ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

স্টার্টআপে উদ্যোক্তাদের সাফল্য

প্রকাশিত: ১৩:২৫, ৩ মার্চ ২০২০

স্টার্টআপে উদ্যোক্তাদের সাফল্য

সুমন্ত গুপ্ত আমাদের দেশে স্টার্টআপ শব্দটি বর্তমানে দারুণ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে তরুণদের কাছে। মূলত সমাজে বিদ্যমান নানান রকমের সমস্যার সমাধানে বা প্রয়োজন মেটাতে যখন এক বা একাধিক উদ্যোক্তা সীমিত পুঁজি নিয়ে একেবারেই নতুন ও ভিন্নধর্মী কোন ব্যবসা শুরু করে, সেটিকেই বলা হয় স্টার্টআপ। আজকের সময়ের স্টার্টআপের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, এই ব্যবসার সঙ্গে গভীর যোগাযোগ রয়েছে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির ওপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠছে বেশিরভাগ স্টার্টআপ। সাম্প্রতিক কিছু দৃষ্টান্ত দেখুন, দেখা যাবে, তরুণদের সব নতুন উদ্যোগই কিন্তু মূলত প্রযুক্তিনির্ভর। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে প্রাথমিকভাবে শুরু হয় এর পরিকল্পনা ও নির্মাণকাজ। ২০১৭ সালের জুন মাসে ‘স্টার্টআপ চ্যালেঞ্জ ২০১৭’ প্রতিযোগিতায় জয়ের ফলে এর অগ্রগতি আরও ত্বরান্বিত হয় এবং সে বছরই জুলাই মাসে এ্যান্ড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেম ব্যবহারকারীদের জন্য এটির পরীক্ষামূলক (বেটা) সংস্করণ প্রকাশিত হয়। এরপর ২০১৮ সালের আগস্টে এ্যাপটির নতুন সংস্করণ আসে গুগল প্লেস্টোরে। একই বছর সেপ্টেম্বরে ঢাকার আইসিটি টাওয়ারে আনুষ্ঠানিকভাবে এ্যাপটির বাণিজ্যিক যাত্রা শুরুর ঘোষণা দেওয়া হয়। সেই যাত্রার এক বছর পেরোতে না পেরোতেই পণ্য পরিবহনের একটি নির্ভরযোগ্য সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে খ্যাতি পেতে শুরু করেছে ‘ট্রাক লাগবে’। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ফোরাম আয়োজিত প্রতিযোগিতায় দেশের ১৬৮টি কোম্পানির মধ্য থেকে ‘ট্রাক লাগবে’ জিতে নিয়েছে ‘বেস্ট টেকনোলোজি ইনোভেশন’ পুরস্কার। সেই প্রতিযোগিতায় বিজয়ী নির্বাচিত হয়েছিল মোট ২০টি উদ্ভাবনী প্রকল্প। বিজয়ীরা আর্থিক সহায়তা ছাড়াও পেয়েছিল গাজীপুরের কালিয়াকৈর বঙ্গবন্ধু হাইটেক পার্ক ও যশোরে শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্কে কাজের সুযোগ। সেই প্রতিযোগিতারই প্রথম স্থান জিতে নেওয়া, অর্থাৎ সেরাদের সেরা প্রকল্পটির ব্যাপারে। কী ছিল সেটি? এটি ছিল ট্রাক ভাড়া করা বা ভাড়া দেওয়ার একদমই নতুন ও যুগোপযোগী এক উদ্যোগ, যার নাম ‘ট্রাক লাগবে’। ট্রাক ভাড়া করা বা ভাড়া দেওয়ার যুগোপযোগী এক উদ্যোগের নাম ‘ট্রাক লাগবে। মীর হোসেইন একরাম ও এনায়েত রশিদ সেই ছোট্টবেলার বন্ধু। বড় হয়েছেন পাশাপাশি বাড়িতে, লেখাপড়াও করেছেন একই স্কুলে ও কলেজে। বিশ্ববিদ্যালয়টি ছিল শুধু আলাদা। সেই বিচ্ছেদ এনায়েত-একরাম মিটিয়েছেন কাজের ক্ষেত্রে এসে। দুই বন্ধু এখন মোবাইল এ্যাপের সাহায্যে মানুষকে ট্রাক খুঁজে দেন। তাঁদের এই সেবা চলছে দেশজুড়ে। আর তাঁদের উদ্যোগটির নাম ‘ট্রাক লাগবে’। এনায়েত-একরাম দু’জনই এসেছেন ব্যবসায়ী পরিবার থেকে, ব্যবসার ইচ্ছা ছিল গোড়াতেই। তবে ‘ট্রাক লাগবে’ তাঁদের প্রথম ব্যবসা নয়। এর আগে নানা ধরনের ব্যবসার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। তাঁরা প্রথমে শুরু করলেন অনলাইন কাঁচাবাজারের একটি উদ্যোগ। কিন্তু তখনো দেশে তথ্যপ্রযুক্তি চালু হয়নি। অনলাইনে গ্রোসারি পণ্য কেনায় মানুষ তেমন একটা সাড়া দেয়নি। তাই এটি ছেড়ে তাঁরা শুরু করলেন গাড়ির যন্ত্রাংশের ব্যবসা। তাতেও বিফল হলেন। এরপর যখন যে যার পারিবারিক ব্যবসায়ে মন দিলেন তখন ঘটল ‘আসল’ ঘটনা। একদিন এনায়েত রশিদ ব্যবসার হিসাব-নিকাশ করতে গিয়ে দেখলেন একই জায়গায় একই পণ্য পরিবহনে একবার তাঁর লেগেছে আট হাজার টাকা, আরেকবার পঁয়ত্রিশ হাজার। বিশাল এই ব্যবধান সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে এনায়েত বুঝতে পারলেন, ট্রাকভাড়ার বিষয়টি বড্ড গোলমেলে। এই গোলমালটার যতটা সম্ভব সুরাহা করার লক্ষ্যে বন্ধু মীর হোসেইন একরামকে নিয়ে শুরু করলেন নতুন উদ্যোগ, ‘ট্রাক লাগবে’। তাদের লক্ষ্যটা ছিল খুবই সাধারণ অথচ কার্যকরী। সেটি হলো, দেশের যে কোন জায়গা থেকে, যে কোন সময় পণ্য পরিবহনের জন্য প্রয়োজনীয় ট্রাক, পিকআপ ও কাভার্ড ভ্যান মানুষের হাতের নাগালে নিয়ে আসা এবং এ সংক্রান্ত যাবতীয় ঝক্কি-ঝামেলার অবসান ঘটানো। আর সে উদ্দেশ্য নিয়েই তারা তৈরি করেন ‘ট্রাক লাগবে’ নামক এ্যাপটি। এই এ্যাপটির কার্যপদ্ধতি অনেকটা রাইড শেয়ারিং বা পার্সেল এ্যাপগুলোর মতোই। যখন কোন পণ্য প্রেরকের ট্রাকের প্রয়োজন হবে, তখন তিনি এ্যাপের মাধ্যমে তার চাহিদার কথা জানিয়ে দেবেন। এরপর সেই চাহিদার বিবরণ পৌঁছে যাবে আশপাশের ট্রাক মালিকদের কাছে। এরপর আগ্রহী ট্রাক মালিক বা চালকরা তাদের কাক্সিক্ষত ভাড়ার কথা জানাবেন। সব ঠিকঠাক হলে পণ্য প্রেরক সেই এ্যাপ দিয়েই ভাড়া করে নিতে পারবেন ট্রাক। আজকের সময়ে এমন একটি এ্যাপের প্রয়োজনীয়তা যে ঠিক কতটা, তা নিশ্চয়ই আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। মালামাল স্থানান্তর বা পরিবহনের জন্য প্রায় সময়ই আমাদের প্রয়োজন হয় ট্রাক বা পিকআপ ভ্যানের। কিন্তু প্রয়োজনের সময় অন্য যে কোন জিনিসের মতই, হাতের নাগালে এগুলো পাওয়াটাও ভীষণ কষ্টকর হয়ে যায়। এছাড়া ট্রাক স্ট্যান্ডে যাওয়া-আসার ঝামেলা, পরিচিত ট্রাক ড্রাইভারদের ফ্রি না পাওয়া ইত্যাদি নানা কারণেও ট্রাক ভাড়া করার এই বিষয়টি পীড়াদায়ক হয়ে দাঁড়ায়। এ ধরনের যাবতীয় সমস্যার সহজ সমাধান সম্ভব ‘ট্রাক লাগবে’ এ্যাপটির মাধ্যমে। তাছাড়া ট্রাকে পণ্য তুলে দেওয়ার পরও কি হাফ ছেড়ে বাঁচার উপায় আছে? তখন আবার নতুন এক চিন্তা মনের কোণে উঁকি দিতে থাকে, ট্রাকচালক ঠিক ঠিক পণ্য পৌঁছে দেবে তো! এই চিন্তা থেকেই মুক্ত রাখবে ‘ট্রাক লাগবে’ এ্যাপটি। কেননা এ্যাপের সকল ট্রাক ড্রাইভার ও তাদের গাড়িগুলো নিবন্ধিত। ফলে পণ্যের পরিবহন হয় একদম নিরাপদে। শুরুতে মাত্র ৩৬টি ট্রাক ও চারজন মানুষ নিয়ে যাত্রা শুরু করে ‘ট্রাক লাগবে’। এখন ট্রাক লাগবের নেটওয়ার্কে আছে ৫০ হাজারেরও বেশি ট্রাক এবং একশ’র ওপরে কর্মী। রাজধানীর মহাখালীতে তিনতলা একটি অফিসও ভাড়া করা হয়েছে। বাজার হিসাব-নিকাশ করে একরাম-এনায়েত দারুণ এক নিয়ম বের করলেন, তাঁদের ট্রাকের ভাড়া দূরত্ব অথবা কী পণ্য পরিবহন করা হচ্ছে, এর ওপর নির্ভর করে না। বরং তাঁরা এটা ছেড়ে দেন ট্রাকের মালিক ও যে ট্রাক চাচ্ছে তাঁদের ওপর। এখানে ট্রাক ভাড়া করার নিয়ম হচ্ছে, প্রথমে গ্রাহককে জানাতে হয় কোথা থেকে কোথায় যাবে ট্রাক এবং কেমন ট্রাক লাগবে। এরপর একটা নির্ধারিত সময় ধরে ট্রাকমালিকেরা যে যার মতো ভাড়া জানাতে থাকেন। অনেক দাম এলে সেখান থেকে গ্রাহক সাশ্রয়ী দামের সুবিধামতো ট্রাকটি বেছে নেন।
×