ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

শাকিল আহমেদ মিরাজ

এই ভারত নাম্বার ওয়ান!

প্রকাশিত: ১২:০২, ৪ মার্চ ২০২০

এই ভারত নাম্বার ওয়ান!

টানা তৃতীয়বারের মতো আইসিসি টেস্ট র‌্যাঙ্কিংয়ে শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট (গদাইসদৃশ ট্রফি) মাথায় নিয়ে ওয়ার্ল্ড টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের দৌড় শুরু করে ভারত। আভিজাত্যের নতুন মঞ্চে উড়ছিল বিরাট কোহলির দল। দুর্দান্ত সব সাফল্যে হয়ে উঠেছিল অপরাজেয়। নিউজিল্যান্ডে সেই দলটাই এভাবে ভেঙে পড়বে কে ভেবেছিল? হারেরও ধরন থাকে। একটা টেস্টেও দাঁড়াতে পারেনি সফরকারীরা। গড়তে পারেনি ন্যূনতম প্রতিরোধ। ওয়েলিংটনে সাড়ে তিন দিনে হার ১০ উইকেটে। ক্রাইস্টচার্চে আড়াই দিনেই ৭ উইকেটে হারের লজ্জা। দীর্ঘ আট বছর পর কোন সিরিজে হোয়াইটওয়াশ ভারত। টি২০তে দল সাফল্য পেলেও ওয়ানডে হয়ে টেস্টÑ তিন ভার্সনে ব্যাট হাতে কোহলি ছিলেন ভীষণ রকমের ব্যর্থ। মেজাজ হারানোয় মাঠ ও মাঠের বাইরে ভারত অধিনায়কের আচরণ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। প্রশ্ন উঠছে, এই ভারত কিভাবে নাম্বার ওয়ান দল? নিউজিল্যান্ড-লজ্জার পর অবশ্য মোড়লদের রেটিং পয়েন্ট বেশ কমে এসেছে। তাদের চ্যালেঞ্জ জানাতে দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে কিউইরা। টানা পাঁচ সিরিজ জিতে নিউজিল্যান্ডে গিয়ে টেস্টে ৪ রেটিং হারিয়েছে ভারত। এখনও অবশ্য আইসিসি টেস্ট র‌্যাঙ্কিংয়ের এক নম্বরেই আছে কোহলিরা। আর ধারাবাহিক সাফল্যে র‌্যাঙ্কিংয়ের দুইয়ে উঠে এসেছে উইলিয়ামসনের দল। তাদের রেটিং পয়েন্ট এখন ১১০, ভারতের ১১৬। আট বছর পর টেস্টে হোয়াইটওয়াশ হলো ভারত। টেস্টে ১১তমবারের মতো এই স্বাদ পেল ভারতীয়রা। টেস্টে ধবলধোলাই হতে কেমন লাগে, তা প্রায় ভুলতেই বসেছিল ভারত। আর যাই হোক, আট বছর তো মোটেই কম সময় নয়। কোহলিরা ভুলতে বসা সেই স্বাদই পেলেন এবার নিউজিল্যান্ডে এসে। দুই টেস্টের সিরিজে অসহায় আত্মসমর্পণ করেই ০-২ ব্যবধানে হেরেছে। এ সফরে টি২০তে নিউজিল্যান্ডকে ৫-০ ব্যবধানে হারিয়ে ওয়ানডে আর টেস্টে উল্টো হোয়াইটওয়াশের শিকার ভারত। ভারত টেস্টে এর আগে সর্বশেষ হোয়াইটওয়াশ হয়েছিল সেই ২০১১-১২ মৌসুমে। অস্ট্রেলিয়া সফরে চার টেস্টেই হেরেছিল দলটি। ওই সফরের আগে ২০১১ সালে ইংল্যান্ড সফরেও চার ম্যাচের চারটিতে হেরে ধবলধোলাই হয় মহেন্দ্র সিং ধোনির ভারত। এরপরই অবশ্য টেস্ট ক্রিকেটে বদলে যাওয়ার শুরু কোহলিদের। অস্ট্রেলিয়ার সেই সফরের পর এবারের নিউজিল্যান্ড সফরের আগে ২৩টি একাধিক ম্যাচের সিরিজ খেলে ১৬টিতেই জিতেছে ভারতীয়রা। এর ৯টিতেই আবার প্রতিপক্ষকে ধবলধোলাই করেছে দলটি। টানা পাঁচটি সিরিজ জিতে নিউজিল্যান্ডে এসেছিল টেস্ট র‌্যাঙ্কিংয়ের এক নম্বর দলটি। উপহার পেল নিজেদের টেস্ট ইতিহাসের ১১তম ধবলধোলাই। এই ১১ সিরিজের ১০টিই ভারত আবার খেলেছে প্রতিপক্ষের মাঠে। ভারতে এসে ভারতকে ধবলধোলাই করার একমাত্র কীর্তি দক্ষিণ আফ্রিকার। ২০০০ সালে ভারতে এসে ভারতকে ২-০-তে হারিয়ে যায় হান্সি ক্রনিয়ের দক্ষিণ আফ্রিকা। ১৯৩২ সালে টেস্ট অভিষেক হওয়া ভারত প্রথম ধবলধোলাই হয় ১৯৫৯ সালে। ইংল্যান্ড সফরে পাঁচটি টেস্টেই হারে দলটি। ইংল্যান্ডে গিয়ে এরপর ১৯৬৭, ১৯৭৪ ও ২০১১ সালে হোয়াইটওয়াশ হয় ভারতীয়রা। ইংলিশদের কাছেই সবচেয়ে বেশি ধবলধোলাই হয়েছে ভারত। দলটিকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৩ বার ধবলধোলাই করেছে অস্ট্রেলিয়া। এ ছাড়া নিউজিল্যান্ড দুবার এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে একবার করে হোয়াইটওয়াশ হয়েছে ভারতীয়রা। টেস্ট ক্রিকেটে ভারতের চেয়ে কম হোয়াইটওয়াশ হয়েছে মাত্র দুটি দলÑঅস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ড। অস্ট্রেলিয়া ৯ বার ও ইংল্যান্ড ৮ বার পেয়েছে এই লজ্জা। সবচেয়ে বেশিবার ধবলধোলাই হওয়ার রেকর্ডে বিশাল ব্যবধানে এগিয়ে বাংলাদেশ (৩২বার)। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২০ বার হোয়াইটওয়াশ নিউজিল্যান্ড। সফরে অধিনায়ক কোহলি নিজের ছায়া হয়ে ছিলেন। টি২০, ওয়ানডে হয়ে টেস্টÑ ১১ ইনিংসে একটি মাত্র হাফ সেঞ্চুরি! শেষ ২২ আন্তর্জাতিক ইনিংসে নেই কোন সেঞ্চুরি!! শুধু ব্যাটেই নয়, ডিসিশন রিভিউ সিস্টেম বা ডিআরএস নেয়ার ক্ষেত্রেও তিনি ডাহা ফেল মেরে চলছেন ভারত অধিনায়ক। আর সবাই যেন সাবেক অধিনায়াক মহেন্দ্র সিং ধোনির অভাব বেশি করে অনুভব করছেন, যিনি ডিআরএসের সম্রাট। হ্যাগলি ওভালে দ্বিতীয় টেস্টের প্রথম দিনে লাঞ্চের পরে দ্বিতীয় ওভারেই আউট হয়ে যান কোহলি। ১৫ বলে মাত্র ৩ রান করে টিম সাউদির বলে এলবিডব্লিউ হন। ডিআরএস নিয়েছিলেন কোহলি। কিন্তু লাভ হয়নি। ড্রেসিংরুমে ফিরতে হয় তাকে। এই সফরে ১১ ইনিংসে তার ব্যাটে এসেছে মাত্র ২২৫ রান! তিন ফরমেট মিলিয়ে ক্রিকেটে এই নিয়ে টিম সাউদির বলে ১০বার আউট হয়েছেন তিনি। আর কোন বোলার কোহলিকে এত বেশি বার আউট করতে পারেননি। ডিআরএস নেওয়ার ক্ষেত্রেও কোহলির দুঃসময় প্রতিফলিত। টেস্ট ক্রিকেটে এলবিডব্লিউ হয়ে ১৩ বার ডিআরএস নিয়েছিলেন তিনি। যার মধ্যে আউটের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার হয়েছে মাত্র ২ বার। বাকি ১১বারই তিনি আউট হয়েছেন। এর মধ্যে ৯বার তিনি সরাসরি আউট ছিলেন। আর দুই বার আম্পায়ার্স কল হয়েছে। গত বছর বিরাট কোহলি যখন আইসিসির ‘স্পিরিট অব ক্রিকেট’ এ্যাওয়ার্ড পান, অনেকেই তখন বিস্মিত হয়েছিলেন। কারণ মাঠ ও মাঠের বাইরে ভারত অধিনায়কের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ, অতি-আগ্রাসন প্রায়শ ভদ্রতার সীমা ছড়িয়ে যায়। সেটা তিনি নিজেও স্বীকার করেন। এবার নিউজিল্যান্ড সফরে ওয়ানডের আগে তাঁকে যখন প্রশ্ন করা হয়েছিল, বিশ্বকাপের সেমিতে কিউইদের কাছে হারের বদলা নেবেন কি না? উত্তরে তিনি বলেছিলেন কিউইরা এমন প্রতিপক্ষ, ক্রিকেটে ভদ্রতার এমন উদাহরণ, তাদের সঙ্গে ‘প্রতিশোধ’ শব্দটা যায় না। ওয়ানডেতে ৩-০’র পর টেস্টে ২-০ ব্যবধানে হোয়াইটওয়াশ কোহলি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেননি। ক্রাইস্টচার্চ টেস্টে প্রতিপক্ষ অধিনায়ক কেন উইলিয়ামসন এবং গ্যালারিতে উপস্থিত দর্শদের দিকে আঙুল তুলে অশালীন ইঙ্গিত করেছেন। দিন শেষে সংবাদ সম্মেলনে এ নিয়ে প্রশ্ন করলে এক সাংবাদিকের সঙ্গে ভীষণ করমের তর্কে জড়িয়ে পড়েন তিনি। ওই সাংবাদিক কোহলিকে প্রশ্ন করেন, ‘একজন ভারতীয় অধিনায়ক হিসেবে আপনার কি উচিত নয়, মাঠে আরও ভাল উদাহরণ তৈরি করা। আপনি কেন উইলিয়ামসন আউট হওয়ার পর কটু কথা বলেছেন। দর্শকদেরও কটু কথা বলেছেন। উত্তর না দিয়ে কোহলি উল্টো জানতে চান,‘আপনি কী মনে করেন! সেটাই শুনি।’ সাংবাদিক : আমি আপনাকে প্রশ্ন করেছি। কোহলি: ঠিক আছে, আমি আপনার কাছে উত্তরটা জানতে চাই। সাংবাদিক: আপনার উচিত মাঠে আরও ভাল উদাহরণ তৈরি করা। কোহলি: আপনার বের করা উচিত আসলে কী হয়েছিল। এবং এ ব্যাপারে ভাল প্রশ্ন করা। ঘটনাটা পুরোপুরি না জেনে প্রশ্ন করা ঠিক হয়নি আপনার। আর আপনি যদি একটা বিতর্ক তৈরি করতে চান, তাহলে বলব, এটা সঠিক জায়গা নয়। আমি ম্যাচ রেফারির সঙ্গে কথা বলেছি। এ ব্যাপারে তাঁর কোন সমস্যা নেই। ধন্যবাদ।’ ক্রাইস্টচার্চে হারের শঙ্কা মাথায় নিয়ে তৃতীয় দিন মাঠে নামা কোহলিকে বেশ আগ্রাসী মেজাজেই দেখা গেছে। কিউই ব্যাটসম্যান আউট হওয়ার পর ঠোঁটে আঙুল দিয়ে গ্যালারির দিকে তাকিয়ে তিনি চুপ করতে বলার একটা ভঙ্গি করেছিলেন। কেবল ভঙ্গি করেই থামেননি; ভিডিওতে তাঁকে কিছু বলতেও দেখা যায়। সেই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। বাজে হারের পর অনেকেরই অবস্থান তার বিপক্ষে। তবে প্রতিপক্ষ অধিনায়ক কেন উইলিয়ামসন ইতিবাচক, ‘বিরাট এমনই। ও মাঠে খুব আবেগপ্রবণ। এটা নিয়ে জলঘোলা করার কোন মানে হয় না।’
×