ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

পুলিশ বাহিনীর মুক্তিযুদ্ধে অনন্য অবদান

প্রকাশিত: ০৬:৪৭, ৬ মার্চ ২০২০

 পুলিশ বাহিনীর মুক্তিযুদ্ধে অনন্য অবদান

সাহিত্য জাতির দর্পণস্বরূপ। আর সাহিত্যিক সমাজের চিরুনিস্বরূপ। প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত যত সমাজ সভ্যতার আগমন-অন্তর্ধান হয়েছে সকল সমাজেই সাহিত্যিকদের রয়েছে অনন্য অবদান। সাহিত্যিকদের বোধশক্তি সমাজের ৮/১০ জন লোকের চেয়ে আলাদা। সমাজের অন্য লোকেরা যা ঘুণাক্ষরেও টের পান না সাহিত্যিকরা তার গন্ধ শুঁকে শুঁকে অতীতের আলোকে ভবিষ্যতের ছক এঁকে যান। লেখক শরিফুল হাসান শিশির এমনই একজন যিনি অতীতের গন্ধ শুঁকে ভবিষ্যত প্রজন্মকে আগামীর ছক এঁকে দিয়ে যাচ্ছেন। আমাদের গৌরবময় মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কে তিনি লেখনী ধারণ করে ভবিষ্যত ও বর্তমান প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় ইতিহাসের জানান দিচ্ছেন এবং কীভাবে মুক্তিযুদ্ধের আলোকবর্তিকা হাতে নিয়ে আগামীর বাংলাদেশ গড়তে হবে তারও সঠিক পথের সন্ধান দিচ্ছেন কলমের শৈল্পিক আঁচড়ে। ফেসবুকে তিনি স্বপ্নিল শিশির নামে পরিচিত। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সফলতার সঙ্গে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে বর্তমানে তিনি সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগে সার্জেন্ট হিসেবে সফলতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। অমর ২১শে গ্রন্থমেলা ২০২০ এ তার বই ‘মুক্তির আলো’ সিলেটের জসিম বুক হাউস থেকে প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশক: মোঃ জসিম উদ্দিন। এছাড়াও তার আরও ৩টি বই ‘বঙ্গবন্ধুর শৈশব কৈশোর ও শিক্ষাজীবন’, ‘২৬শে মার্চ যারা ভোর এনেছিল’ ও ‘রক্তাক্ত ১৫ আগস্টের শহীদেরা’ প্রকাশিত হয়েছে। এ নিবন্ধে তার অমর গ্রন্থ ‘মুক্তির আলো’ নিয়ে আলোচনা করব। বইটিতে ৩টি অংশ রয়েছে। প্রথম অংশটি হচ্ছে ‘পুলিশী জীবনের যে গল্প হয় না বলা’। এ অংশটিতে তিনি মূলত গল্পে গল্পে পুলিশী জীবনে মনের গহীনে লুকিয়ে থাকা অন্তর্জ্বালার কথা তুলে ধরেছেন। ‘পুলিশ হয়ে ওঠা এক বিরাট সাধনার বিষয়। কিছু আইন-কানুন মুখস্থ, শরীরে ইউনিফর্ম আর কোমরে অস্ত্র ধারণ করলেই পুলিশ হওয়া যায় না। মোমবাতির ন্যায় নিজে জ¦লে পৃথিবীকে আলোকিত করার নাম পুলিশিং।’ ...যারা দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়ে যায়, তাদের স্বাধীনতার গণ্ডিটা কত ছোট। ...পুলিশেরা প্রতিদিন মরে নিজের ভেতরে। তার বুকের রক্তক্ষরণ কেউ বুঝবে না। তার সাক্ষী হলো তার একাকীত্ব। ...যারা পুলিশের পোশাক পরে, এই পোশাকটা নিজ থেকেই তাদের ওপর কিছু দায়িত্ব অর্পণ করে দেয়। মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রতিরোধকারী যোদ্ধা আমার পুলিশ- এই গর্ব বুকে নিয়েই এ পোশাক পরিধান করি। ...বাংলাদেশ পুলিশ ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ গড়ে তোলে। মহান মুক্তিযুদ্ধে একজন ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল বেশ কয়েকজন এসপিসহ প্রায় সব পর্যায়ের পুলিশ সদস্য বাঙালীর মুক্তির সংগ্রামে জীবনদান করেন। ...১২৬২ জন শহীদ পুলিশ সদস্যের তালিকা স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্রে উল্লেখ পাওয়া যায়। কথাগুলো তিনি এভাবেই এগিয়ে নিয়ে গেছেন। শব্দের খেলায় তুলে ধরেছেন পুলিশী জীবনের সুখ-দুঃখের কথা। তুলে ধরেছেন মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ পুলিশের অবদানের কথা। বাংলাদেশ পুলিশ মহান মুক্তিযুদ্ধে পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ গড়ে তুলে। পঁচিশে মার্চ কালো রাতে ৩০৩ রাইফেল দিয়েই পুলিশ বাহিনী সশস্ত্র প্রতিরোধে ঝাঁপিয়ে পড়ে দেশমাতৃকাকে রক্ষার জন্য। ‘স্রোতের বিপরীতে চলা একমাত্র প্রাণীটির নাম পুলিশ। রাস্তায় গণ্ডগোল হচ্ছে, যে যার জীবন নিয়ে পালাচ্ছে। কিন্তু পুলিশ যাচ্ছে গণ্ডগোল থামাতে।’ ‘ যে গল্প হয় না বলা’ এ লেখাটিতে তিনি মূলত শত প্রতিকূলতা আর চাপের মধ্যেও যে পুলিশ নিজ পরিবার এবং দেশের জন্য জীবনবাজি রেখে লড়ে যাচ্ছে সে বিষয়গুলো নানা রকম উদাহরণের মধ্য দিয়ে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। ‘পুলিশ তুমি কার?’ লেখাটিতে পুলিশের দৈনন্দিন জীবনের নানা বাস্তবতা তুলে ধরেছেন। জীবনের নানা ঝঞ্ঝাট থাকা সত্ত্বেও পুলিশরা যে দেশের তরে জীবনবাজি রেখে অদম্য গতিতে এগিয়ে যান দেশের স্বার্থে তা তিনি তুলে ধরেছেন। লেখাটি লেখকের আত্মজীবনীমূলক লেখা। এখানে কিছু বাস্তব অভিজ্ঞতার কথা তিনি তুলে ধরেছেন পাঠকের সামনে। যেমন: ‘...আমি ট্রাফিক পুলিশ দেশকে ভালবেসে ট্রাফিকমুক্ত দেশের স্বপ্ন নিয়ে নিরলস কাজ করে যাই। ...সবার জন্য কাপড় কিনে টাকা শেষ হয়ে এল। আমার জন্য কিছু কেনা হলো না।’ ‘পুলিশ তুমি কার?’ বইটির দ্বিতীয় অংশ হচ্ছে ‘মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ পুলিশ’। এ অংশে রয়েছে ৩ টি প্রবন্ধ। মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী প্রয়াত পুলিশ সার্জেন্ট মোঃ মর্তুজার অবদানের কথা তুলে ধরেছেন এ অংশে। তার এ লেখাটি থেকে জানা যায় যে, পাক হানাদার বাহিনী যখন রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে আক্রমণ করে তখনই দেশপ্রেমিক পুলিশ প্রথম প্রতিরোধ গড়ে তুলে। সার্জেন্ট মর্তুজা হোসেনসহ পুলিশের গুরুত্বপূর্ণ অবদান সম্পর্কে তথ্যবহুল আলোচনা উপস্থাপিত হয়েছে লেখাটিতে। পাঠকের সামনে লেখাটির কিছু অংশ তুলে ধরা হলো: ‘...এই রাজারবাগ থেকেই শুরু হয় প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধ। প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধের কারণেই বাংলাদেশ পুলিশকে ‘স্বাধীনতা পদক’ দেয়া হয়। সেই প্রতিরোধ যুদ্ধের বীরসেনা ছিলেন অনেকেই। তাঁদেরই একজন প্রয়াত সার্জেন্ট মর্তুজা হোসেন। ...তিনি রাত ৯:৫৪ মিনিটে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে উপস্থিত হন। তিনি ও বাঙালী পুলিশ সদস্যরা প্রতিহত করার সিদ্ধান্ত নেন। পুলিশ সদস্যদের নিয়ে শাবল দিয়ে অস্ত্রাগারের তালা ভেঙ্গে অস্ত্র সংগ্রহ করে সকল বোর্ডের মধ্যে অস্ত্র বিতরণ করেন। আর ম্যাগজিন গার্ডে বাংলাদেশের পতাকা তোলে দেন। ...রাত ১২টার আগেই পাকসেনারা রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে মালিবাগের দিক থেকে আক্রমণ চালায়। প্রতিরোধে গর্জে উঠে বাঙালী পুলিশ সদস্যদের থ্রি নট থ্রি রাইফেল। বহু পাকসেনা হতাহত হয়। ...এরপর পাকসেনারা ট্যাঙ্কসহ ভারি অস্ত্র দিয়ে আক্রমণ শুরু করে। ...আহত হন পুলিশ সদস্য। ...এরপর ছদ্মবেশে মুজিবনগর সরকারের আনুগত্য স্বীকার করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের উদ্দেশে পালিয়ে রাজশাহী হয়ে ভারতে যান। তিনি ১১ জুন যোগদান করেন কলকাতা পুলিশ সদর দফতরে। সেখানে স্টাফ অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।’ জনপ্রিয় লেখক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের পিতা শহীদ ফয়জুর রহমান মুক্তিযুদ্ধে যে অনন্য অবদান রেখেছেন তাও তুলে ধরা হয়েছে বইটির এ অংশে। বইটি থেকে জানা যায়, ফয়জুর রহমান মুক্তিযুদ্ধকালীন পিরোজপুরে কর্মরত ছিলেন। ১৯৭১ সালের ৫ মে যখন ফয়জুর রহমান নিজ কর্মস্থলে এসে পৌঁছান তখন পাকিস্তানীরা তাঁর দেশপ্রেমের কথা জেনে যাওয়ার কারণে তাঁকে গুলি করে হত্যা করে। দেশ স্বাধীন হলেও এখনও যে সকল প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পাননি তা ফুটে উঠেছে ‘এক অসহায় শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রীর আর্তনাদ’ লেখাটিতে। হাজেরা বেগম নামে একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রীর সাক্ষাতকার থেকে তার পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁর স্বামী মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় শহীদ হলেও এখনও শহীদ হিসেবে কোন স্বীকৃতি পাননি কেবল আমলাতন্ত্রের লাল ফিতার দৌরাত্ম্যের কারণে। বইটিতে ‘জ্যোৎস্না রাত’ ও ‘যদিও সন্ধ্যা’ নামে আরও দুটি উপন্যাস রয়েছে যা নিয়ে পরবর্তী কোন নিবন্ধে আলোচনা করব। বইটি পড়লে অনুমিত হয় যে, দেশপ্রেমিক এ লেখক আগামীর বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গড়ে তুলতে চান। তাই তিনি তরুণ প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর মুক্তিযুদ্ধে যে অবদান তা তিনি তুলে ধরেছেন এ গ্রন্থটিতে। আমি আশা করি বইটি আপন গুণে পাঠকের টেবিলে স্থান করে নেবে।
×