ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

হর্ন বাজানোর অসুস্থ প্রতিযোগিতায় কান ঝালাপালা ॥ দায় ও দায়িত্ব

প্রকাশিত: ১০:৫৬, ৪ মার্চ ২০২০

হর্ন বাজানোর অসুস্থ প্রতিযোগিতায় কান ঝালাপালা ॥ দায় ও দায়িত্ব

রাজন ভট্টাচার্য ॥ রাজধানীর শাহবাগ। ব্যস্ত এলাকা। রাস্তার একপাশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ^বিদ্যালয়। অন্যপাশে বারডেম হাসপাতাল। দু’পাশেই হাসপাতালের সামনে দেয়া সাইনবোর্ডে লেখা আছে ‘সামনে হাসপাতাল- হর্ন বাজাবেন না’। তাছাড়া সাইনবোর্ড যদি নাই থাকে তাহলে এখানে দুটি গুরুত্বপূর্ণ হাসপাতাল রয়েছে-কার জানা নেই? কম বেশি সবারই জানা। বিশেষ করে যানবাহন চালানোর সঙ্গে যুক্ত যারা আছেন, তাদের কারও না জানার কারণ নেই। জানা থাকলেও এ নিয়ে ভাবনা কারও আছে বলে মনে হয় না। এই শহরের যে কটি স্থানে উচ্চ মাত্রায় শব্দ দূষণ তার মধ্যে শাহবাগ অন্যতম! সত্যি। যদি দিনের যে কোন সময় একঘণ্টা শাহবাগ মোড়ে থাকেন তবে পাঁচ মিনিটের মধ্যেই কান ঝালাপালা হয়ে যাবে। এরমধ্যে বেশিরভাগই অযথা হর্ন। কোন কারণ ছাড়াই চলার প্রতিযোগিতা থেকেই শব্দ দূষণ করা হয়। রেষারেষি থেকেও এমন হচ্ছে। তবে কি কারও কোন দায় নেই? থাকা উচিত। অযথা হর্ন দেয়া যেন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। কোথায় হর্ন বাজানো যাবে কোথায় যাবে না এ রকম সাধারণ বিষয়গুলো একেবারেই কারও মাথায় থাকে না। এটা হতে পারে না। থাকা উচিত। উন্নত সব শহরেই এমন আছে। যখন বিশে^র উন্নত শহরগুলো হর্নমুক্ত হওয়ার প্রতিযোগিতায়- তখন আমাদের চালকদের মানসিকতা হলো হর্ন দেয়া মানেই আগে যাওয়ার সুযোগ। যখন ট্রাফিক সিগন্যাল বিলম্ব হয় তখন মোটরসাইকেল, বাস, প্রাইভেটকার চালকসহ সব ধরনের পরিবহন চালকরাই একযোগে হর্ন দেয়া শুরু করেন। এটা কোন অভ্যাস হতে পারে না। একেবারেই বদভ্যাস বলা যায়। যা নিয়মের মধ্যেও পড়ে না। রাজধানীর শাহবাগ, ঢাকা মেডিক্যাল, সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল, মুগদা জেনারেল হাসপাতাল, মিটফোর্ড হাসপাতাল, সেন্ট্রাল হাসপাতাল, ল্যাব এইডসহ বিভিন্ন সরকারী বেসরকারী হাসপাতাল এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সাধারণ এলাকা থেকে বিশেষ এলাকায় শব্দের কোন পার্থক্য নেই। বরং কোথাও বেশি। আবার মূল রাস্তার পাশে যেসব নামী-দামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে সে এলাকাতেও পাওয়া গেছে উচ্চ শব্দ। ট্রাফিক পুলিশ বলছে, চালকদের উচ্চ শব্দের কারণে কখনও মৌখিকভাবে সতর্ক করা হয়। কখন করা হয় মামলা ও জরিমানা। বিআরটিএ কর্তৃপক্ষ একই কথা বলছে। মাঠের চিত্র বলছে, পরিস্থিতি উন্নতি না হওয়ার। নগরে এখন যানবাহনের সংখ্যা ১৫ লাখ ৪১ হাজারের বেশি। এরমধ্যে দূষণকারী বাহন হিসেবে পরিচিত মোটরসাইকেলের সংখ্যাই প্রায় সাত লাখ ২৫ হাজার। বাসের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৩৬ হাজার। মিনিবাসের সংখ্যা ১০ হাজারের বেশি। প্রাইভেটকারের সংখ্যা প্রায় তিন লাখ। পুলিশ ও বিআরটিএ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা জানিয়েছেন, এসব যানবাহন বেশি শব্দ দূষণের জন্য দায়ী। নগরীর সাধারণ মানুষ মনে করেন, চালকদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণের অভাবে নগরীতে দিন দিন শব্দ দূষণের মাত্রা পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। তাছাড়া এ বিষয়ে চালকরা মোটেও সচেতন নন। পরিবহন মালিকরাও এ বিষয়ে যথাযথ ভূমিকা রাখেন না। সব মিলিয়ে চালকরা নিজেদের মতো করেই সড়কে চলতে চান। ফলে বিনা কারণে হর্ন দেয়া তাদের মানসিক শান্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বুধবার রাজধানীর কাকরাইল, শান্তিনগর, পল্টন, প্রেসক্লাব, শাহবাগ, মতিঝিল, দৈনিক বাংলা, নয়া পল্টন, মগবাজার, বাংলামোটরসহ বিভিন্ন সিগন্যাল ঘুরে দেখা গেছে, একপাশে গাড়ির চাপ বেশি থাকায় অন্যপাশে সিগন্যাল ছাড়তে কখনও বিলম্ব হয়। ট্রাফিকের হাত বা বাঁশির ইশারার জন্য অপেক্ষা করার সময় নেই। জেব্রা ক্রসিং ছাড়িয়ে যায় বেশিরভাগ যান। কেউ গাড়ি বন্ধ রাখেন। কেউ চালু করে আছেন সিগন্যালের অপেক্ষায়। আর বিলম্ব মানেই সব ধরনের চালকরা মিলে একযোগে হর্ন। কোন কোন সিগন্যাল হর্ন বন্ধে কর্তব্যরত ট্রাফিককে জোড় হাত করে ক্ষমা চাইতে দেখা গেছে। ভাবটা এমন যেন হয় সিগন্যাল ছাড়, নয়ত হর্ন চলবে। অথচ নতুন সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ অনুযায়ী উচ্চ মাত্রায় হর্ন বাজালে তিন মাসের কারাদ- ও ১০ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। কিন্তু মালিক-শ্রমিকদের চাপের মুখে নতুন আইন অনুযায়ী অভিযান শুরু হলেও জরিমানা ও দ- সেভাবে কার্যকর সম্ভব হচ্ছে না। জরিপে দেখা গেছে, ঢাকা শহরের প্রায় সব এলাকাতেই গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে বেশি শব্দ হচ্ছে। সরকার সচিবালয়ের চারপাশের এলাকাকে নীরব এলাকা ঘোষণা করার পরেও সেখানে শব্দ দূষণ বন্ধ হয়নি। সচিবালয়ের চারপাশ ছাড়াও ঢাকার অন্য এলাকাগুলোতেও নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে বেশি শব্দ হচ্ছে। স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুম-লীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) সমীক্ষায় এই চিত্র উঠে এসেছে। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) ও ক্যাপস-এর যৌথ উদ্যোগে সম্প্রতি ওই গবেষণার ফল তুলে ধরা হয়। ‘তীব্র শব্দ দূষণের কবলে ঢাকাবাসী’ শীর্ষক ওই গবেষণার ফল তুলে ধরেন গবেষণা দলের প্রধান ও ক্যাপস-এর পরিচালক অধ্যাপক আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার। গবেষণার ফল তুলে ধরতে গিয়ে অধ্যাপক আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, সচিবালয় এলাকাকে নীরব ঘোষণার আগে ও পরে অর্থাৎ গত বছরের ১৪ ডিসেম্বর থেকে ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত ওই এলাকায় জরিপ চালানো হয়। স্বয়ংক্রিয় সাউন্ড লেভেল মিটারের সাহায্যে ১২টি স্থানে দিনব্যাপী ৩০০ বার উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়। শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা ২০০৬ অনুযায়ী, সচিবালয় এলাকায় দিনের বেলায় শব্দের মাত্রা ৫০ ডেসিবেল থাকার কথা ছিল। কিন্তু জরিপে দেখা গেছে, দিনের বেলায় শব্দের মাত্রা কখনই ৫০ ডেসিবেলের নিচে ছিল না। গবেষণাটিতে দেখা গেছে, ১২টি স্থানের প্রতিটিতেই দিনের বেলায় শতভাগ সময় নীরব এলাকার জন্য প্রযোজ্য মানমাত্রার (৫০ ডেসিবেল) চেয়ে বেশি মাত্রায় শব্দ হয়েছে। ১২টি স্থানের মধ্যে সচিবালয়ের পশ্চিমে মসজিদের পাশের এলাকা বাদে সব জায়গায় ৭০ ভাগ এর বেশি সময় ধরে ৭০ ডেসিবেল (তীব্রতর) এর বেশি শব্দের মাত্রা ছিল। সামগ্রিকভাবে ১২টি স্থানে সম্মিলিতভাবে ৯১ দশমিক ৯৯ ভাগ সময় ৭০ ডেসিবেল-এর বেশি মাত্রার শব্দ হয়েছে। সর্বোচ্চ সময় ধরে তিনটি স্থানে শব্দের মাত্রা সবচেয়ে বেশি ছিল। সেগুলো হলো- পল্টন বাস স্ট্যান্ড (১০০ ভাগ সময়), জিরো পয়েন্ট (৯৯ দশমিক ৪ ভাগ সময়) এবং কদম ফোয়ারা (৯৯ দশমিক ২ ভাগ সময়)। এই তিনটি জায়গায় নিয়মিতভাবে শব্দের মাত্রা ৭০ ডেসিবেলের বেশি ছিল। এ ছাড়া ক্যাপস-এর গবেষণা দল ঢাকা শহরের ৭০টি এলাকায় শব্দদূষণ জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করে। গবেষণায় দেখা যায়, নীরব, আবাসিক ও মিশ্র এলাকার ক্ষেত্রে শব্দের মাত্রা ১০০ ভাগ সময় আদর্শ মানের ওপরে ছিল (নীরব এলাকার আদর্শ মান ৫০ ডেসিবেল, আবাসিক এলাকার আদর্শ মান ৫৫ ডেসিবেল, মিশ্র এলাকার আদর্শ মান ৬০ ডেসিবেল)। বাণিজ্যিক এলাকায় শব্দের মাত্রা আদর্শ মানের চেয়ে ৯৭ দশমিক ৫৮ ভাগ সময় বেশি মাত্রায় ছিল (বাণিজ্যিক এলাকার আদর্শ মান ৭০ ডেসিবেল)। শিল্প এলাকায় শব্দের মাত্রা আদর্শ মানের চেয়ে ৭১ দশমিক ৭৫ ভাগ সময় বেশি মাত্রায় ছিল (শিল্প এলাকার আদর্শ মান ৭৫ ডেসিবেল)। বাপার মোঃ আবদুল মতিন বলেন, উচ্চ শব্দের কারণে মানুষ হৃদরোগে আক্রান্ত হতে পারে। সচেতনতা তৈরি করা ছাড়া শুধু আইন করে শব্দ দূষণ বন্ধ করা সম্ভব নয়। সরকারী দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের মধ্যে অনেকেই গাড়িতে ৩টি হর্ন ব্যবহার করেন, যার মধ্যে একটি হাইড্রোলিক হর্ন। উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারাই যখন আইনের তোয়াক্কা করেন না, তখন সাধারণ ট্রাক-বাস চালকরা কীভাবে আইন মানবে? সবার আগে সমাজের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে শব্দ দূষণ বন্ধের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, স্কুটার বা মোটরসাইকেলের হর্ন ৮৭ থেকে ৯২ ডিবি এবং ট্রাক-বাস ৯২ থেকে ৯৪ ডিবি শব্দ সৃষ্টি করে। শব্দের বাঞ্ছনীয় মাত্রা রয়েছে, যা ব্যক্তিগত কক্ষে ২৫ ডিবি, ড্রয়িং বা ডাইনিং কক্ষে ৪০ ডিবি, অফিসে ৩৫-৪০ ডিবি, শ্রেণীকক্ষে ৩০-৪০ ডিবি, গ্রন্থাগারে ৩৫-৪০ ডিবি, হাসপাতালে ২০-৩৫ ডিবি, রেস্তরাঁয় ৪০-৬০ ডিবি এবং রাতে শহর এলাকায় ৪৫ ডিবি। শব্দ এই সীমা অতিক্রম করলে শব্দদূষণের সৃষ্টি হয়। সীমার বাইরের শব্দদূষণ শ্রবণক্ষমতা নষ্ট করে। এর ফলে মানসিক ভারসাম্যও বিনষ্ট হতে পারে। শব্দদূষণ খিটখিটে মেজাজ সৃষ্টিরও কারণ। এর দ্বারা ফুসফুস আক্রান্ত হয়, শিশুদের বুদ্ধিমত্তা বাধাগ্রস্ত হয় এবং তাদের লেখাপড়ায় উদাসীন করে তোলে। মাত্রাতিরিক্ত শব্দের কারণে ইতোমধ্যে দেশের প্রায় ১২ শতাংশ মানুষের শ্রবণশক্তি হ্রাস পেয়েছে বলে পরিবেশ অধিদফতরের সাম্প্রতিক জরিপে উঠে এসেছে। সেই সঙ্গে যোগ হয়েছে উচ্চ রক্তচাপ, হৃদ?রোগসহ, ফুসফুসজনিত জটিলতা, মস্তিষ্ক বিকৃতি, স্মরণশক্তি হ্রাস, মানসিক চাপসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যা। ডিএমপির তথ্য অনুযায়ী, গত ছয় মাসে ট্রাফিক পুলিশ ১৮ হাজার ৫২২টি হাইড্রোলিক হর্ন জব্দ করেছে। এ সময় ১০ লাখ ২২ হাজার ৩৩৮টি মামলা হয়েছে।
×