ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

পরিস্থিতি থমথমে, অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন ॥ পৃথক তদন্ত কমিটি

খাগড়াছড়িতে গ্রামবাসীর সঙ্গে সংঘর্ষে বিজিবি সিপাহীসহ হত ৫

প্রকাশিত: ১০:৫৫, ৪ মার্চ ২০২০

খাগড়াছড়িতে গ্রামবাসীর সঙ্গে সংঘর্ষে বিজিবি সিপাহীসহ হত ৫

মোয়াজ্জেমুল হক/জীতেন বড়ুয়া ॥ পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গার গাজী নগরে বিজিবি (বর্ডার গার্ড পুলিশ) সদস্যদের সঙ্গে গ্রামবাসীর সংঘর্ষে এক সিপাহীসহ ৫ জন নিহত হয়েছে। গাজীনগরের বাঙালী অধ্যুষিত এলাকায় মঙ্গলবার বেলা পৌনে ১২টার দিকে সংঘর্ষের এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় আহতদের মধ্যে গুলিবিদ্ধ হানিফ নামের একজনকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় মাটিরাঙ্গা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে। আহত অন্যদের স্থানীয় হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। এদিকে, এ ঘটনার পর সন্ধ্যায় বিজিবির পক্ষে এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, অবৈধ কাঠ পাচার রোধে অনাকাক্সিক্ষত এ ঘটনা ঘটেছে। বিজিবির পক্ষে আরও বলা হয়েছে, কাঠ পাচার রোধে ব্যবস্থা নেয়া হলে স্থানীয় লোকজন টহল দলকে ঘিরে অস্ত্র ছিনিয়ে নিয়ে অনিয়ন্ত্রিতভাবে গুলিবর্ষণ করলে হতাহতের এ ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনার পর জেলা, উপজেলা ও সেনা প্রশাসনের উর্ধতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। ঘটনা তদন্তে জেলা, সেনা ও বিজিবির পক্ষে পৃথক পৃথক কমিটি গঠন করা হয়েছে। এলাকার পরিস্থিতি থমথমে হয়ে উঠায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। স্থানীয় সকলকে শান্ত থাকার অনুরোধ জানানো হয়েছে জেলা ও সেনা প্রশাসন থেকে। স্থানীয় ও অন্যান্য সূত্রে জানা গেছে, গাজীনগরের উক্ত স্থানে পিডিবির পক্ষে বিদ্যুতের খুঁটি স্থাপনে কিছু গাছ স্থানীয়দের সহায়তায় কাটা হয়। উক্ত গাছসমূহের চারটি টুকরা নিয়ে একটি ট্রাক্টরযোগে স্থানীয় মোঃ সাহাব উদ্দিন মিয়া ও তার দু’পুত্র অনতিদূরে একটি কাঠের মিলে যাওয়ার পথে বিজিবি সদস্যরা বাধা দেয়। টহলদল এসব কাঠ চোরাই বলে উল্লেখ করে। কিন্তু বহনকারীরা তা নয় বলে জানান দেয়। কিন্তু কোন সুরাহা হচ্ছিল না। এ অবস্থায় বাধা দেয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে কাঠের টুকরো বহনকারীদের সঙ্গে বাগবিত-া চলতে থাকে। বিত-ার একপর্যায়ে স্থানীয়দের অনেকেই জড়ো হতে থাকে। গ্রাসবাসীদের অনেকে লাঠিসোটা নিয়ে হাজির হলে বাগ্বিত-া তীব্র রূপ নেয়। ঘটনার ভয়াবহতা এড়াতে বিজিবি সদস্যরা গুলিবর্ষণ করে। এ সময় কয়েক বিজিবি কর্মকর্তা ও সদস্য গুলি ও ব্রাশ ফায়ারের হুঙ্কার দিতে শোনা যায়। শুরু হয় গুলিবর্ষণ। ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারায় মোঃ সাহাব উদ্দিন মিয়া (৫৫) ও তার দু’পুত্র যথাক্রমে আলী আকবর (২৭) ও আহমদ আলী (২৪)। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় হাসপাতালে নেয়ার পথে মারা যান মফিজ মিয়া (৫০)। এছাড়া গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান বিজিবি সিপাহী মোঃ শাওন (২৯)। তার শরীরেও গুলি লেগেছে। সিপাহী শাওনের শরীরে কাদের ছোড়া গুলি লেগেছে তা এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত শনাক্ত করা না গেলেও বিজিবির পক্ষে বলা হয়েছে গ্রামবাসীর পক্ষে তাদের অস্ত্র ছিনিয়ে নেয় গুলিবর্ষণ করা হলে শাওন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। তবে স্থানীয়রা এ ঘটনা অস্বীকার করেছে। এছাড়া বিজিবির গুলিবর্ষণের সময় গ্রামবাসীদের পক্ষে পাল্টা গুলি ছোড়ার কোন দৃশ্যও দেখা যায়নি। অপরদিকে, স্বামী সাহাবউদ্দিন মিয়া ও দু’সন্তান মারা যাওয়ার খবর পেয়ে স্ত্রী রঞ্জু বেগমের হার্ট এ্যাটাক হয়। চাউর হয়ে যায় তিনি মারা গেছেন। কিন্তু পরবর্তীতে তার জ্ঞান ফিরে আসে। স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, মূলত বিজিবির পক্ষে বিদ্যুতের পিলার স্থাপনের জন্য ওইস্থানে কিছু গাছ কাটা হয়। এলাকাটি বিরোধপূর্ণ বলেও তাৎক্ষণিক অভিযোগ পাওয়া গেছে। কাটা গাছের কিছু টুকরো গাজীনগর বাজারের কাঠের মিলে নিয়ে যাওয়ার পথে বাগ্বিত-া কেন সৃষ্টি হয় তার কোন ব্যাখ্যা মিলেনি। প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, পাহাড়ে বনাঞ্চল রক্ষার্থে সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বিজিবির ওপর দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। গাছের টুকরা কোত্থেকে এবং কার আদেশে নেয়া হচ্ছে তা বিজিবির সদস্যদের পক্ষ থেকে জানতে চাওয়া হলে সাহাব উদ্দিন ও তার দুইপুত্র স্থানীয় প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের আদেশে নিয়ে যাচ্ছেন বলে অবহিত করেন। কিন্তু টহলরত বিদেশী সদস্যরা এ বক্তব্য মানতে রাজি হয়নি। ফলে বাগ্বিত-া দীর্ঘ হতে থাকে। চিল্লাহল্লা চলতে থাকার প্রেক্ষাপটে পাশের লোকজন এগিয়ে আসে। এ সময় অনেকের সঙ্গে লাঠিসোটাও দেখা যায়। একপক্ষ আরেক পক্ষের ওপর হামলে পড়ার পরিস্থিতিতে বিজিবি সদস্যরা গুলিবর্ষণ করলে মর্মান্তিক এ ঘটনা ঘটে বলে স্থানীয় বিভিন্ন সূত্রে নিশ্চিত করা হয়েছে। ঘটনা নিয়ে মাটিরাঙ্গা ১ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর মোঃ সাইফুল ইসলাম জানিয়েছেন, দীর্ঘদিন ধরে টহলদানে নিয়োজিত বিজিবির কিছু সদস্য সাধারণ মানুষকে নানাভাবে হয়রানি শুরু করেছে। সাধারণ মানুষ নিজেদের বাড়ির আঙিনার গাছ কেটে নিতে চাইলেও বিজিবি বাধা প্রদান করে আসছে। মাটিরাঙ্গা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শামসুদ্দিন ভুঁইয়া এ ঘটনায় বিজিবি সিপাহীসহ ৫ জন নিহত হওয়ার ঘটনা জানিয়ে বলেন, পরিস্থিতি থমথমে রূপ নেয়ায় ইতোমধ্যে ঘটনাস্থলে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। প্রায় ২০ থেকে ২৫ মিনিট স্থায়ী এ ঘটনা শেষে বিকেল ৩টার দিকে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন সেনাবাহিনীর গুঁইমারা রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোঃ শাহরিয়ার জামান, বিজিবির গুঁইমারা সেক্টর কমান্ডার, খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক প্রতাপ চন্দ্র বিশ^াস, জেলা পুলিশ সুপার মোঃ আবদুল আজিজ, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এমএম সারাহ উদ্দিন, উপজেলা চেয়ারম্যান মোঃ রফিকুল ইসলাম, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিভীষণ কান্তি দাশ, মাটিরাঙ্গা পৌরমেয়র মোঃ শামসুল হক ও উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি এম হুমায়ুন মোরশেদ খান। প্রশাসনের কর্মকর্তা ঘটনার প্রসঙ্গ নিয়ে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলেন। স্থানীয় জেলা ও সেনা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে প্রধান করে ৩ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। জেলা প্রশাসক প্রতাপ চন্দ্র বিশ^াস জানিয়েছেন, তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পরই দোষীদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তিনি উপস্থিত সকলকে শান্ত থাকার অনুরোধ জানান। অপরদিকে, গুঁইমারা রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোঃ শাহরিয়ার জামান সকলকে শান্ত থাকার অনুরূপ আহ্বান জানিয়ে বলেন, কেউই আইনের উর্ধে নন। এ ঘটনায় ইতোমধ্যে সরকারের উচ্চপর্যায়ে অবহিত করা হয়েছে। এ সময় স্থানীয়দের পক্ষে বিজিবি ক্যাম্প প্রত্যাহারের দাবি জানানো হলে রিজিয়ন কমান্ডার জানান, গুটি কয়েকের জন্য পুরো একটি বাহিনীকে দোষারোপ করা যাবে না। বিজিবির বক্তব্য ॥ এ ঘটনার পর সন্ধ্যায় বিজিবির পক্ষে গণমাধ্যমে প্রেরিত এক প্রেসবিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, সকাল পৌনে ১১টার দিকে মাটিরাঙ্গা উপজেলার গাজীনগর বাজার থেকে প্রায় এক শ’ গজ দক্ষিণে এ ঘটনা ঘটেছে। বিজিবির একটি টহল দল অবৈধ কাঠপাচার রোধে ব্যবস্থা নিতে গেলে বেসামরিক স্থানীয় লোকজন সংস্থার টহল দলকে ঘিরে ধরে। এতে বিজিবি টহল দলও স্থানীয় বেসামরিক লোকজনের মধ্যে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। একপর্যায়ে বিজিবি এক রাউন্ড ফাঁকা ফায়ার করে। এরইমধ্যে ধাক্কাধাক্কির রেশ ধরে একপর্যায়ে বেসামরিক কিছু লোক বিজিবির অস্ত্র ছিনিয়ে নিয়ে অনিয়ন্ত্রিতভাবে গুলিবর্ষণ করে। এতে বিজিবির সিপাহী শাওন ও অন্যান্য বেসামরিক লোকের গায়ে গুলি লাগে। ফলশ্রুতিতে বিজিবি সদস্য শাওন ও বেসামরিক অন্যরা মৃত্যুবরণ করে। এ ঘটনার প্রেক্ষিতে ইতোমধ্যে জেলা, সেনা ও বিজিবির পক্ষে পৃথকভাবে তদন্ত শুরু হয়েছে। তদন্ত শেষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
×