ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ হযরত খাজা গরীবে নওয়াজ মুঈনুদ্দীন চিশ্তী (রহ.)

প্রকাশিত: ০৮:৪৫, ৬ মার্চ ২০২০

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ হযরত খাজা গরীবে নওয়াজ মুঈনুদ্দীন চিশ্তী (রহ.)

উপমহাদেশে ইসলাম প্রচারে সূফীয়ায়ে কেরামের অবদান যে সর্বাধিক এটা সর্বজনবিদিত। এ ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখেন হযরত খাজা মুঈনুদ্দীন চিশ্তী সঞ্জরী আজমীরী রহমাতুল্লাহি আলায়হি। তিনি জন্মগ্রহণ করেন ১১৪১ খ্রিস্টাব্দে পারস্যের সিজিস্তানের সঞ্জর নামক স্থানে। তাঁর আব্বা খাজা গিয়াসুদ্দীন রহমাতুল্লাহি আলায়হি এবং আম্মা বিবি মাহনুর রহমাতুল্লাহি আলায়হা। উভয় ছিলেন সেকালের নামকরা বুযুর্গ। খাজা মুঈনুদ্দীন চিশ্তীর আদুরে নাম ছিল হাসান। যে কারণে তাঁর নামের সঙ্গে হাসান নামও যুক্ত হয়। পরবর্তীকালে তিনি যেসব খেতাবে ভূষিত হন তাঁর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে : খাজায়ে খাজেগান, সুলতানুল হিন্দ, সুলতানুল আরিফীন, গরীবে নওয়াজ। এখানে তার গরীবে নওয়াজ খেতাবটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। গরীবে নওয়াজ অর্থ হচ্ছে অসহায় দরিদ্রজনের প্রতিপালক। বাস্তবেও তিনি হক্কুল্লাহ্ ও হক্কুল ইবাদের প্রতি সমান গুরুত্ব আরোপ করতেন, যে কারণে তিনি শরিয়ত, তরিকত, হকিকত ও মারিফাত সমন্বয়ে বিন্যাসিত ইলমে তাসাওউফ অর্জনের জন্য যে সমস্ত গুণাগুণ থাকা প্রয়োজন তাঁর মধ্যে একটি গুণ হিসেবে আর্তমানবতার সেবাকে যুক্ত করেছেন। এখনও প্রতিদিন তাঁর মাজার শরীফ চত্বরে স্থাপিত লঙ্গরখানায় শত শত দরিদ্রজন খাবার খেয়ে থাকে। খাজা মুঈনুদ্দীন চিশ্তী রহমাতুল্লাহি আলায়হি শৈশবেই কুরআন মজীদ হিফ্জ করেন। প্রাথমিক শিক্ষা তিনি লাভ করেন ইস্পাহানে, খোরাসানে। প্রায় পনেরো বছর বয়সে তিনি পিতৃহারা হন। পিতার সম্পত্তি থেকে তিনি একটি আঙ্গুরের বাগান এবং পানির স্রোতে চালিত যাঁতা (Water Mill) ফরায়েয অনুসারে লাভ করেন। একদিন তিনি বাগান দেখাশোনা করছিলেন। এমন সময় সেখানে হযরত ইব্রাহীম কুন্দুযী নামক একজন মজযুব দরবেশ সহসা হাজির হয়ে তার কাছে খেতে চাইলে তিনি তাকে কিছু আঙ্গুর খেতে দিলেন। এতে ওই মজযুব দরবেশ সন্তুষ্টি প্রকাশ করে তাঁর জন্য দোয়া করলেন এবং তিনি যে একজন মস্তবড় আল্লাহর ওলি হবেন তা বলে সহসা অদৃশ্য হয়ে গেলেন। এই ঘটনা তাঁর অন্তরে দারুণ আলোড়ন সৃষ্টি করল। কিশোর মুঈনুদ্দীনের মধ্যে আল্লাহর নৈকট্য লাভের স্পৃহা প্রবলভাবে জাগ্রত হলো। তিনি উত্তরাধিকারী সূত্রে প্রাপ্ত সম্পদ বিক্রি করে দিয়ে তার অর্থ গরিবদের মধ্যে বিলিয়ে দিলেন এবং আল্লাহর অন্বেষণের উদ্দেশ্যে গৃহত্যাগ করলেন। তিনি দীনি তালিম গ্রহণ করলেন খোরাসান, সমরকন্দ এবং বুখারার শ্রেষ্ঠ সব মাদ্রাসায় সেকালের মশহুর আলিমগণের কাছ থেকে। একপর্যায়ে তিনি বাগদাদ শরীফে গিয়ে পিরানে পীর দস্তগীর গওসুল আজম হযরত আবদুল কাদির জিলানী রহমাতুল্লাহি আলায়হির দরবারে গিয়ে তার দোয়া ও ফয়েজ লাভ করেন। তিনি অতি অল্প সময়ে ইলমে জাহিরের তাবত জ্ঞান ও বিদ্যা হাসিল করে উঁচু স্তরের আলিম হিসেবে মশহুর হন। তারপর তিনি ইলমে তাসাওউফ হাসিলের জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠেন। ৫৬০ হিজরীতে তিনি নিশাপুরের হারওয়ানের বিশিষ্ট সূফী হযরত খাজা আবুল মনসুর উসমান হারুনী রহমাতুল্লাহি আলায়হির খানকা শরীফে গিয়ে তাঁর হাতে বয়’আত হন। তিনি হযরত উসমান হারুনী রহমাতুল্লাহি আলায়হির খানকা শরীফে আড়াই বছরকাল অবস্থান করে পীর কেবলার নিকট থেকে তাসাওউফের তাবত তালিম গ্রহণ করে পূর্ণতা বা কামালিয়াত হাসিল করেন। পীর কেবলা উসমান হারুনী তাঁকে খিলাফতনামা ও খিরকা প্রদান করে তাকে খলিফা মনোনীত করেন। তিনি কারামত ও কাশ্ফ শক্তিসম্পন্ন এক মহান সূফীতে পরিণত হন। তিনি পীরের ইজাজত প্রাপ্ত হয়ে বাগদাদ শরীফের উদ্দেশে রওনা হন। পথিমধ্যে সাঞ্জান নামক স্থানে আর একজন বিশিষ্ট সূফী কুব্রাবিয়া তরিকা বিন্যাসকারী হযরত নজমুদ্দীন কুব্রা রাহমাতুল্লাহি আলায়হির সঙ্গে তাঁর মোলাকাত হয়। এখানে কয়েকদিন অবস্থান করে তিনি বাগদাদ শরীফে যান এবং হযরত গওসুল আজম আবদুল কাদির জিলানী রহমাতুল্লাহি আলায়হির সান্নিধ্য লাভ করেন। তিনি আট সপ্তাহকাল গওসুল আজমের সান্নিধ্যে থেকে তাসাওউফের সর্বোচ্চ মকামে উন্নীত হন। গওসুল আজম রহমাতুল্লাহি আলায়হির ফয়েজ ও তাওয়াজ্জুহর বরকতে তিনি বিলায়েতের অপরূপ সৌকর্য সুষমায় ম-িত হন। গওসুল আজম তাকে হিন্দুস্তানের রুহানী কর্তৃত্ব দ্বারা ভূষিত করেন। তিনি বিলায়েতের স্বীকৃতি লাভ করেন। বাগদাদ শরীফ থেকে তিনি বিভিন্ন দেশ ও শহর-নগর সফর করে বহু বুযুর্গের সান্নিধ্যে গিয়ে তাঁর অভিজ্ঞতাকে আরও সমৃদ্ধ করেন। তারপর তিনি মক্কা মুকাররমা গিয়েও বহু বুযুর্গের সঙ্গে মিলিত হন। মক্কা মুকাররমায় তিনি বেশ কিছুদিন অবস্থান করেন এবং হজ পালন করেন। তারপর তিনি মদিনা মনওয়ারায় এসে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের রওযা মুবারক জিয়ারত করেন। মদিনা মনওয়ারায় তিনি বেশ কিছু দিন অবস্থান করেন। চলবে... লেখক : পীর সাহেব দ্বারিয়াপুর শরীফ
×