ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

‘খোয়ারি’ ও মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৬:৫২, ৬ মার্চ ২০২০

‘খোয়ারি’ ও মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশ

বাংলাদেশের ছোটগল্পের ইতিহাসে এক ব্যতিক্রমী নাম। মানুষের বিচিত্র স্বভাব, তার প্রতিবেশ, মানসিক বিকলন, সামাজিক অস্থিরতা তাঁর গল্পের ক্যানভাসে বাস্তবতার স্বরূপে চিত্রিত। বর্ণনার ডিটেইলসে তিনি উপমা, পরাবাস্তব প্রবাহ মিশিয়ে সমকালীনতা আর মানুষের গতিবিধির সত্যাসত্য চিহ্নিত করতে চেষ্টা করেছেন সবসময়। তাঁর কাহিনীতে পরিবেশ ও প্রতিবেশের টোটালিটি পাওয়া যায়। চরিত্রের প্রতিটি পদক্ষেপ ও পদচারণা পাঠকের মগজে নাড়া দেয় যেন সমস্ত উপলব্ধিকে সঙ্গে নিয়ে। বাংলাদেশের সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিবরণে তিনি সতর্ক শিল্পী। সমাজ-রূপান্তরের স্তরে স্তরে মানুষের বিচরণ ও বিবেককে তিনি আঁকেন শব্দশিল্পীর তুলির কোমল-কৌশলী আঁচড়ে। দেশভাগ-পরবর্তী বাংলাদেশ, ভাষা-আন্দোলন-পরবর্তী বাংলাদেশ, পাকিস্তান আমলের সকল রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক বিপ্লব, বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধ, জাতীয়তাবাদ, মুক্তিযুদ্ধপরবতী বাংলাদেশের সোশিও-পলিটিক্যাল পরিস্থিতি, যুব-সমাজের অস্থিরতা, বেকারত্ব ও বিপন্নতা, ইতিবাচক পরিবর্তন কিংবা সমাজ-রূপান্তরের সমূহ সম্ভাবনা প্রভৃতি প্রসঙ্গ ইলিয়াসের গল্পে স্থান করে নিয়েছে প্রাতিস্বিক-বৈশিষ্ট্যে। ইতিহাসচেতনা, বিশ্লেষণের গভীর-তীক্ষè দৃষ্টি আর রসিকতাময় সংলাপ তাঁর রচনাশৈলীতে যোগ করেছে ভিন্নতর ও তাৎপর্যপূর্ণ মাত্রা। এপার বাংলা ওপার বাংলা মিলিয়ে ১৯৪৭-পরবর্তী কথাসাহিত্যে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ (জন্ম : চট্টগ্রাম, ১৯২২; মৃত্যু : ফ্রান্স, ১৯৭১), মহাশ্বেত দেবী (জন্ম : ঢাকা, ১৯২৬; মৃত্যু : কলকাতা, ২০১৬), হাসান আজিজুল হক (জন্ম : বর্ধমান, ১৯৩৯) রচনাকৌশল ও পরিবেশনশৈলীর জন্য যে পাঠকপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেছেন, সেই ধারা ও সারির শক্তিশালী কথানির্মাতা এই ইলিয়াস। তিনি সময়ের শব্দকে ধারণ করেছিলেন উপলব্ধির নিবিড়তায়। লেখক জীবনের প্রায় শুরুতে লেখা প্রথম চিলেকোঠার সেপাই (১৯৮৭) আর বাস্তব জীবনের প্রায় শেষদিকে লেখা খোয়াবনামা (১৯৯৬)- এই দুটি অমর উপন্যাসের স্রষ্টা তিনি। ‘খোঁয়ারি’ গ্রন্থের ফ্ল্যাপের লেখা এরকম- ‘আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ খোঁয়ারি। ১৯৮২ সালে এই গ্রন্থ প্রকাশের পর তিনি বাংলাদেশের প্রথম সারির অগ্রগণ্য কথাসাহিত্যিক হিসেবে স্বীকৃতি পেতে শুরু করেন। এই গ্রন্থভুক্ত চারটি গল্পে ইলিয়াস সময়ের ভেতরে থেকেও সময়কে অতিক্রম করা চিরকালের কিছু প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন- নৈঃসঙ্গ, যৌনতা, বার্ধক্য, মৃত্যু। গল্পগুলোর রচনাকাল ১৯৭৫-১৯৭৯ সাল পযন্ত। তাঁর নিজস্ব সময় এই গল্পগুলোতে যথার্থ রুক্ষ শুকনো ভাষায় জীবন্ত-স্থির হয়ে পরিণত হয়েছে বাংলা ভাষার চিরায়ত সম্পদে।’ এই গ্রন্থের নামগল্প ‘খোঁয়ারি’ (রচনাকাল : ১৯৭৫) মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশে একটি পতিত হিন্দু-বাড়িকে ঘিরে আবতিত কাহিনী। চার বন্ধুর আলাপচারিতার ভেতর দিয়ে পরিভ্রমণ করতে করতে পাঠক পেয়ে যাবেন সমকালীন রাজনীতি আর সমাজের বিচিত্র ব্যাপারের সন্ধান। যুব সমাজের চিন্তা, দেশপ্রেম, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এ দেশের নাগরিকদের ভূমিকা, দখলের রাজনীতি, পারিবারিক কাঠামো ও সংস্কৃতি ইত্যাকার বিষয়ে লেখক তাঁর পাঠককে বিপুল তথ্য যেমন প্রদান করেছেন, তেমনই পাশাপাশি নানান চিন্তার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছেন। যুদ্ধ-পরবর্তী নতুন জন্ম-নেওয়া একটি দেশকে চিনে নিতে পারি আমরা একটি পরিস্থিতি বিবরণ থেকেÑ এদিকে চাল, ডাল, আটা, আলু কিনে রাখলেও কয়েকটা দিন নিজেদের ভাতটা রুটিটা মিলতো। মাঝখানে দিন যা গেলো! ঘরের ফানিচার উনিচার বেচে দেওয়ার জন্য বাইরে বার করবে তারও কি জো ছিল? কোনভাবে গন্ধ পেয়েছে কি ঘরের মধ্যে পাবলিক জমে গেল। তারপর একটানা ভনভনানি, ‘এ টেবিল কোথায় পেলেন ভাই?’ ‘আমার ড্রেসিং টেবিল বেচবেন আমারই কাছে?’ ‘এইতো আমারই আলনা।’ রেফ্রিজারেটরটা অবশ্য অল্প দামেই পাওয়া গিয়েছিল, ঠাঠারি বাজারের ইসরাইল জোগাড় করেছিলো কোত্থেকে, এক কিস্তি দাম দেওয়ার পর ব্যাটা কোথায় সাফ হয়ে গেছে, আর টাকা দিতে হয়নি। কিন্তু একটু ভালো দামে বেচে আজ লাভটা কি হলো? দালালকে দেওয়ার পর তার প্রায় সবটাই খসলো ফারুক আর জাফরের পেছনে। ফারুক তো এখন ওপরের লোক। মাদারচোদ কাম কি করবে কে জানে? (আখতারুজজ্জামান ইলিয়াস, রচনাসমগ্র ১, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, পঞ্চম মুদ্রণ ফেব্রুয়ারি ২০০৭, পৃ. ১১২) সামাজিক বিপন্নতা ও মানসিক অসহায়ত্ব বুঝাতে কথাকার এখানে রঙ আর শব্দের ব্যবহার করেছেন। পাকবাহিনীর অত্যাচারে ফ্যাকাসে হয়ে-ওঠা বাঙালীর জীবনধারা পরিবেশন করতে চেয়েছেন হলুদ রঙের প্রয়োগের মধ্য দিয়ে। হলুদ তাঁর প্রিয়-প্রসঙ্গ হয়ে উঠেছে কোনো কোনো অবসরে। ‘প্রথমবারের মতো কথা বললো বলে জাফরের কণ্ঠস্বর ফ্যাসফ্যাসে ও মাঝখান দিয়ে চেরা।’ (পৃ. ৯৫) সমরজিৎদের বাড়ির বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছেন- ‘সবগুলো ঘরের দেওয়ালে খিঁচিয়ে-থাকা দাঁতের গোড়ায় ছ্যাতলার মতো হলুদ জ্যোৎস্না।’ (পৃ. ৯৫) ‘চঁাঁদের ময়লা আলোতে এই উঠানকে হলদে রঙের নোংরা চাদর-পাতা বিছানা বলে ভুল হতে পারে।’ (পৃ. ৯৫) ‘টিকেট মাস্টারের হলদে-দাঁতে-গিজ-গিজ-করা মুখ এখন সমরজিতের মুখের কাছে’, (পৃ. ১০৯) ‘হলুদ উঠান’ (পৃ. ১১৩) সমরজিতের বাড়ি যেন যুদ্ধবিধ্বস্ত পুরো বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি। সবকিছু কেমন অস্পষ্ট, ঝাপসা- যেমন এই বাড়িটা- ‘সুরকি-ঝরা দেওয়ালের রঙ তবু ঝাপশা দ্যাখা যাচ্ছিল।’ (পৃ. ৯৪)‘নিচের ঘরে আলোতে সিঁড়ির ধাপগুলো কেবল উঁচু ও কালচে হলুদ।’ (পৃ. ৯৭) ‘শূওরের বাচ্চারা ন’ মাসে বাড়িটার কি অবস্থা করেছে। কে আসবে এখানে?’ (পৃ. ৯৬) গল্পের এক চরিত্র ফারুকের এই একটি উক্তির ভেতর দিয়ে ইলিয়াস তুলে ধরতে চেয়েছেন ১৯৭১ সালের নয়মাসব্যাপী যুদ্ধে পাক-হানাদার বাহিনীর অপকর্মের এক নীরব ইতিহাস। যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি বাড়ি ও পরিবারের কাহিনী হয়ে উঠেছে একাত্তর-পরবর্তী স্বাধীন বাংলাদেশের মিনিয়েচার। বাক্যভঙ্গি তৈরিতে আখতারুজ্জামান স্বতন্ত্র শিল্পী। প্রথার বাইরে সমাজে ও পরিবারে ব্যবহৃত প্রতিদিনের শব্দমালা গল্পের পরিসরে প্রবেশ করিয়েছেন তিনি কৌশলে ও সাফল্যের সঙ্গে। সাধুজনের সাহিত্য-পরিসরে অসাধু ভাষার এই সাহসী প্রয়োগে তিনি পরিচিত হয়ে উঠলেন। যেমন- ‘বাপে হালায়, বুঝলা, বৃহস্পতিবার, না না শনিবার দিন রাইতে খুব মাল টানছে, বহুত দিন বাদে কৈ পাইছিলো, আর চেক করতে পারে নাই। বাসায় আইসাএই জায়গায় না খাড়াইয়া গান ধরছে।’ (পৃ. ৯৬) আবার ইংরেজী শব্দ-প্রয়োগের সৌন্দর্য-চাতুর্যে ভরা ইলিয়াসের গল্প। ‘খোঁয়ারি’তে আমরা তাঁর এই প্রবণতার বিশেষ পরিচয় পাই। একটি অংশ এখানে উদ্ধৃত করছি- কিন্তু জাফরের লক্ষ্য পূর্ণতার দিকে, ‘উই নীড সেন্ট পার্সেন্ট বেঙ্গলীজ।’ কেবল বাঙলা শিখলেই চলবে? না নিজের মাতৃভাষা ভুলে যেতে হবে?- পূর্ণ বাঙালী হওয়ার নিয়ম-কানুন জেনে নেওয়ার জন্য ইফতিখার উদগ্রীব হলো। কিন্তু এই কথাটা কিভাবে জেনে নেওয়া যায়- এই ভাবতে না ভাবতে ফারুক তাড়া দেওয়ার ভঙ্গিতে সোজা হয়ে বসে, ‘না দোস্ত। আমাদের একটু কুইক করতে হয়। ফরেন পার্টির সঙ্গে ডিল, খুব টপ লোকের মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়ে মানিক ভাই এ্যারেঞ্জকরে দিলো। এদিক ওদিক হলে মানিক ভাই টলারেট করবে না।’ সমরজিতের বড় ইচ্ছা করে, যাই না, বারান্দায় গিয়ে একটু দাঁড়াই! ‘তো তুমি কি ডিসাইড করলে? তোমাদের বাড়িটা আমাদের দরকার।’ (পৃ. ১০৫) কাহিনীতে বর্ণিত বাড়িটি ছিল পাক-বাহিনীর ক্যাম্প। এখন এটি অন্যদের টার্গেটে পরিণত হয়েছে। সমরজিৎ বলছে, তাদের ভিটের কুয়োতলা সম্বন্ধে- ‘আমরা পোলাপান থাকতেই কুয়াটা বন্ধ কইরা টিন চাপাইয়া রাখছে। টিনের উপরে পুরানা কাঠকুঠ, দরজা, ভাঙা কপাট, ভাঙা চেয়ার টিবিল বহুত জমছিলো। নয় মাসে খানকির বাচ্চারা সেইগুলি জ্বালাইয়া ভাত খাইছে, অখন টিনগুলি বারাইয়া পড়ছে।’ (পৃ. ৯৬) ভাড়ার নামে দখল করে সমরজিতদের বাড়িটায় অফিস বসাতে চায় জাফরেরা। কিন্তু কিসের অফিস তাদের? শোনা যাক ফারুকের জবানিতেÑ আমাদের তো আর রাজনৈতিক সংগঠন নয়, আমাদের ভয় পাওয়ার কি আছে? আমাদের পিওর উউথ ফ্রন্ট, আমরা মন্ত্রিত্ব চাই না এমনকি উই রিফিউজ এ সিট ই দ্য পার্লামেন্ট। আমরা শুধু দেখবো সাব ভারসিভ এলিমেন্টস বিপ্লবের নাম করে কিংবা গবুর্মেন্টের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে দেশকে ধ্বংস করতে না পারে। নট ওনলি দ্যাট, আমরা এ্যালার্ট থাকবো যাবে কোরাপ্ট লোকজন আমাদের ন্যাশনাল অর্গানাইজেশনে ঢুকে রেইন করতে না পারে। একজনের কেরিশমার চান্স নিয়ে দশজনে লুটে পুটে না খায়। (পৃ. ১০৬-১০৭) মুক্তিযুদ্ধে কার কী ভূমিকা ছিল? কেউ ছিল ফ্রন্টে, কেউ কোলকাতায়, কেউ ক্যাম্পে। সেভেনটি ওয়ানে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সবমানুষ দল বেঁধে সংগ্রামে নামেনি। ইতিহাস একথা মানে। কেউ ট্রেনিং নিতে দেশ ছেড়েছিল। কেউ খানসেনাদের ক্যাম্পে গলা ভিজিয়েছে। প্রতিদিনের পেটের খাবার আর প্রতিরাতের যৌনতার উপকরণ সরবরাহ করেছে এরা। মুক্তিবাহিনীর খবরাখবর দিয়ে পাকবাহিনীকে সহায়তা করেছে। আর একশ্রেণীর লোকেরা দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মহান যুদ্ধে। গল্পে জাফরের কথা থেকে খানিকটা পাঠ নিচ্ছি- ‘আমি কোলকাতা ছিলাম না।... আমি ছিলাম ফ্রন্টে। এই হাতে তিনজন পাঞ্জাবি সোলজার মেরেছি, দালাল সাফ করেছি এ্যাট লিস্ট হাফ এ ডজন। মদ খেতে আর মিটিং করতে তো আর দেশ ছাড়িনি।’ (পৃ. ৯৯) নতুন রাষ্ট্রে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল বিশ^াস আর আস্থা। মানুষের প্রতি মানুষের বিশ্বাস, পারস্পরিক রাজনৈতিক বিশ্বাস, সাংস্কৃতিক আস্থাÑ এইসব স্বাধীন বাংলাদেশে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশার জায়গা ছিল। ইলিয়াস লিখছেন সে কথা- ১। চারদিকে এনিমি। দেশ কি আর এতো সহজে শত্রুমুক্ত হয়? এতো সোজা? টার্মিনালে, ফুটপাথে, স্টেডিয়ামে, রেলস্টেশনে এতো লোক গিজগিজ করে, লজ্জা শরমের বালাই নেই, কাপড়চোপড়ের ধার ধারে না, এমন কি শালাদের গায়ের চামড়াও কি সিনথেটিক ফাইবারে তৈরি?- কি ট্রান্সপারেন্ট- শরীরের ভেতরের হাড়হাড্ডিও সব দ্যাখা যাচ্ছে। এরা সবাই সুবোধ দেশপ্রেমিক বাঙালী কে বললো? (পৃ. ১০১) ২। রঙবাজি করে আর কতোদিন? চারদিকে খালি শত্রু, যেখানে যাও একটা না একটা ঘাপলা। অথচ কোনো সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামাবে না এরা, এদিকে ওয়ার্কিং কমিটিতে ঢোকার জন্য সব অস্থির। এতো বড় একটা ওলটপালট ঘটে গেলো, এদের কোনো চৈতন্যোদয় হলো? (পৃ. ১০২-১০৩) দেশভাগ-পরবর্তী পূর্ব-পাকিস্তানের হিন্দুদের সামাজিক অবস্থান ও ভারতপ্রীতি, মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় হিন্দু-পরিবারের সামাজিক অবস্থা, তাদের কারো কারো ভারতগমন, যুদ্ধশেষে দেশে ফেরা-না-ফেরা, যুদ্ধ সম্বন্ধে তাদের অভিব্যক্তি ও ধারণা; বাংলাদেশ সম্বন্ধে হিন্দু-মুসলমানদের অনুভূতি, মুসলমানদের একাংশের পাকিস্তানপ্রীতি এবং সারাদেশে ছড়িয়ে-থাকা জনপদে যুদ্ধের স্মৃতি ও ছবি, গন্ডগোলের সময়ে গোলমালের সাথে একাকার হয়ে মিশে-যাওয়া প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দেশবাসীর মানসিক-ঘোরÑ এইসব বিষয়ে গল্পকার তাঁর নিজস্ব অনুভব ও ব্যাখ্যা পরিবেশন করেছেন। বাঙালীর স্বভাব, দেশপ্রেম সম্বন্ধে তাঁর অভিব্যক্তি আমরা খানিকটা জেনে নিতে পারি- ১। ‘এইবার আইসা তো এইবাড়িতে উঠতে পারি নাই। আট নয়টা মাস বাড়ির কিছু রাখছে নাকি? মারে আনলাম না, ঠাকুরমারে আনলাম না,- বাড়ির কি হাল হইছে না দেইখা ক্যামনে আনি? আমরাও তো এইবার আইসা একটা মাস থাকলাম গ্যা-ারিয়া প্রবীরগো বাড়ি। প্রবীরগো বাড়ি থাইকা-’ (পৃ. ১০৪) ২। ‘প্রবীর তো ইন্ডিয়া গেলো গোলমালের পিরিয়ডে।’ (পৃ. ১০৪) ৩। ‘বাংলাদেশের জন্যে সকলের ফিলিং তো আর জেনুইন না।’ এই সিদ্ধান্ত ঘোষণা করবার সময় কণ্ঠ থেকে ক্রোধ ছেঁকে ফেলবার জন্য জাফরের কোনো চেষ্টাই নেই, ‘ইন্ডিয়া গেলো প্রাণ বাঁচাতে, চাকরি পেলো তো দেশের পাছায় লাথি দিয়ে বিদেশেই থেকে গেলো। আবার এদিকে দ্যাখো, আরেক দল পাকিস্তানে টাকা-পয়সা সোনা-দানা সব পার করে দিয়ে ওয়েট করছে, কবে রেডক্রসের ক্লিয়ারেন্স আসে।’ (পৃ. ১০৪-১০৫) ৪। সবাইকে নিয়ে রামচন্দ্রপুরের লঞ্চে ওঠা, হিন্দু যাত্রী বহন করতে সারেঙের ক্রমাগত ‘না না’, জ্যাঠাইমার কাছ থেকে দেড় ভরি সোনার বালা নিয়ে সারেঙকে ঘুষ দেওয়া, অলঙ্কারশোকে জ্যাঠাইমার ইনিয়ে বিনিয়ে কান্না; তিন মাইল যাওয়ার পর বাঁদিকের কাটাখালে সেনাবাহিনীর গানবোটে চলে গেলো পশ্চিমদিকে, সাত আট মাইল পর নদীর দক্ষিণ পাড় জুড়ে দগ্ধ জনপদ, ঝলসানো গাছপালা, নদীতে গুলি-বিদ্ধ ফেঁটে-ওঠা লাশদের জলকেলি- সব মনে আছে। (পৃ. ১০৮) ৫। এখন সন্ধ্যাকাল না গভীর রাত্রি? এটা কি নগরীর রাজপথ না নিভৃত বাঙালী গ্রাম? বৃষ্টি না ট্যাঙ্ক? বাতাস না মর্টার? উত্তর দক্ষিণে কি গাছপালা না সেনাবাহিনী? মাঠ না কান্টনমেন্ট? মগজে এইসব ঘাপলা, কোলে ঠাকুরমা। (পৃ. ১১০-১১১) ১৯৭১ সালে বহুলোক দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। তারা মূলত আশ্রয় নিয়েছে বিশাল ভারতে। বাড়ি-ঘর, পূর্ব-পুরুষের বিচরণের ভূমি পেছনে ফেলে তারা সামনের দিকে, যেখানে যুদ্ধ নেই, মানবতা যেখানে বিপন্ন নয়, সেইদিকে চলে গেছে দুপা চালিয়ে। ফলে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বহু পতিত বাড়ি চোখে পড়েছে। সম্ভবত, এতোদিন পরে, আজও অনেক বাড়ি পতিতই রয়ে গেছে। কিছু বাড়ি হয়তো বিভিন্ন সরকারের আমলে দলীয় লোকেরা বন্দোবস্ত পেয়েছে। এই বাস্তবতার ছবি ইলিয়াস তাঁর গল্পে স্থান দিতে ভুল করেননি। সমরজিতের বন্ধু ফারুকের ফুসলানো কথার ছলে গল্পে প্রবেশ করে তেমনই এক পরিস্থিতি- ‘আমি বলি দোস্ত, বাড়িটা ছেড়ে দাও। নিচের তলা ভাড়া দিয়ে ওপরে থাকতে তোমাদের যদি খুব অসুবিধা হয় তো বলো, তোমাকে আরো ভালো বাড়ি দিচ্ছি, এ্যাবানড- বাড়ি এখন কতো! তোমাদের এই বাড়িটা আমাদের দরকার।’ (পৃ. ১১১) মাতলামির আড়ালে বাস্তবতার মৃদু আওয়াজ, মগজের তালমাটাল পরিস্থিতি, শহরের জীবনধারার হালচাল ও চিত্র-চরিত্র, যুবসমাজের অস্থিরতা ও উন্নয়ন-ভাবনা, নেশাগ্রস্তের স্থলকেলিময়তা- এইসব অবস্থা ও অবস্থানের ভেতর দিয়ে পারি দিয়েছে গল্পের জমিন। এইখানে আমরা কাহিনীর প্রায় কেন্দ্রে-থাকা সমরজিতের থেকে একটা উদ্ধৃতি নিচ্ছিÑ ‘খালি হ্যাংওভার হয়, মদ খাইলেই হাংওভার, ছাড়তেও পারি না, কি যে করি? খোয়ারির মধ্যে রাত কাটে, সারাটা সকাল জুইড়া খালি খোঁয়ারি, অফিসে বইসা ঝিমাই, ভাল্লাগে না।’ (পৃ. ১১৪) শব্দের শৈল্পিক প্রয়োগ, মনের ভাব ও এলোমেলো ভাবনা, হাইতোলা-প্রসঙ্গের ভেতর দিয়ে মানবিক বিপন্নতা, মুক্তিযুদ্ধপরবর্তী মানসিক বিভ্রম বুঝাতে হলুদ রঙের বিচিত্র-প্রেক্ষিত ব্যবহার, গলার ফ্যাসফ্যাসে স্বরের মাধ্যমে অসহায়তার প্রকাশ সর্বোপরি রং-আলো-ধ্বনিতে এক বিশেষ আবহ তৈরির প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায় ‘খোয়ারি’তে।
×