ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

আবু সাঈদ

কবি ও কবিতার রূপান্তর

প্রকাশিত: ০৬:৫৯, ৬ মার্চ ২০২০

 কবি ও কবিতার রূপান্তর

বিগত শতাব্দীর তিরিশের দশক থেকে ‘আধুনিক বাংলা কবিতা’ এ শব্দবন্ধটি বহুল উচ্চারিত এবং চর্চিত একটি শব্দ। এবং এ চর্চার সঙ্গে বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮-১৯৭৪) নামটিও খুবই প্রাসঙ্গিক এবং অবধারিতভাবে উচ্চারিত হয়ে আসছে। এ সময় বুদ্ধদেব বসুসহ আধুনিক অন্য কবিরা ঐতিহ্যিক ও রোমান্টিকতার একঘেঁয়ে কথন এবং প্রাচ্যের দীর্ঘদিনের চর্চিত ভাববলয় থেকে বাংলা কবিতাকে মুক্তি দেয়ার ঘোষণা দেন। এ মুক্তির যে প্রয়োজন ছিল তা রবীন্দ্রনাথের (১৮৬১-১৯৪১) মতো রোমান্টিক কবিও উপলব্ধি না করে পারেননি। এ সময়ের কবিরা রাবীন্দ্রিক আবগেকে বিসর্জন দিয়ে কালের বেগকে গ্রহণ করেন এবং ‘বাংলা কবিতাকে আধুনিকায়নের’ ঘোষণা দেন। বাংলা সাহিত্যে পাশ্চাত্য ঢংয়ে ও ভাবনায় কবিতা নির্মাণে যাঁরা অগ্রগামী ছিলেন তাঁদের মধ্যে বুদ্ধদেব বসু অন্যতম। ‘বন্দির বন্দনা’ (১৯৩০) কাব্যে তিনি নিজেকে এ ধারার ‘প্রধানতম পুরুষ’ হিসেবেও ঘোষণা করেছেন। এতদিন ধরে প্রথাগত বিশ্বাস, নীতি বা প্রেম সম্পর্কিত যে ধারণা বাংলা কবিতায় চর্চিত হচ্ছিল বুদ্ধদেব বসু তা আর মানলেন না। কবিতার বিমূর্ত-রূপকে তিনি রক্ত-মাংস যুক্ত করে মূর্ত করে তুললেন। প্রেমের অতিন্দ্রীয়রূপ, প্রেমিকার অশরীরী সত্তাকে কবি পার্থিব রূপ-রস-গন্ধময় করে জাগতিক এবং শারীরিক অবয়ব দিলেন। আত্মার সদ্্গতি নং, বরং পিপাসিত দেহকেই তিনি পূর্ণতা দিতে চান। বাসনার বক্ষোমাঝে কেঁদে মরে ক্ষুধিত দুর্দম বেদনা তার স্ফুটনের আগ্রহে অধীর। রক্তের আরক্ত লাজে লক্ষবর্ষ উপবাসী শৃঙ্গার কামনা রমণী-রমণ-রণে পরাজয়-ভিক্ষা মাগে নিতি; তাদের মেটাতে হয় বঞ্চনার দুর্দম বিক্ষোভে। (বন্দীর বন্দনা) এ পর্যায়ে বুদ্ধদেব বসু ছিলেন পুরোপুরি আত্মনিমগ্ন কবি। সামষ্টিক জীবন তাঁর কাম্য নয়, অন্বিষ্ট তাঁর আত্মকেন্দ্রিক জীবন। ‘জনতার জঘন্য মিতালি তাঁরও অসহ্য। বাস্তবতার নিষ্ঠুর নির্মমতায়, জনতার কোলাহলে, মানসিক উদ্বেগে, চিত্তের বিপন্নতায় এবং ননের উদ্বিগ্নতায় তিনি আক্রান্ত হচ্ছিলেন। প্রথম যৌবনে লেখা ‘বন্দির বন্দনা’ কাব্যে কবি যেভাবে আত্মনিমগ্ন ছিলেন পরবর্তী কাব্যগ্রন্থেও সে আত্মনিমগ্নতার ঘোর তাঁর কাটেনি। যুদ্ধ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, ধর্মঘট, কৃষক-আন্দোলন, তেভাগা আন্দোলনসহ মানবতার অপমান ও মনুষ্যত্বের পরাজয়-কোনকিছুই তাঁর কবিতাকে স্পর্শ করতে পারেনি। কারণ তাঁর অন্বিষ্ট রাজনীতি নয়, বিশুদ্ধ শিল্প। এমনকি রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলি-পরবর্তী কবিতাও নাকি তিনি অপছন্দ করতেন রাজনীতি-সমাজ মনষ্কতার জন্য। তিনি মনে করতেন এ নিমগ্নতাই আধুনিক কবিতা এবং রবীন্দ্র-কবিতার মূল পার্থক্য। এ সময় তিনি পুরোপুরি আত্মকেন্দ্রিক। সদ্য-নিদ্রা-জাগরিত গগনের পা-ুভাল’-পরে বহ্নিশিখা করিছে অর্পণ: কামনার বহ্নি সে যে, স্বপনের সলজ্জ বিকাশ। গোলাপের বর্ণে-বর্ণে স্বপ্নসুধা মাখা, আরক্তিম অ র নিয়ে একাকী বসিয়ে আছি আমি উচ্ছ্বসিত যৌবনের সিন্ধু তীরে। (শাপভ্রষ্ট) এ সময় বাংলা কবিতার বিষয়- বৈচিত্র্যে দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। এ পরিবর্তনের কারণ রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর পূর্ব-কবিদের বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট ও সময়ের বাসতবতার প্রতি যে নিষ্পৃহতা তার বিরোধিতা। ফলে বাংলা কবিতায় নতুনভাবে সংযোজন হয়; ভাষা এবং আঙ্গিকের পরিবর্তনের সঙ্গে আধুনিকতা ও আধুনিক-জীবন অনুষঙ্গের উপাদান বাংলা কবিতায় যুক্ত হয়। এ পরিবর্তনের প্রয়োজনে আবির্ভূত হন তিরিশের আধুনিক কবিরা। বুন্ধদেব বসুও এ সময় বিদ্রোহী সেজে আবির্ভূত হলেন। সাহিত্যে তিনি বিদ্রোহের সুর এবং নতুন স্বর আনলেন। তবে তা কাজী নজরুলের ইসলামের (১৮৯৯-১৯৭৬) মতো রাজনৈতিক বা উচ্চবাক্যে নয়; শিল্পীত এবং নম্রভাবে। বিধির বিধান লঙ্ঘি মানুষের জ্বল মহিমা- ব্রহ্মা-অম্বর-, মধ্যে অনির্বাণ গৌরবসবিতা। আমি কবি, এ সংগীত রচিয়াছি উদ্দীপ্ত উল্লাসে, এই গর্ব মো- আমি যে রচিতোব কাব্য, এ উদ্দেশ্য ছিল না স্রষ্টার! তবু কাব্য রচিলাম। এই গর্ব বিদ্রোহ আমার। (মানুষ) এ দাম্ভিকতা যৌবনের। এ বিদ্রোহ আসলে রাবীন্দ্রিকতার বিরুদ্ধে। রবীন্দ্র-কবিতার আবেগের প্রাবল্য, ভাবালুতা ও আতিশস্যকে পরিহার করে আধুনিক বাংলা কবিতার যাত্রা শুরু। এ আরম্ভের প্রারম্ভিক কালটা ছিল প্রথম মহাযুদ্ধ শেষ এবং ‘দ্বিতীয় মহাসমরের পটভূমিকায়’। এ সময়ে এতদিনকার মানবিক মূল্যবোধগুলো খসে পড়ছিল। এবং এ সম্পর্কে প্রথাগত ধারণারও পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। ফরে মনে ও মননে, সত্য-সুন্দর ও কল্যাণে, মানুষের বাহ্যিক চেহারায় এবং আবেগ-অনুভূতির ভিতরে যে কদর্যতা রয়েছে, যে আদিমতা রয়েছে তা প্রকাশে আধুনিক কবিরা সচেষ্টা ছিলেন। বুদ্ধদেব বসু রূপ-লাবণ্যময় চেহারার গভীরে যে কুৎসিৎ কঙ্কাল, সে কঙ্কালকে বের করে আনলেন। এতদিন ধরে এ মূলভিত্তিকেই অগোচরে রাখা হয়েছে, আড়াল করে রাখা হয়েছে। কিন্তু প্রথম মহাসমরোত্তরে পুঁজিবাদের খোলস উন্মোচিত হচ্ছে। বুর্জোয়া মানবতাবোধর লাঞ্ছিত এবং লঙ্ঘিত হচ্ছে। জৈবিকভাবে মানুষের বাহ্যিক আবরণও খসে পড়তে শুরু করেছে। বের হয়ে পড়েছে তার ভিতরের কুৎসিত কঙ্কাল। ফলে নগ্নতা, হিংস্রতা, লোভ, লাভ আর অমানবিকতা প্রকাশ পাচ্ছে নির্লজ্জভাবে। নতুন ননীর মতো তনু তব? জানি, তার ভিত্তিমূলে রহিয়াছে কুৎসিত কংকাল- (ওগো কঙ্কাবতী) মৃত-পীত বর্ণ তার : খড়ির মতন শাদা শুষ্ক অস্থিশ্রেণী- জানি, সে কিসের মূর্তি। নিঃশব্দ, বীভৎস এক রুক্ষ অট্টহাসি- নিদারুণ হীন বিভীষিকা। (প্রেমিক) কুৎসিত এ কঙ্কাল প্রতীকায়িত করেছে তাঁর সমকাল, সমাজ, রাজনীতিকেও মনোজাগতিক বিশ্বকে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তরে এ সময়ে অনিশ্চয়তা, সমাজ-রাজনীতিতে বিশৃঙ্খলা, অর্থনীতিতে মন্দা, মানবাচরণে অসংগতি, ব্যবহারে অসংযত পরিলক্ষিত হচ্ছিল। অর্থাৎ সময়, সমাজ, রাজনীতির মধ্যে স্থিতি তো নেই বরং অনিশ্চয়তা, নির্বেদ, হতাশা, যান্ত্রিকতা ভর করছে মানুষের ওপর। এ প্রেক্ষাপটে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-রাজনীতি এমনকি শাশ্বত প্রেমের ঐতিহ্যিক যে ধারা-সে ধারাকে আধুনিক কবিরা অস্বীকার না করে পারলেন না। বুদ্ধদেব বসু ও যুগধর্মের এ চাহিদাকে স্বীকার করে নিলেন। এরপর তিনি বিদ্রোহ করলেন। তাঁর এ বিদ্রোহ ছিল ধ্বংসের নয়, সৃষ্টির; মৃত্যুর নয়, নবজন্মের; ক্ষয়িষ্ণু নয়, বর্ধিষ্ণু; স্থিতি নয়, গতির এবং প্রগতির। শীতের পর যেমন বস; জরা-মৃত্যুর পর তেমনি নব-জীবনের অভ্যুদয়। প্রথম জীবনে তিনি প্রতিশ্রুত ছিলেন ‘বিশুদ্ধ কাব্য’ সৃষ্টিতে নিবেদিত থাকবেন সমাজ-সংসার, রাজনীতি-সমাজনীতিকে ভুলে থেকে। ভেবেছিলেন সাহিত্যরচনা এবং ‘সমাজচেতনা জগৎ সম্পূর্ণই আলাদা’ কিন্তু পরবর্তীকালে দেখলেন ‘বিশুদ্ধ কাব্য’ সৃষ্টি সম্ভব নয়, যদি বিশুদ্ধ সমাজ না থাকে। এ বিশুদ্ধ সমাজ সৃষ্টির জন্যই তিনি ফ্যাসিবিরোধী লেখক সংঘের সঙ্গে যুক্ত হন। প্রগতিশীল লেখক সংঘের আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু হয় ১৯৩৬ সালে। এ সময় ফ্যাসি-শক্তি সারাবিশ্বে মরণ কামড় দিতে উদ্যত হয়। এ ভয়াবহতা থেকে মানবজাতিকে রক্ষার জন্য কী লেখক-শিল্পী-সাহিত্যিকদের কিছুই করার নেই? মূলত সে দায়বোধ থেকে এ সংঘের যাত্রা। বুদ্ধদেব বসুও যুক্ত হলেন সে দায়বোধ থেকে। তিনি রাজনীতি সচেতন হলেন। রাজনৈতিক ঘটনা তাঁর চিন্তা এবং একই সঙ্গে কবিতার রূপ ও রীতির পরিবর্তন ঘটাতে থাকে। তখন নিভৃত থেকে কবিতা রচনা অসম্ভব হয়ে পড়ে তাঁর জন্য। এ সময় তিনি সামাজিক দায়বদ্ধ শিল্পী-লেখকদের সঙ্গে একাত্মতায় যুক্ত হন। এতদিন ধরে তিনি বিশুদ্ধ শিল্পচিন্তার জন্য রাজনীতিকে বর্জন করে আসছিলেন। এবার আর রাজনীতিতে সক্রিয় না হয়ে পারলেন না। তিনি আর আত্মনিমগ্ন থাকতে পারলেন না। মানবতা যেখানে অপমানিত হচ্ছে, সেখানে আত্মকেন্দ্রিকতা মানে আত্মহত্যা এবং ধ্বংস। তিনি দেখছেন সা¤্রাজ্যবাদী শক্তি ও ফ্যাসিস্ট শক্তি তৃতীয় বিশ্বসহ পুরো বিশ্বকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে। এ প্রেক্ষাপটে সমাজের সঙ্গে কবিদের বিচ্ছেদকে তিনি আর মানতে পারছেন না। একসময় তিনি রাজনীতি-সমাজনীতিকে শিল্পের প্রতিবন্ধক মনে করতেন। এখন তিনি অত্যধিক সমাজ ও রাজনীতিমনস্ক হয়ে উঠলেন। এখন তাঁর কাছে একটি অপরের পরিপূরক হয়ে উঠল। এমনকি এসময় তিনি সমাজ ও রাজনীতির সঙ্গে সংস্কৃতিকেও এক করে দেখছেন। কারণ সংস্কৃতিই পারে মানুষকে ঐক্য করতে। ফলে তিনি কাব্যের মুক্তির জন্য সমতার উত্থান কামনা করছেন। খন্ডিত নয়, তিন পূর্ণতা চান। বিশ্বায়ন নয়, তিনি আন্তর্জাতিকতার প্রতি গুরুত্বারোপ করছেন। কারণ ‘বিশ্ব মানবিকতার’ জন্য প্রয়োজন এ আন্তর্জাতিকতার। তা না হলে বিশ্বযুদ্ধের পুনরাবৃত্তি হবে বলেও তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। একটি প্রবন্ধে তিনি বলছেন, ‘সংস্কৃতিকে অবলম্বন করেই মানুষের মনে বিশ্বমানবিকতার আবহাওয়া রচনা করতে হবে, তবে যদি সভ্যতাকে বাঁচানো যায়। এ কাজে আমরা তাঁদেরই পাব যাঁরা ধূর্ত গণপতি কি দাম্ভিক ধনপতি নন, যাঁরা মানুষের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, যাঁরা জীবনসাধনায় অগ্রণী- তাঁরা কবি তাঁরা শিল্পী তাঁরা প্রেমিক। নতুন জগৎ রচনার ভার আসলেই তাঁদেরই হাতে, কারণ প্রকৃতপক্ষে নিঃস্বার্থ শুধু তাঁরাই। স্বজাতিবোধ যদি মানুষের মন থেকে উচ্ছিন্ন না হয়, যদি প্রত্যেক মানুষই বিশ্বমানবিকতার প্রীতিপূর্ণ উদার আনন্দে দীক্ষিত না হয়, তা’হলে কুড়ি বছর পরপর ‘বৈজ্ঞানিক’ যুদ্ধের জগৎব্যাপী পৈশাচিকতায় সভ্যতার টিকে থাকবার আশা কম। স্বজাতিবোধের বদলে বিশুদ্ধ মনুষ্যত্বের চেতনা জাগলে যুদ্ধের মূল কারণ না হোক, মূল প্রেরণা দূর হয়ে যায়’ (স্বজাতিকতা, দেশপ্রেম, বিশ্বমানবিকতা)। ‘ব্যক্তিজীবনে বিশ্বাসী’ বুদ্ধদেব বসুর মধ্যে এবার সামাজিক জীবনের উত্থান হচ্ছে। তাঁর এ মৌলিক পরিবর্তনকে তিনি নিজেও উপলব্ধি করতে পারছেন। আর আমার মধ্যে কী যেন ভেঙে যাচ্ছে পাথর যেমন ভেঙে যায় পৃথিবীর অন্তর্লীন ভীষণ আগুনে চাপে। আর আমার মধ্যে কী যেন গড়ে উঠছে জমে উঠছে, (নতুন দিন) এক সময় কবির মধ্য যে আত্মশ্লাঘা পরিলক্ষিত হয়েছিল তা থেকে এবার তিনি নিজেকে মুক্ত করলেন। এখন কবির ব্যক্তিজীবন সমাজ-জীবনের সঙ্গে অন্বিত হলো। এবার তিনি সামাজিক মানুষ হিসেবেই দেখা দিলেন। ব্যক্তিজীবনকে অতিক্রম করে তিনি এবার যাত্রা করলেন সামষ্টিক জীবনের দিকে।
×