ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

ইব্রাহিম নোমান

রাজকন্যার কথা বলা পুতুল

প্রকাশিত: ০৬:১৩, ৭ মার্চ ২০২০

রাজকন্যার কথা বলা পুতুল

সুন্দর পুতুল তৈরি করতে পারে টুয়েনথা। দেশের রাজা থেকে প্রজারা সবাই টুয়েনথার পুতুলের প্রশংসা করে। চারদিকে টুয়েনথার নাম ছড়িয়ে পড়েছে। তবে কয়েকদিন ধরে তার মন ভাল নেই। টুয়েনথার বয়স হয়েছে। চুল পেকে যাচ্ছে। পুতুলে রং করতে এখন তার হাত কাঁপে। নিজের ঘরে বসে এসব ভাবছিল টুয়েনথা। রাজার একমাত্র মেয়ে মালা। তার অসুখ। কিছুই তার ভাল লাগে না। মুখে হাসি নেই, খেলাধুলাতেও মন নেই। রাজকন্যার চারপাশে কত পুতুল। জরির পোশাকের পুতুল রাজকন্যা, লাঙ্গল কাঁধে পুতুল চাষী, পরী পুতুল ইত্যাদি কত ধরনের পুতুল তার ঘরেÑ বলে শেষ করা যায় না। কিন্তু সব কিছুতেই বিরক্ত মালা। আগে টুয়েনথার পুতুল নিয়ে কিছুক্ষণ ভুলে থাকত। এখন সেটাও ভাল লাগে না। রাজকন্যা সব পুতুলই ছুড়ে ফেলে দিল। সব পুতুলই নাকি পুরনো আর দেখতে ভাল নয়। রাজাও ক্ষেপে উঠলেন টুয়েনথার ওপর, বললেন বুড়ো হয়েছ তুমি, এবার বিশ্রাম কর। আমি অন্য কারিগর দেখি। মালার মতো ছোট মেয়েকে যে খুশি করতে পারে না, কী লাভ তাকে রেখে। অপমানে টুয়েনথার মাথা নিচু হয়ে গেল। একদিন রাজাও তো তার পুতুল নিয়ে খেলেছেন। রাজা আজ সে সব দিনের কথাও ভুলে গেলেন। ॥ দুই ॥ রাত-দিন পরিশ্রম করে একটা সুন্দর পুতুল তৈরি করল টুয়েনথা। হাসি-খুশি চেহারার এক সুন্দর কিশোর পুতুল। খুব সুন্দর জরির পোশাক পরিয়ে দিয়েছে পুতুলকে। পুতুলের নাম রাখা হয়েছে রবিন। রাজসভা গমগম করছে। কত লোক আসছে, কেউ নাচ দেখাচ্ছে, কেউ গান শোনাচ্ছে। কিন্তু রাজকন্যার মুখে হাসি নেই। রবিনকে নিয়ে টুয়েনথা হাজির হলো রাজসভায়। সুন্দর পুতুল দেখে মালার চোখে কৌতূহল। হঠাৎ পুতুল রবিন কথা বলে উঠল। রবিন রাজকন্যার কানে কানে বলল, এই আকাশ, মেঘ, সুন্দর বাগান, সুন্দর রাজ্য সবকিছুই কত সুন্দর। তোমার জীবনে কত সুখ, তবুও তুমি খুশি হও না। কত খাবার তোমার সামনে, তবুও তুমি খাও না। আমি একটা পুতুল, হাসতে পারি না, কাঁদতেও পারি না। সামনে কত খাবার খেতেও পারি না। বল রাজকন্যা তবুও তুমি কি হাসবে না? রাজকন্যা কিছুক্ষণ কী যেন ভাবল। তারপর পুতুলের মুখের দিকে চেয়ে হেসে ফেলল। মুক্তার মতো দাঁত ঝিকমিক করে উঠল। রাজকন্যা যে এত সুন্দর হাসতে পারে কে জানত? রাজকন্যা হাসতেই ঘটে গেল একটা মজার কা-। জাদুর মতো পুতুলটা অদৃশ্য হয়ে গেল। তার জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল এক কিশোরকে হাসি মুখে। রাজা ও রাজসভার সবাই তো অবাক। অবাক টুয়েনথাও। ॥ তিন ॥ সেই রহস্যময় পুতুল কিশোর তখন নিজেই এই রহস্যের সমাধান করে দিল। রবিন বলল, সে অনেক দিন আগের কথা। আমি ছিলাম পাতান নগরের এক সওদাগরের ছেলে। ছোটবেলায় আমার মা মারা গিয়েছিল। কিন্তু সবাই আমাকে আদর করত। তবে শাসন করার কেউ ছিল না। ফলে বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার দুষ্টু বুদ্ধিও বাড়তে লাগল। সবাইকে কিভাবে জব্দ করা যায়, সব সময়ই সেই চিন্তা ভিড় করে থাকত আমার মাথায়। একদিন আমি নদীর ধারে বেড়াতে বের হয়েছি। হঠাৎ দেখি এক বুড়ি ভারি কাঠের বোঝা তুলতে চেষ্টা করছে। আমাকে দেখে বুড়ি বলল, বাবা বোঝাটা আমার মাথায় তুলে দাও না। আমি বোঝাটা বুড়ির মাথায় তুলে দিলাম, আর সঙ্গে সঙ্গে ধাক্কা মেরে তাকে নদীতে ফেলে দিলাম। আমি ভেবেছিলাম, খুব মজা হবে। ঠান্ডায় বুড়িটা থর থর করে কাঁপছে। আর তখনই ঘটল অদ্ভুত কান্ড। বুড়ি ছিল একজন ডাইনি। চোখে তার আগুন জ্বলে উঠল। রাগে কাঁপতে কাঁপতে সে অভিশাপ দিল আমাকে, যাও কাঠ হয়ে পড়ে থাক। আমি বুড়ির হাতে পায়ে ধরে বললাম, আমার মা নেই। কে আমাকে ভাল-মন্দ শেখাবে। সবাই আমাকে আদর করে। কিন্তু শাসন করার কেউ নেই। সেই জন্যই আমি দুষ্টু হয়ে গেছি। আমাকে তুমি ক্ষমা কর। আমার কথায় ডাইনি বুড়ির মন নরম হলো। সে বলল, অভিশাপ তো ফেরানো যায় না। তবে তুমি যদি কারও দুঃখ দূর করে তার মুখে হাসি ফোটাতে পার, তবেই তুমি আবার মানুষের রূপ ফিরে পাবে। এই বলে ডাইনি বুড়ি অদৃশ্য হয়ে গেল। রবিন শেষ করল তার পুতুল জীবনের গল্প। রাজকন্যাকে খুশি করে উপহার পেল টুয়েনথা অনেক মণি-মুক্তা । ॥ চার ॥ টুয়েনথা রবিনকে নিয়ে ঘরে ফিরে চলল। পথে আসতে আসতে রবিনের কাছে জানতে চাইল, তুমি কি এখন তোমার বাবার কাছে ফিরে যাবে? রবিন বলল, বাবা কি আর বেঁচে আছেন! তার চেয়ে আমি তোমার কাছেই থাকি? কত বড় শিল্পী তুমি! তোমার কাছে পুতুল তৈরি করা শিখব। আর সেই পুতুল তৈরি করে কি করব বল তো? টুয়েনথা বলল, রাজা আর রাজকন্যাকে উপহার দেবে। রবিন বলল, কখনও না। আমি রাজা ও রাজকন্যাকে কোন পুতুল দেব না। আমি পুুতুল বানাব গরিব ও দুঃখী ছেলেমেয়েদের জন্য। (নেপালী রূপকথা অবলম্বনে)
×