যাচ্ছে।
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: