ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

তরুণদের আসক্তিতে সোশ্যাল মিডিয়া

প্রকাশিত: ০৮:৩০, ৬ মার্চ ২০২০

 তরুণদের আসক্তিতে সোশ্যাল মিডিয়া

বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে প্রধান ও সর্বশ্রেষ্ঠ মাধ্যম হলো ফেসবুক। সামাজিক যোগাযোগের ধারণাকে সামনে নিয়ে সারা বিশ্বকে অনেকটাই অবাক করে দিয়েছে এই ফেসবুক। বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় সাইটের মধ্যে ফেসবুক এখন সর্বশ্রেষ্ঠ। ফেসবুক এমন একটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম; যা সারা বিশ্বকে সবার হাতের মুঠোয় নিয়ে এসেছে। মানুষকে এমন একটি প্লাটফর্মে নিয়ে এসেছে ফেসবুক, যা সামাজিক যোগাযোগকে সহজ থেকে অতি সহজ করে দিয়েছে। শুধু তাই নয়, বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ব্যবহারকারীদের কাছে দিন দিন আরও বেশি কাক্সিক্ষত হয়ে উঠছে নিত্যনতুন নানা সুবিধা যোগ হওয়ার কারণে। কিন্তু কিভাবে কে তৈরি করল এই ফেসবুক? তা নিয়ে মানুষের রয়েছে অগাধ কৌতূহল। যতদূর জানা যায়, আমেরিকান কম্পিউটার প্রোগ্রামার ও সফটওয়্যার ডেভেলপার মার্ক জাকারবার্গ হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তারুরুমমেট ও কম্পিউটার বিজ্ঞান বিষয়ের ছাত্র এডওয়ার্ডো সেভারিন, ডাস্টিন মস্কোভিৎস এবং ক্রিস হিউজেসের সাহায্য নিয়ে ফেসবুক নির্মাণ করেন বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের তরুণদের মধ্যে ফেসবুকের অবস্থান এখন চতুর্থ। ৫১ শতাংশ তরুণ-তরুণী এখনও ফেসবুক ব্যবহার করছে। কিন্তু ২০১৫ সাল থেকে বর্তমান সময়ে এসে ফেসবুক ২০ শতাংশ ব্যবহারকারী হারিয়েছে। পিউ রিসার্চ সেন্টার দেখেছে, তরুণরা সাম্প্রতিক দিনগুলোয় ঝুঁকছে ইউটিউবের দিকে। ২০১৫ সালের জরিপেও ইউটিউবের এত জয়-জয়কার ছিল না। ওই বছরে ৭১ শতাংশ কিশোর-তরুণ ছিল ফেসবুক ব্যবহারকারী। আর বর্তমান সময়ে এ-সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ৫১-তে। তবে জরিপে দেখা গেছে, এখনও বেশি আয়ের চেয়ে অপেক্ষাকৃত কম আয়ের পরিবারের সন্তানদের কাছে ফেসবুকের আবেদন বেশি। এখন তরুণরা স্মার্টফোন সহজে হাতের কাছে পেয়ে যাচ্ছে। পিউ রিসার্চ সেন্টারের মতে, ৯৫ শতাংশ তরুণের স্মার্টফোন আছে। ২০১৫ সালে এ-সংখ্যা ছিল ১০০ জনের মধ্যে ৭৩ জন। তরুণরা বলছে, তারা নিজেদের মতো ও কাজের কথা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে জানাতে পারে বলেই এদিকে ঝুঁকছে। নিজেদের সমস্যাও তারা নিজেদের মতো করে এখানে তুলে ধরতে পারে বলেই ঝুঁকছে সম্প্রতি মার্কিন রিসার্চ ইনস্টিটিউট ডাটা এ্যান্ড সোসাইটির একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ইন্টারনেট পুরুষের তুলনায় নারীদের জন্য বেশি ভয়ানক। কেননা অনলাইনে নারীদের হয়রানির শিকার হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। বিশ্বের পশ্চিমা সমাজে একজন মেয়ের খোলামেলা ছবি প্রকাশ বড় কোন বিষয় না। কিন্তু বাংলাদেশের রক্ষণশীল সমাজে এমন বিষয়ে মানুষ নানা নেতিবাচক মন্তব্য করেন, অপকর্মে লিপ্ত হন। নারীদের অবশ্যই ইন্টারনেট জগতে বিভিন্ন সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। এছাড়া নিজের কোন তথ্য বা ছবি প্রকাশের আগে অবশ্যই নিজের ব্যক্তিগত পরিধি নিয়ে চিন্তা করতে হবে। বর্তমান সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় কয়েকটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তুলে ধরা হলো। বর্তমানে দেখা যায়, তরুণদের স্মার্টফোনের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার বাবা-মায়ের দুশ্চিন্তার একটি বড় কারণ। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, খেলার মাঠ না থাকায় এবং বাইরে খেলাধুলার পরিবেশ না থাকার কারণে পিতামাতাই বিভিন্ন ইলেকট্রনিক খেলনা, মোবাইল ফোন, ভিডিও গেমস, ট্যাব, ল্যাপটপ, কম্পিউটার, টেলিভিশন ইত্যাদি দিয়ে শিশুদের ব্যস্ত রাখছেন। এমন বাবা-মায়ের অসচেতনতার কারণেই শিশুদের ডিজিটাল মিডিয়ায় আসক্তি বাড়ছে। অন্যদিকে এই ডিজিটাল মিডিয়া ব্যবহার করে নতুন নতুন উদ্ভাবন দিয়ে বিশ্বে তাক লাগিয়ে দিচ্ছে তরুণরা। মেধা বিকাশের পাশাপাশি সামাজিক, অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে এগিয়ে আসছে তরুণরা। ডিজিটাল মিডিয়ার ভাল-মন্দ দুটি দিকই আছে। তবে অনেকাংশে ডিজিটাল মাধ্যমের নিয়ন্ত্রণহীন ব্যবহারে অলস হয়ে তরুণদের কর্মক্ষমতা ও মানসিক শক্তি কমে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, দীর্ঘ সময় নিয়ে টেলিভিশন দেখলে বা বসে থাকলে শিশুদের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। ফলে অল্প বয়সেই শিশুর নানা সমস্যা দেখা দেয়। বাংলাদেশে যারা ইন্টারনেট সুবিধা ভোগ করেন, তাদের ৮০ শতাংশ মানুষের ফেসবুক এ্যাকাউন্ট আছে। এই ৮০ শতাংশ মানুষের সঙ্গে যুক্ত আছে দেশের বাইরে থাকা অসংখ্য বাংলা ভাষাভাষী মানুষ। বিজ্ঞজনরা বলছেন, একবিংশ শতাব্দীতে এসে ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম ও টুইটারের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আমাদের জীবনকে অনেকভাবেই সহজ করে তুলেছে- এটা সত্যি। কিন্তু এর বিপরীত দিকও আছে। এসব মাধ্যমের প্রতি আসক্তি এমন পর্যায়ে চলে গেছে, যে এর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে মানসপটে। তাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা সোশ্যাল মিডিয়ার সঠিক ব্যবহার ও অপব্যবহারেরও প্রতি স্পষ্ট ধারণা তৈরি করতে হবে। বাংলাদেশে প্রতিনিয়ত বাড়ছে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা। অনলাইনে যতগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আছে, তার মধ্যে ফেসবুকই সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। আর এই ফেসবুক ব্যবহারকারীদের একটি বড় অংশ তরুণ। বর্তমানে বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ৭ কোটি। মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১২ কোটিরও বেশি। প্রায় ৬ কোটি মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করেন নিজেদের মুঠোফোনে, আর তার অর্ধেক সংখ্যক মানুষ ফেসবুকে যুক্ত। মূলত এটি পারস্পরিক যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এর অনেক ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক আছে। কখনও কখনও ইতিবাচকতা বেশি। আজকাল ফেসবুকে বিভিন্ন ভাল কাজের প্রচার-প্রচারণা চলে, এমনকি ফেসবুকে পেজ তৈরি করে গড়ে উঠছে সামাজিক ব্যবসাও। কেউ কেউ ফেসবুকে লাইভ করেও হয়ে উঠছেন সেলিব্রেটি। অনেকেই রাজনীতি, অর্থনীতি, দর্শন, সাহিত্য ও সামাজিক বিষয় নিয়ে লিখেন। কোন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার খবরও সবচেয়ে বেশি ছড়ায় ফেসবুকের মাধ্যমে। এছাড়া তথ্যপ্রযুক্তি বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে ডিজিটাল মিডিয়া ব্যবহারকারীর সংখ্যা। নব্বই দশকেও শিশুদের দিনের অর্ধেক সময় কাটত খেলার মাঠে। কিন্তু বর্তমানে শিশুদের দেখা যায়, পুরো সময়টা ব্যস্ত মুঠোফোন কিংবা কম্পিউটার নিয়ে। ফেসবুক, বিভিন্ন চ্যাট, গেমসহ নানা সাইবার জগতে অবাধ বিচরণ করছে শিশুরা। শুধু শিশুরাই নয়, ডিজিটাল মিডিয়া প্রভাবিত করছে তরুণদেরও। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই ডিজিটাল মাধ্যমে আসক্ত হয়ে পড়ছে তারা। ডিজিটাল মিডিয়া অধিক ব্যবহারে যেমন শিশুদের মানসিক ও স্বাভাবিক বিকাশ ব্যাহত হচ্ছে, আবার সামাজিক ও পারিবারিক দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে ইন্টারনেট কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমনির্ভর অনেকেই ভুগছেন নিরাপত্তাহীনতায়। বিশেষ করে যেসব নারী ইন্টারনেট ব্যবহার করেন, এদের অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানাভাবে হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। ফেসবুক ও অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজের ছবি প্রকাশ করে হয়রানির শিকার হয়েছে এমন অনেক ঘটনাই আমরা দেখে থাকি। ইন্টারনেট বা অনলাইনভিত্তিক কাজের সঙ্গে যুক্ত আছেন এমন নারীর সংখ্যা অনেক। এছাড়া অনলাইন দ্বারা প্রতিনিয়তই কোন-না- কোনভাবে বাজে মন্তব্য, নির্যাতন এবং সাইবার বুলিংয়ের শিকার হচ্ছেন নারীরা। বাংলাদেশে ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোয় অপরাধ প্রবণতা বাড়ছে ক্রমান্বয়। ভিন্ন ভিন্ন ধরনের সাইবার অপরাধের শিকারে নারীর সংখ্যাটাই বেশি। সাম্প্রতিক তথ্য বলছে, সামাজিক যোগযোগের মাধ্যমে তরুণরা দিন দিন ফেসবুক থেকে নিজেদের সরিয়ে ইউটিউবসহ অন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোয় বুঁদ হয়ে থাকছে। সম্প্রতি এক গবেষণায় মিলেছে এমন তথ্য। গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিউ রিসার্চ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এক গবেষণা চালিয়ে এমন তথ্য পেয়েছে। জরিপে দেখা গেছে, ফেসবুক থেকে সরে যাচ্ছে তরুণরা। ফেসবুক ছেড়ে তারা ইউটিউবসহ অন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর দিকে ঝুঁকছে। সামাজিক যোগাযোগের জন্য ১৩ থেকে ১৭ বছরের কিশোরদের মধ্যে ফেসবুক এখন আর সবচেয়ে জনপ্রিয় প্ল্যাটফর্ম নয়। তালিকার প্রথম ৩টির মধ্যেও ফেসবুক এখন আর নেই। কেন তরুণরা ঝুঁকছে, তাও জানা গেছে জরিপে। পিউ রিসার্চ সেন্টারের জরিপের বরাত দিয়ে দ্য ভার্জ ডটকমের এক প্রতিবেদন বলছে, কিশোর-তরুণরা এখন ইউটিউবের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। এদের ৮৫ শতাংশই বলছে, তারা ইউটিউব ব্যবহারে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। এরপরই আছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছবি ও ভিডিও প্রকাশের শীর্ষ জনপ্রিয় দুটি এ্যাপ ইনস্টাগ্রাম ও স্ন্যাপচ্যাট। ইনস্টাগ্রাম ও স্ন্যাপচ্যাটের মধ্য লড়াইটাও বেশ। ইনস্টাগ্রাম পছন্দ করে ৭২ শতাংশ আর স্ন্যাপচ্যাট ৬৯ শতাংশ। পছন্দের জায়গায় টুইটার ৩২ শতাংশ ও রেডিট ৭ শতাংশ। তাহলে পরিষ্কার বোঝাই যাচ্ছে বর্তমান তরুণ প্রজন্ম কোনদিকে বেশি ধাবিত হচ্ছে। তাই তরুণ প্রজন্মকে নিয়ে নতুন করে ভাবনার সময় এসেছে। লেখক : শিক্ষাবিদ, লন্ডন প্রবাসী [email protected]
×