ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

কেনা হচ্ছে ১১২৫ লাগেজ ভ্যান, খোলা ওয়াগন ও কাভার্ড ভ্যান

রেলে পণ্য পরিবহনে ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ

প্রকাশিত: ১০:১৪, ৬ মার্চ ২০২০

 রেলে পণ্য পরিবহনে ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ

মশিউর রহমান খান ॥ অনেকটা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে বাংলাদেশ রেলওয়ের পণ্য পরিবহন সেবা। ব্রিটিশ আমল রেলপথের মাধ্যমেই পণ্য পরিবহনের একমাত্র মাধ্যম হলেও বর্তমানে তার গৌরব হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। রেলপথে পণ্য পরিবহন সেবা বর্তমানে অনেকটা গতিহীন হয়ে পড়েছে। স্বাধীনতার পরপরই ১৯৭২ সালে কেনা লাগেজভ্যানের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার এক যুগের বেশি সময়েও কেনা হয়নি কোন লাগেজভ্যান। ফলে কোন মতে জোড়াতালি দিয়ে ট্রেন পরিচালনা করছে রেল কর্তৃপক্ষ। পণ্য পরিবহনে গতি ফিরিয়ে আনতে এক হাজার ১শ’ ২৫টি লাগেজভ্যান, খোলা ওয়াগন ও কাভার্ডভ্যান কেনার উদ্যোগ দিয়েছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। একই সঙ্গে ৪০টি ব্রডগেজ ইঞ্জিন (লোকোমোটিভ) কেনা হবে। পাকিস্তান আমলে ১৯৬৯ সালের পর স্বাধীনতা পরবর্তী এই প্রথমবারের মতো যাত্রীসেবার পাশপাশি পণ্য পরিবহনে এ যুগান্তকারী পরিবর্তনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। উদ্যোগটি বাস্তবায়নে প্রায় ৩ হাজার ৬০২ কোটি টাকা ব্যয়ে সরকার রোলিং স্টক অপারেশন্স ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্ট অব বাংলাদেশ রেলওয়ে (রোলিং স্টক প্রকিউরমেন্ট) শীর্ষক একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। ২০১৭ সালে নেয়া এ প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হবে আগামী ২০২১ সালে। প্রকল্পের আওতায় মোট ১২৫টি লাগেজভ্যান, ৩০০ খোলা ওয়াগন ও ৭০০ কাভার্ড ওয়াগন ও ৪০টি ব্রডগেজ ইঞ্জিনও (লোকোমোটিভ) কেনা হবে। রেল সূত্র জানায়, যৌথভাবে পরিচালিত এ প্রকল্পে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ঋণ ২ হাজার ৮৩৯ কোটি টাকা আর সরকার দেবে ৭৬২ কোটি টাকা। জানা গেছে, ১২৫টি লাগেজভ্যান কিনতে সর্বমোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৩২৮ কোটি টাকা। এছাড়া ৩০০টি খোলা ওয়াগন কিনতে ব্যয় ধরা হয়েছে ২০৮ কোটি টাকা। অপরদিকে ও ৭০০ কাভার্ড ওয়াগন কিনতে খরচ হচ্ছে ৫৪০ কোটি টাকা। এছাড়া ৪০টি ব্রডগেজ ইঞ্জিন (লোকোমোটিভ) কিনতে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ১ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা। সূত্র জানায়, বাংলাদেশ রেলওয়ে ১৯৭২ সালে সর্বশেষ লাগেজভ্যান ক্রয় করে। এসব লাগেজভ্যানের আয়ুষ্কাল এক যুগের বেশি সময় আগে শেষ হয়ে গেলেও এতবছর এসব মেয়াদহীন লাগেজভ্যান নিয়েই কোনক্রমে দিন পার করেছে রেল কর্তৃপক্ষ। রেলওয়েতে লাগেজভ্যান মূলত কৃষিপণ্য, যাত্রীদের ভারি মালপত্র ও ব্যবসায়িক পণ্য পরিবহনের কাজে ব্যবহৃত হয়। প্রতিটি দূরযাত্রার ট্রেনে এসব লাগেজভ্যান সংযোজন করা হয়। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সরকার নতুন ১২৫টি লাগেজভ্যান কেনার উদ্যোগ নিয়েছে। রেল সূত্র জানায়, বর্তমানে বাংলাদেশ রেলওয়েতে সচল লাগেজভ্যান রয়েছে ৬৩টি, এর মধ্যে ৫৩টি মিটার গেজের ট্রেনে ব্যবহার করা হয় আর ব্রডগেজে মাত্র ১০টি লাগেজভ্যান ব্যবহৃত হয়। নতুন প্রকল্পে ব্রডগেজ রেলপথে ৫০টি ও ৭৫টি মিটার গেজে চলার জন্য লাগেজভ্যান কেনা হচ্ছে। প্রতিটি ব্রডগেজ লাগেজভ্যানের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৩ কোটি ৫ লাখ টাকা ও প্রতিটি মিটারগেজ লাগেজভ্যানের প্রাক্কলিত দাম ধরা হয়েছে ২ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। জানা গেছে, ১৯৬৯ সালে রেলওয়েতে লাগেজভ্যান কেনার উদ্যোগ নেয়া হয় যার প্রথম বাস্তবায়ন হয় ১৯৭২ সালে। দীর্ঘ প্রায় ৫০ বছর পর লাগেজ কেনা না হওয়ায় লাগেজভ্যানের দরদাম সংক্রান্ত কোন তথ্য না থাকায় উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) তৈরিতে অনেক বেগ পেতে হয় রেলওয়েকে। ফলে রেল কর্তৃপক্ষের সম্প্রতি কেনা কোচের দামের ওপর ভিত্তি করে এসব লাগেজভ্যানের প্রাক্কলন তৈরি করা হয়েছে বলে জানা গেছে। রেলওয়েতে বর্তমানে মিটার গেজে চলার উপযোগী ২৩১টি খোলা ওয়াগন রয়েছে। যেগুলোর বয়সও প্রায় ৫৫ বছরে দাঁড়িয়েছে। তাই নতুন প্রকল্পের মাধ্যমে প্রায় অর্ধশতক পর খোলা ওয়াগন কেনা হচ্ছে। বর্তমানে রেলের বহরে সব মিলিয়ে কাভার্ড ওয়াগন আছে ৮২১টি। এসব ওয়াগনের বর্তমান বয়স ৩৭ বছর। মেকানিক্যাল কোড অনুযায়ী, একটি ওয়াগনের অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল ৪৫ বছর। অর্থাৎ কাভার্ড ওয়াগনগুলোরও আয়ু শেষদিকে এসে ঠেকেছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য প্রকল্পে নতুন করে মিটারগেজ রেলপথের জন্য ১৮০টি ও ব্রডগেজের জন্য ১২০টি খোলা ওয়াগন কেনা হচ্ছে। মিটার গেজের প্রতিটি খোলা ওয়াগনের দর প্রাক্কলন করা হয়েছে ৭০ লাখ টাকা ও প্রতিটি ব্রডগেজ খোলা ওয়াগনের দাম প্রাক্কলন করা হয়েছে ৯০ লাখ টাকা। এছাড়া ৭০০ কাভার্ড ওয়াগন কেনা হচ্ছে এর মধ্যে মিটারগেজ রেলপথের জন্য ৪০০টি ও ৩০০টি কাভার্ড ওয়াগন ব্রড গেজের জন্য কেনা হবে। প্রতিটি মিটারগেজ ওয়াগন ৮০ লাখ ও প্রতিটি ব্রডগেজ ওয়াগনের দাম ১ কোটি টাকা দর প্রাক্কলন করেছে রেলওয়ে। রেলওয়ের চলমান সমস্যা সমাধানে রেলপথমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন সম্প্রতি ইন্দোনেশিয়া সফর করেন। এ সময় চলমান লাগেজভ্যান, খোলা ওয়াগন ও কাভার্ড ওয়াগন কেনার টেন্ডার প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে ইন্দোনেশিয়া আগ্রহ দেখিয়েছে বলে জানা গেছে। সূত্র জানায়, মন্ত্রীর কাছে দেশটির রেল নির্মাতা প্রতিষ্ঠান পিটি ইনকা বাংলাদেশের জন্য ১ হাজার ৫০টি রেল কার সরবরাহের আগ্রহ দেখিয়েছে। এ বিষয়ে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের জ্যৈষ্ঠ সচিব মোফাজ্জেল হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, বাংলাদেশ রেলওয়েতে কয়েক যুগ ধরে চলে আসা সমস্যার সমাধান করতে লাগেজভ্যান, কাভার্ডভ্যান ও ইঞ্জিন সঙ্কট কাটাতে লাগেজভ্যান, খোলা ওয়াগন, কাভার্ড ওয়াগনসহ বিভিন্ন ধরনের রোলিং স্টক সংগ্রহে একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। ২০১৭ সালে শুরু হওয়া এ প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হবে ২০২১ সালে। পণ্য পরিবহন ও যাত্রীসেবার মাধ্যমে রেলসেবার বর্তমানের চেয়ে গতি আরও বাড়াতে মোট ১১শ’ ২৫টি লাগেজভ্যান খোলা ওয়াগন ও কাভার্ডভ্যান কেনার উদ্যোগে নেয়া প্রকল্পের আওতায় মোট ১২৫টি লাগেজভ্যান, ৩০০ খোলা ওয়াগন ও ৭০০ কাভার্ড ওয়াগন ও ৪০টি ব্রডগেজ ইঞ্জিনও (লোকোমোটিভ) কেনা হবে। উদ্যোগটি বাস্তবায়নে প্রায় ৩ হাজার ৬০২ কোটি টাকা ব্যয়ে সরকার রোলিং স্টক অপারেশন্স ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্ট অব বাংলাদেশ রেলওয়ে (রোলিং স্টক প্রকিউরমেন্ট) শীর্ষক একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে রেলপথ মন্ত্রনালয়। ২০১৭ সালে নেয়া এ প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হবে ২০২১ সালে। প্রকল্পে নেয়া উদ্যোগ বাস্তবায়নের মাধ্যমে অধিক পরিমানে নাগরিক সেবা প্রদান ও পণ্য পরিবহন সেবা বর্তমানের চেয়ে অনেক গতিশীল হবে। এসব রোলিং স্টক দিয়ে পণ্য পরিবহনের জন্য চারটি বিশেষায়িত ট্রেনও চালু করা সম্ভব হবে। ব্রডগেজ ও মিটারগেজ উভয় প্রকার রেলপথের জন্য এসব রোলিং স্টক কেনা হচ্ছে। এর প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে যাত্রীসেবার পাশপাশি পণ্য পরিবহনে এ যুগান্তকারী পরিবর্তনে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
×