ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

গুডবাই গ্ল্যামারগার্ল শারাপোভা

প্রকাশিত: ১২:০২, ৪ মার্চ ২০২০

গুডবাই গ্ল্যামারগার্ল শারাপোভা

পাঁচবারের গ্র্যান্ডস্লামজয়ী মারিয়া শারাপোভা। অবশেষে বিদায় নিলেন টেনিস থেকে। বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয়, সবচেয়ে বেশি অর্থ উপার্জনকারী প্রমীলা এবং গ্ল্যামার্স খেলোয়াড়ের তালিকায়ও নাম রয়েছে মারিয়ার। গত বুধবার বিশ্ব টেনিস থেকে অবসরের ঘোষণা দিয়ে দিলেন ৩২ বছরের এই তারকা। বিখ্যাত দুই ফ্যাশন পত্রিকা ‘ভোগ’ এবং ‘ভ্যানিটি ফেয়ার’ এ মারিয়া শারাপোভা লিখেছেন, ‘টেনিস, আমি তোমাকে গুডবাই জানালাম। টেনিস র‌্যাকেট হাতে ২৮ বছর কাটিয়ে আর পাঁচটি গ্র্যান্ডস্ল্যাম জেতার পর আমি এখন অন্য শৃঙ্গ জয় করতে তৈরি।’ বর্তমানে বিশ্বের ৩৭৩তম খেলোয়াড় মারিয়া শারাপোভা। এক সময় টানা ১ নম্বরে থেকেছেন। কাঁধে চোট, ডোপ কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে নির্বাসন, ফিরে আসা, আত্মজীবনী, গ্ল্যামার্স, সেরেনা উইলিয়ামসের সঙ্গে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বিতান, সুগারপোভা টফির ব্যবসা, ফ্যাশন ও প্রেম- এককথায় মারিয়া শারাপোভা দীর্ঘদিন ধরে টেনিস বিশ্বের ভক্ত-অনুরাগীদের মাতিয়ে রেখেছিলেন তার নানা কার্যকলাপে। কিন্তু সম্প্রতি ফর্ম হারিয়ে একাধিক চ্যালেঞ্জ থেকে হেরে যাচ্ছিলেন শারাপোভা। অনেকেই তার সরে দাঁড়ানো, টেনিস থেকে বিদায় নেওয়া নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা শুরু করেছিলেন। তবে সর্বদা যোদ্ধা মারিয়া বেশ কিছুটা সময় নিয়েই শেষ পর্যন্ত অবসরের ঘোষণা দিয়ে দিলেন। মাত্র চার বছর বয়সে বাবার হাত ধরে টেনিস শিখেছিলেন মারিয়া শারাপোভা। ছয় বছর বয়সে মস্কোর টেনিস একাডেমিতে ভর্তি হওয়া। ধীরে ধীরে আরও শক্ত হাতে র‌্যাকেট ধরা। দারুণ স্বপ্ন দেখা- একদিন বিশ্বের সেরা টেনিস খেলোয়াড় হবেন। ২০০০ সালের দিকে রাশিয়ার জুনিয়র টেনিসেও ডাক পেয়ে যান। সেখানেই বাজিমাত। ছোট্ট শারাপোভার খেলা দেখে মুগ্ধ হন অনেকে। তিনি নিজেকে নিয়ে যান আরও উঁচুতে। জুনিয়র টেনিসে বিশ্বের সেরা দশজনের একজন হয়ে ওঠেন। ২০০৩ সালে প্রথম টেনিসের কোন বড় টুর্নামেন্টে অংশ নেন। ২০০৫ সালে পেশাদার টেনিসে দারুণ সময়ের মধ্য দিয়ে পার করেন শারাপোভা। যদিও সেবার বড় কোনো অর্জনের দেখা পাননি তিনি। তবে নারী এককে সেরা টেনিস খেলোয়াড়ের আসনে বসেন। এর পেছনে অবশ্য কারণও ছিল। তিনটি গ্র্যান্ডস্লামের সেমিফাইনাল আর একটিতে কোয়ার্টার ফাইনাল পর্যন্ত গিয়েও শেষ পর্যন্ত বিদায় নেন তিনি। তাতে জয়-পরাজয়ের হিসাবে সবাইকে ছাড়িয়ে যান। ২০০৮ সালে অস্ট্রেলিয়ান ওপেনে জিতে নেন স্বপ্নের তৃতীয় গ্র্যান্ডস্লাম। এরপর ২০১২ ও ২০১৪ সালে ফ্রেঞ্চ ওপেনের রানীর মুকুট ওঠে তার মাথায়। তার জন্য বাজে একটা সময় ছিল ২০১৬ সাল। একে তো ইনজুরি, তার ওপর ডোপ টেস্টে পজিটিভ প্রমাণ হওয়ায় টেনিস থেকে নিষেধাজ্ঞা। শুরুতে দুই বছরের জন্য তাকে নিষিদ্ধ করে ইন্টারন্যাশনাল টেনিস ফেডারেশন। দীর্ঘ এ নিষেধাজ্ঞা সহজভাবে নেয়নি রাশিয়া। শারাপোভার শাস্তি কমানোর জন্য ভেতরে ভেতরে তারা বেশ দৌড়ঝাঁপ করে। শেষমেশ ২০১৬ সালের অক্টোবরের দিকে তার শাস্তি ১৫ মাসে কমিয়ে আনা হয়। নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে ফেরার পর অনেকটা ছন্দ হারিয়ে ফেলেন শারাপোভা। প্রথম কিছুদিন নিজের পুরনো ফিটনেস ফিরে পেত দিন-রাত পরিশ্রম করেন। এরপর নামেন আসল লড়াইয়ে। কিন্তু কোথায় যেন গ-গোল! আগের সেই শারাপোভার সঙ্গে এই শারাপোভার আকাশ-পাতাল ব্যবধান। সর্বশেষ এ বছরের প্রথম গ্র্যান্ডস্লাম অস্ট্রেলিয়ান ওপেনেও নিষ্প্রভ শারপোভার দেখা মেলে। টুর্নামেন্টের প্রথম রাউন্ড থেকেই বাড়ি ফিরতে হয় তাকে। দীর্ঘ দেড় দশকের ক্যারিয়ার শেষে তার অবসরে শেষ হলো টেনিস কোর্টে গ্ল্যামার কোশেন্টের রুশ উপকথার এক অধ্যায়। মাত্র বত্রিশ বছর বয়সে তার এই সিদ্ধান্তে ভক্তরা আশাহত হবেন ঠিকই। কিন্তু টেনিস-সুন্দরী তার সিদ্ধান্তে অনড়। তিনি বলেন, ‘আমি টেনিসকে নিজের জীবন দিয়েছিলাম, টেনিসও আমাকে নতুন জীবন দেয়।’ সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের ন্যাগান প্রদেশে মারিয়া শারাপোভার জন্ম ১৯৮৭ সালের ১৯ এপ্রিল। তার এক বছর আগে ঘটেছিল ভয়ঙ্কর চের্নোবিল বিস্ফোরণ। তার ক্ষতিকর প্রভাব থেকে বাঁচতে শিশুকন্যাকে নিয়ে সোচি চলে এসেছিলেন শারাপোভার বাবা-মা। সোচিতেই জীবনে প্রথম র‌্যাকেট ধরেছিলেন মারিয়া। দিয়েছিলেন তার বাবার বন্ধু আলেকজান্ডার কাফেলনিকভ। ১৯৯৪ সালে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে শারাপোভাকে নিয়ে তার বাবা এসে পৌঁছলেন আমেরিকা। হাতে সম্বল মাত্র ৭০০ ডলার। তার উপর, তখন তারা কেউই ইংরেজী বলতে পারেন না। বোঝেনও না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা পেলেন না তার মা ইয়েলেনা। দুই বছর মাকে ছাড়াই থাকতে হয় শারাপোভাকে। আমেরিকায় পৌঁছনোর পর শারাপোভার বাবা সামান্য মজুরিতে বিভিন্ন রকমের কাজ করতে শুরু করেন। ১৯৯৫ সালে শারাপোভার বার্ষিক ফি মওকুফ করে আইএমজি। কয়েক বছর পর খাতা-কলমে তাদের ছাত্রী হয় ৯ বছরের মারিয়া শারাপোভা। ২০০৪ সালে সদ্য সতেরোয় পা দেওয়া কিশোরীর দ্যুতিতে ঝলসে যায় টেনিস দুনিয়া। উইম্বলডন ফাইনালে সেরেনা উইলিয়ামসকে হারিয়ে শারাপোভা বুঝিয়ে দিলেন, প্রাণোচ্ছ্বল এক তরুণীর রূপান্তর ঘটছে টেনিস-রানিতে। উইম্বলডনের ইতিহাসে শারাপোভা ছিলেন তৃতীয় সর্বকনিষ্ঠ চ্যাম্পিয়ন। ১৮ বছর বয়সে বিশ্বের এক নম্বর নারী টেনিস খেলোয়াড়ের মুকুট জিতেন শারাপোভা। সেই প্রথম কোনও রুশ নারী টেনিস খেলোয়াড় বিশ্বে এক নম্বর হওয়ার সম্মান অর্জন করেন। পরের বছরই শারাপোভার নামের পাশে যুক্তরাষ্ট্র ওপেন ট্রফি। ২০১২ সালে ফরাসি ওপেন জেতার সঙ্গে দশম নারী হিসেবে ক্যারিয়ার গ্র্যান্ডস্লাম জয়ীদের তালিকায় জায়গা করে নেন এই রুশ-সুন্দরী। অলিম্পিকের পদকও আসে তার পরে। তবে শারাপোভার ক্যারিয়ার-কফিনে কার্যত মূল পেরেকটা ছিল এই নির্বাসনটাই। এরপর আর কখনওই আগের ফর্মে ফিরতে পারেননি চোট আঘাতে জর্জরিত শারাপোভা। যে কারণেই অবসরের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হন মাশা। তবে কোর্টের বাইরে অগণিত অনুরাগীর হৃদয়ে ঝড় তোলা শারাপোভার জীবনে একাধিক পুরুষ আনাগোনার গল্পগুলোও টেনিসপ্রেমী অনেকের জানা। ২০০৫ সালে গায়ক অ্যাডাম লেভাইনের ঘনিষ্ঠ ছিলেন তিনি। নিজের জন্মদিনের পার্টিতে লেভাইনের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল শারাপোভার। কিন্তু সেই প্রেম বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। তিন বছর পর টেলিভিশন প্রোডিউসার চার্লি এবেরসোলের অন্তরঙ্গ হন শারাপোভা। কিন্তু সেই সম্পর্কও ছিল স্বল্পস্থায়ী। ২০০৯ সাল থেকে মারিয়া শারাপোভা ডেট করছিলেন স্লোভেনিয়ান বাস্কেটবল খেলোয়াড় সাশা ভুজাকিকের সঙ্গে। দুই বছর পর হয় এনগেজমেন্টও। কিন্তু ২০১২ সালে টেনিস সুন্দরী নিজেই জানান, তারা দু’জনে সরে এসেছেন সম্পর্ক থেকে। ২০১৩ সালে মাদ্রিদ ওপেনের সময় শারাপোভা জানান, বুলগেরিয়ার টেনিস খেলোয়াড় গ্রিগর দিমিত্রোভের সঙ্গে তার প্রণয়ের সম্পর্ক আছে। কিন্তু দুই বছর পর ভেঙে যায় সেই সম্পর্কও। বর্তমানে কী কারও সঙ্গে সম্পর্ক আছে তার? এই গল্পটাও অজানা। তবে অবসরের পরে কী করবেন? শারাপোভা জানিয়েছেন, এবার সময় কাটবে পরিবার-পরিজন-আলসেমি আর কফির সঙ্গে।
×