ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

রাকিব হাসান

অসম ভালো লাগা ও হারিয়ে যাওয়া স্মৃতির গল্প

প্রকাশিত: ০৬:৫৫, ৬ মার্চ ২০২০

 অসম ভালো লাগা ও হারিয়ে যাওয়া স্মৃতির গল্প

রোমানিয়া হয় তো বা এ দেশটি আমাদের দেশের মানুষের কাছে খুব বেশি একটা পরিচিত কোন নাম নয়, আবার পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোতে যাঁরা বসবাস করেন যেমন- জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি, সুইডেন, নরওয়ে, ডেনমার্ক, স্পেন তাঁদের অনেকেই এ দেশটির নাম শুনলে আঁতকে উঠবেন। তবে যদি কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করেন যে আমার জন্মভূমি বাংলাদেশের পর কোন দেশটিকে আমি সবার আগে পছন্দ করবো; আমি নিঃসন্দেহে সবার আগে কোন ধরনের চিন্তা-ভাবনা না করেই সরাসরি রোমানিয়ার নাম বলব। এ দেশের ভাষা, সংস্কৃতি এবং এখানকার মানুষের আন্তরিকতা ও ভালোবাসা আমাকে এতটাই মুগ্ধ করেছে যে কেন জানি বার বার আমার রোমানিয়াতে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে। এ দেশটি সত্যিকার অর্থে আমার কাছে ভালোবাসার অপর একটি নাম। রোমানিয়ার রাজধানী বুখারেস্টকে পূর্ব ইউরোপের প্যারিস বলা হয়, বিভিন্ন কারণে রোমানিয়া ভ্রমণের এ স্মৃতি আমার অন্তরে সব সময় অম্লান। যান্ত্রিকতায় পরিপূর্ণ ইউরোপে আজকের এ যুগেও যে মানুষ এত আন্তরিক হতে পারে সেটা রোমানিয়া না গেলে বিশ্বাসই করতাম না। আর সম্পূর্ণ রোমানিয়া ভ্রমণে যতগুলো মহৎ হৃদয়ের মানুষের সাক্ষাৎ পেয়েছি তাঁদের মধ্য থেকে এ বিশেষ একজনের কথা স্বীকার না করলে হয় তো বা অনেক বড় একটি পাপ হয়ে যাবে। আলিনা ক্রিস্টিনা উদরেস্কু!!! যদি কেউ আমাকে বলে থাকেন যে আমার জীবনের কতোগুলো বিশেষ প্রাপ্তি যেগুলো উল্লেখ না করলেই নয় তাহলে আমি নিঃসন্দেহে এ নামটি সবার উপরের দিকে রাখবো। আসলে আমার এ রোমানিয়া ভ্রমণের অভিজ্ঞতাকে সাত রঙে সম্পূর্ণভাবে রাঙাতে পেরেছি এ আলিনা ক্রিস্টিনা উদরেস্কু এর কারণে। আলিনা ক্রিস্টিনা উদরেস্কুর সঙ্গে আমার পরিচয় হয় ২০১৪ সালে, তখন আমি কেবল ইন্টারমিডিয়েট সেকেন্ড ইয়ারের স্টুডেন্ট। যদিও আমি ফেসবুক ব্যবহার করি ২০১০ সাল থেকে কিন্তু মোটামুটি আজকের মতো এ রকম নিয়মিতভাবে ফেসবুক ব্যবহার শুরু করি সে বছরই। সে সময় আমার মোটর স্পোর্টসের প্রতি আলাদা আগ্রহ ছিল, বিভিন্ন ফেসবুক পেইজে গিয়ে সে সময় বিভিন্ন স্পোর্টস বাইকারদের ছবি খুঁজে বের করে তাঁদেরকে ম্যাসেজ করাটা কেন জানি আমার একটি অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। এভাবে হঠাৎ করে একদিন কোনও এক ফেসবুক পেইজে যেতে না যেতেই ক্রিস্টিনার ছবি আমার চোখে ভেসে আসে এবং ছবির নিচে তাঁর নাম লিখা ছিলো। আমি তখন ফেসবুকে তাঁর নাম লিখে সার্চ করলাম এবং তাঁর ফেসবুক আইডি খুঁজে পেলাম। এরপর আমি তাঁকে একটি ম্যাসেজ করলাম আমার পরিচয় দিয়ে এবং আমি বললাম যে আমি তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনে আগ্রহী। কিছুক্ষণ পর দেখলাম ক্রিস্টিনা আমাকে ম্যাসেজ করলো এবং আমাকে বললো তাঁকে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠানোর জন্য, এরপর আমি তাঁকে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠালাম এবং সে আমাকে তাঁর ফেসবুক ফ্রেন্ড হিসেবে গ্রহণও করলো। এরপর আমাকে সে প্রশ্ন করলো, “Are you happy to be my friend? আমি তাঁকে উত্তর দিলাম Why not? Its one my pleasures that I have been able to become a friend of yours. তারপর তাঁকে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করলাম বিশেষ করে মোটর স্পোর্স এবং এখানে কিভাবে সে এলো কিংবা তাঁর বিভিন্ন অভিজ্ঞতা নিয়ে অনেক আলোচনা হলো। এভাবেই ক্রিস্টিনার সঙ্গে আমার পরিচয়। ইন্টারমিডিয়েট পাস করার পর ইউনিভার্সিটির ভর্তি কোচিং, বাইরে যাওয়ার প্রস্তুতি সব মিলিয়ে আসলে এতটা ব্যস্ত হয়ে পড়লাম এবং সেই সঙ্গে আসলে বেশ কিছু পারিপার্শ্বিকতার কারণে কেন জানি এ আগ্রহটি আবার আমার মধ্য থেকে হারিয়ে গিয়েছিলো এবং একটা দীর্ঘ সময় প্রায় আড়াই বছর এরপর আর ক্রিস্টিনার সঙ্গে কখনও যোগাযোগ হয়নি সেভাবে। ২০১৮ সালের মার্চের শেষ এবং এপ্রিল মাসের শুরু এমন সময় ক্যাথলিক চার্চগুলোতে বিশ্বাসী মানুষেরা ইস্টার উৎসবে মেতে উঠে এবং বলা হয়ে থাকে যে বড় দিন বা খ্রিস্টমাসের পর ক্যাথলিক চার্চে বিশ্বাসী মানুষদের কাছে সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব হচ্ছে ‘ইস্টার’। ইস্টারের ছুটিতে বেরিয়ে পড়লাম বুলগেরিয়া এবং রোমানিয়া ঘুরতে, বলাবাহুল্য ইউরোপ আসার পর এটি ছিলো আমার প্রথম কোন ট্রিপ নিজের থেকে। জীবনে অনেক বসন্ত এসেছে কিন্তু কেনও জানি এ ‘রোমানিয়া’ এবং ‘ক্রিস্টিনা’ এ দুটি শব্দের কথা স্মৃতিপটে ভেসে আসলে মনে হয় যে জীবনের শ্রেষ্ঠ বসন্তটি ঐ সময়ই বুঝি ফেলে চলে এসেছি। এদিনটিতে সত্যিকার অর্থে আমি হেসেছিলাম, আবার এ দিনটি আমাকে কাঁদিয়েছিলো শেষ বিকেলে সব কিছু শূন্য করে। বুখারেস্টে ঘুরার জন্য যখন পরিকল্পনা করি তখনই ম্যাসেজ দিই হঠাৎ করেই ক্রিস্টিনাকে, ফেসবুকের ভার্চুয়াল জগৎ থেকে বের করে এবার সত্যি সত্যি সামনাসামনি তাঁকে দেখার আগ্রহ প্রকাশ করি। ক্রিস্টিনার বাসা ছিলো আলেকজানদ্রু আইওয়ান কুজা পার্কের কাছে। বুখারেস্টের সিটি সেন্টার থেকে বেশ খানিকটা দূরে এবং সম্পূর্ণ কোলাহল ও নির্ঝঞ্ঝাটমুক্ত একটি জায়গা। ট্রাফিক জ্যাম বুখারেস্টে বসবাস করা সাধারণ মানুষদের কাছে নিত্যদিনের প্রধান সমস্যা, আসলে বুখারেস্টের স্থানীয় প্রশাসন যানবাহনের ওপর অনেক ভর্তুকি প্রদান করে এবং এ কারণে শহরের বেশির ভাগ জায়গাতেই সে অর্থে গাড়ি পার্কিং করতে তেমন খরচ হয় না আর এ কারণে সবাই যে যাঁর মতো পারে যেখানে সেখানে গাড়ি পার্ক করে রাখে যা শহরটিতে যানজট সৃষ্টির প্রধান একটি কারণ। সেই সঙ্গে গাড়ির হর্নের শব্দ তো আছেই। কিন্তু এ জায়গাটি পুরোপুরি নীরব এবং শান্তিতে মনের আনন্দে নিঃশ্বাস নেওয়ার একটি আদর্শ জায়গা বলা চলে। ক্রিস্টিনা আমাকে আলেকজান্দ্রু আইওয়ান কুজা পার্কে আসার জন্য বললো। আমাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে ক্রিস্টিনা আমাকে জড়িয়ে ধরল এবং আমার গালে একটা চুমু আঁকলো। সে এক অনাবিল প্রশান্তি!!! পৃথিবীতে এর থেকে প্রশান্তির খুব কম জিনিসই আছে। আমরা বেশ কিছু ক্ষণ একসঙ্গে পার্কের ভেতর হাঁটাহাঁটি করলাম, ক্রিস্টিনা আসলে সম্পূর্ণ বিপরীত জগতের একজন মানুষ। তবে তাঁর মধ্যে সৃষ্টিশীল ব্যক্তিসত্তা রয়েছে যা সত্যি আমাকে মুগ্ধ করেছে। ক্রিস্টিনা প্রকৃতির বিভিন্ন ছবি তুলতে ভীষণ ভালোবাসে। কখনও গাছ কিংবা গাছের পাতা, ঘাস, পাখি, কাঠবিড়ালী এ সবের ছবি তোলে। কিছুক্ষণ পার্কে বসে গল্প করার পর আমরা চলে গেলাম পার্কের ঠিক বিপরীতে থাকা একটি শপিং মলে। শপিং মলের ছাদে চিলেকোঠায় একটা রেস্টুরেন্ট ও কফি বার রয়েছে। সেখান থেকে পুরো পার্কের অসাধারণ একটি ভিউ পাওয়া যায়। আমি সারাদিন ঘোরাঘুরির কারণে বেশ তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়েছিলাম, এ জন্য আমি কোকা কোলা অর্ডার করলাম আর ক্রিস্টিনা কফি অর্ডার করলো। এরপর অনেক ক্ষণ একসঙ্গে গল্প হলো, বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হলো। ক্রিস্টিনার বর্তমান বয়স প্রায় বত্রিশ যেখানে আমার বয়স মাত্র বাইশ। আমার থেকেও দশ বছরের বড় কিন্তু তারপরেও কেনও জানি যখন ক্রিস্টিনার কথা মনে পড়ে তখন আমার মনের থেকে অন্য রকম কিছু একটা উপলব্ধি হয়। কোনও এক অজানা কারণে আমি দুর্বল হয়ে পড়ি। ২০১৮ সালে আমার আবিষ্কার করা সবচেয়ে সুন্দর জিনিসটি ছিল এ ক্রিস্টিনা। ২০১৪ সালে যাঁর সঙ্গে আমার ফেসবুকে পরিচয় হয়েছিলও। কখনও ভাবিনি যে সামনাসামনি এভাবে দেখা করতে পারবো কিংবা ফেসবুকে ভার্চুয়ালি পরিচয় হওয়া কোন একজন মানুষও যে এতটা সুন্দর হতে পারে সেটা কখনও কল্পনায় ছিল না। জীবনের অন্যতম সেরা একটা অভিজ্ঞতা পেয়েছি আমি এ ক্রিস্টিনার থেকে। এক সঙ্গে সে কফি বারে কিছু সময় অতিবাহিত করার পর আমরা আবার কিছুক্ষণ একসঙ্গে আবারও পার্কে গিয়ে হাঁটাহাঁটি করি। ক্রিস্টিনা আমাদের সবার থেকে আলাদা, সে চায় জীবনটাকে উপভোগ করতে। নিজের ইচ্ছাশক্তির ওপর বেঁচে থাকতে, সমাজের সকল প্রথাকে সে ভাঙতে চায়। আমরা আজকে অনেকেই ইন্টারমিডিয়েট পাস করার পর একটা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার জন্য ডুকরে কেঁদে পরে আর সেই ইউনিভার্সিটিকে সে প্রত্যাখ্যান করে চলে আসে এই বলে যে প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান অর্জনের থেকে বাস্তবিকভাবে কোন জ্ঞান অর্জন এবং সেই সঙ্গে নিজের অর্জিত অভিজ্ঞতাকে সমাজের মানুষের কল্যাণে ব্যয় করাটাই প্রকৃত স্বার্থকতা। কর্পোরেটক্রেসিকে সে পুরোপুরি ভেঙ্গে দিতে চায়। আমাদের সকলের চিন্তার বাইরে গিয়েও সে নিজেকে মেলে ধরতে চায়। এক সঙ্গে কিছু ছবি তুলি, ততোক্ষণে বিকেল হয়ে গিয়েছে আর আমার ফেরার সময়ও হয়ে গিয়েছে। ফিরে যাওয়ার বাসার ছাড়ার সময়ও হয়ে এসেছে। ক্রিস্টিনা আমাকে মেট্রো স্টেশন পর্যন্ত এগিয়ে দেয়। সেখানে দায়িত্বে থাকা এক পুলিশ সদস্যকে আমরা অনুরোধ করি আমাদের আরও কিছু ছবি তুলে দেওয়ার জন্য। তিনি দায়িত্ব -অবস্থায়ও আমাদের অনুরোধ রাখেন আন্তরিকতার সঙ্গে। এরপর আমি ক্রিস্টিনাকে বিদায় জানিয়ে মেট্রোতে উঠে পড়ি সে মিলিটারি অটোগারার উদ্দেশ্যে যেখান থেকে আমার বাস ছাড়ার কথা ছিল। বিদায় লগ্নে ক্রিস্টিনা আমাকে আরও দুইবার জড়িয়ে ধরেছিল এবং আমার গালে চুমু এঁকেছিল। সে এমন এক স্বাদ যে স্বাদ পৃথিবীর সমস্ত ঝালকে কিংবা তেতোকে এক নিমেষে পৃথিবীর সবচেয়ে সুমিষ্ট কোন বস্তুতে পরিণত করতে পারে। এরপর? এরপর আবার সেই আগের জীবন। সেই ভার্সিটি, পড়াশোনা, ব্যক্তিগত বিভিন্ন চাপ তবে ক্রিস্টিনার সঙ্গে সেইদিনের সে মুহূর্তগুলো সব সময়ই আমার হৃদয়ে চির ভাস্কর। জানি না সে ভালো লাগা আদৌতে কোন ভালোবাসায় পরিণত হলো কি না তবে জানি যদি সেটা ভালোবাসায় পরিণত হয়ও কোনও দিন্ সেটাকে বাস্তবায়িত করাও সম্ভব নয় কেননা আমাদের সমাজে এ ধরনের অসম প্রেম কাহিনীগুলো কখনও স্বার্থকতা লাভ করে না। আমি জানি না কেনও তবে ছোটো বেলা থেকেই আমি দেখেছি আমাদের দাদা-দাদী কিংবা নানা-নানি এমনকি আমাদের বাবা-মার সময়ের মানুষেরাও যখন বাড়িতে কোন ছেলের জন্য পাত্রী অনুসন্ধানে বের হতো সব সময় চেষ্টা করে এমন কাউকে খুঁজে বের করতে যাঁর বয়স কি না পাত্রের বয়সের তুলনায় অন্তত পাঁচ বছরের নিচে। আমাদের সমাজে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এ ধরনের ভালোবাসা আসলে শেষ পর্যন্ত অসমাপ্ত থেকে যায়, অন্তত আমাদের মধ্যবিত্ত সমাজে কোনও বাবা-মাই মেনে নিবে না যে তাঁর ছেলে এমন কাউকে বিয়ে করুক যিনি কি না তাঁর ছেলের তুলনায় বয়সে বড়। এখনও মাঝে মধ্যে ফেসবুকে যোগাযোগ হয় ক্রিস্টিনার সঙ্গে, আসলে এখন ক্রিস্টিনার সময়টা খুব ভালো যাচ্ছে না। বছর দুইয়েক আগে তাঁর বাবাও মারা যায় এবং তাঁর মা এখন বয়সে অনেকটা বৃদ্ধ। এক ধরনের টানা-পোড়নের মধ্য দিয়ে সে যাচ্ছে। মোটর স্পোর্টস নিঃসন্দেহে অনেক ব্যয়বহুল, তাই নিয়মিতভাবে মোটর স্পোর্টসে সে অংশ নিতে পারছেও না। এদিকে তার বয়স ত্রিশ পেরিয়ে গেছে, এখনও যদিও সে যথেষ্ট ফিট কিন্তু তবুও কেন জানি সে স্পন্সর পাচ্ছে না তাঁর মাধ্যমে সে আসলে আবার কাক্সিক্ষতভাবে রেসিং ট্র্যাকে ফিরে আসবে। পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার ওপর সে খুবই বিরক্ত কেননা তাঁর বক্তব্য হচ্ছে পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা এমন একটি অর্থনৈতিক সিস্টেমের জন্ম দেয় যেখানে মানুষের কোন স্বপ্ন থেকে আরম্ভ করে নিত্যপ্রয়োজনীয় মৌলিক অধিকার এমনকি চিকিৎসা সেবার মতো মানবিক বিষয়গুলোও বাণিজ্যের একটি বিষয় হিসেবে পরিণত হয়। নতুন করে মোটর বাইক কেনা এমনকি তাঁর এখন যে বাইকটি রয়েছে বেশ পুরনো বাইক সেটাতে চাকার মেরামত করতে যে খরচটুকু প্রয়োজন সেটিও তাঁর হাতে নেই। আমার রোমানিয়া যদিও বর্তমানে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে কিন্তু তারপরেও এখনও দেশটির সাধারণ মানুষের আয় ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অন্যান্য দেশ থেকে অনেক নিচে। মানুষ বাঁচে আশায়, ক্রিস্টিনা এখনও স্বপ্ন দেখে যে তাঁর এ দুরাবস্থা কোন একদিন দূর হবে এবং সে আবারও মোটর স্পোর্টসে তাঁর হারানো অর্জনকে ফিরিয়ে আনবে। অপুর জীবনে কোনও দিন্ আর হৈমন্তি ফিরে এসেছি কি না এটা জানা না গেলেও আমার এরপর আর কোন দিন্ ক্রিস্টিনার সঙ্গে দেখা হয়নি। তবে ক্রিস্টিনা আমার অবচেতন মনে হয় তো বা ক্ষণিকের এক হৈমন্তি যাঁর হাসিটুকু আমি সব সময় খুঁজে বেড়াই। জানি না আর কোন দিন্ দেখাও হবে কি না ক্রিস্টিনার সঙ্গে তবে যদি কোন দিন্ একটা টাইম মেশিন বানাতে পারি আমি চেষ্টা করবো বসন্তের সেদিনের সে বিকেলে আবার হারিয়ে যেতে। ক্রিস্টিনার সঙ্গে করে আমি পুরো পৃথিবী দেখতে চাই, তাকে জড়িয়ে ধরে আবারও তাঁর গালে চুমু আঁকতে চাই। বেশ কয়েক বছর আগে একটি সিনেমা দেখেছিলাম, এটি ছিল একটি ইতালিয়ান সিনেমা। এ সিনেমার কাহিনী এতটাই অসাধারণ ছিল যে পরবর্তীতে সেরা বিদেশী ভাষার সিনেমা হিসেবে এটি অস্কার পুরস্কারের সম্মাননা অর্জন করেছিল, সিনেমার নাম ‘মালে না’। মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইতালির সিসিলিতে বারো বছরের এক কিশোর রেনাতোর সঙ্গে তার এক শিক্ষিকা যাঁর নাম ছিল মালেনা (যিনি মূলত এ সিনেমার কেন্দ্রীয় চরিত্র); মালেনার প্রতি তাঁর দুর্বলতা এবং ভাল লাগার কাহিনী নিয়ে। নিঃসন্দেহে এটি ছিল একটি অসম প্রেম কাহিনী কেননা রেনাতোর সঙ্গে মালেনার বয়সের পার্থক্য ছিল অনেক বেশি এবং মালেনা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তাঁর স্বামীকেও হারিয়েছিল। কাছে আসার সব গল্পই পূর্ণতা পায় না। সিনেমার শেষ অংশে এসে দেখা যায় যে রেনাতো এখন প্রায় বৃদ্ধ এবং শেষ বয়সে এসেও তাঁর উপলব্ধি যে তিনি তাঁর জীবনে অনেক নারীকে ভালোবেসেছেন কিন্তু মালেনা একমাত্র নারী যাঁকে তিনি কোন দিনই ভুলতে পারবেন না। ক্রিস্টিনাকে ভালোবেসে ফেলেছি কি না সেটা জানি না তবে সেটা যে নিঃসন্দেহে একটি অসম ভালো লাগার গল্প এবং হয় তো বা এক সময় জীবনের শেষ বয়সে এসেও রেনাতোর মতো আমাকে বলতে হবে যে জীবনে অনেক নারীর সংস্পর্শে এসেছি কিন্তু ক্রিস্টিনার মতো কাউকে ভালো লাগেনি কোনও দিনই। সমাজের প্রথাকে ভেঙে সামনে এগিয়ে যাওয়ার সাহসও নেই আমার মধ্যে। জীবনে আসলে যা হারিয়ে যায় তা যেনও সারা জীবনের জন্যই হারিয়ে যায়, শুধু হারিয়ে যাওয়া সে জিনিসগুলো মস্তিষ্কের দৃশ্যপটে থেকে যায় স্মৃতি হিসেবে। ভালো থেকো ক্রিস্টিনা!!! তোমার সর্বোচ্চ সফলতা কামনা করছি।জানি না আর কোনও দিন্ দেখা হবে কি না তবে সারাজীবন আমি বুখারেস্টের সেই রঙিন মুহূর্তগুলোকে ফিরে পাওয়ার জন্য কেঁদে যাব, হয় তো বা শেষের কবিতাটি উপন্যাসে উল্লিখিত লাবণ্যের মতো তুমিও আমার কাছে এক দীঘির জল যাঁর প্রতি ভালোবাসা কোন দিনও ফুরোবে না।
×