ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

করোনায় ইউরোপের বাজার নিয়ে শঙ্কা

প্রকাশিত: ১২:১৫, ৩ মার্চ ২০২০

করোনায় ইউরোপের বাজার নিয়ে শঙ্কা

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্ব থেকে এক প্রকার একঘরে হয়ে পড়েছে দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনেতিক রাষ্ট্র চীন। সে প্রভাব পড়তে শুরু করেছে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পেও। কারণ দেশের তৈরি পোশাক শিল্পের কাঁচামাল ও মূলধনী যন্ত্রপাতির জন্য আমরা চীনের প্রতি নির্ভরশীল। দেশের পোশাক খাতে যে কাঁচামাল আসে, তার ৬০ শতাংশই আসে চীন থেকে। আর নিটওয়্যার খাতের ১৫ থেকে ২০ শতাংশ কাঁচামাল আসে দেশটি থেকে। এছাড়া প্রয়োজনীয় রাসায়নিক এবং খুচরা পণ্য ছাড়াও কাপড়, পলি, জিপার, রং ইত্যাদি আসে দেশটি থেকে। তৈরি পোশাক কারখানার মালিকরা বলছেন, করোনাভাইরাসের কারণে পোশাক কারখানা চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। চীন থেকে যেসব কাঁচামাল আমদানি হতো সেগুলোর দাম দেশের বাজারে প্রায় চারগুণ বেড়েছে। আগে অর্ডার করা কিছু কাঁচামাল আসা শুরু হলেও শঙ্কা তৈরি হয়েছে বিশ্ববাজার নিয়ে। কারণ এরইমধ্যে করোনাভাইরাস চীনের গ-ি পেরিয়ে আঘাত হানতে শুরু করেছে ইউরোপসহ ৫৩টি দেশে। এ দেশগুলোতে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন দুই হাজার চার শ’ জন, মারা গেছেন ৩৭ জন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও ইউরোপের বাজারের ঐতিহ্যবাহী সরবরাহকারীদের কাছে শক্তিশালী প্রতিযোগী বাংলাদেশ। পোশাক শিল্প খাতের ৬০ শতাংশ আয় আসে ইউরোপ থেকে। শিল্প উদ্যোক্ততারা বলছেন, এতদিন চীন থেকে কাঁচামাল আসতে পারেনি। দেশটিতে দীর্ঘ ছুটি ছিল পাশাপাশি করোনাভাইরাস যোগ হয়। তবে চীনের ছুটি শেষে দেশের বাজারে কিছুটা মালামাল আসতে শুরু করলেও শঙ্কা ইউরোপকে নিয়ে। ইউরোপে এ ভাইরাস ব্যাপক ছড়ালে কোন পর্যটক আসবে না, তারা ঘর থেকেও বের হবেন না। এতে বড় ধরনের ধাক্কা লাগবে এ খাতে। তবে করোনা সঙ্কটে পোশাক খাতের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ কত হবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না। উদ্যোক্তাদের মতে, বর্তমানে বিশ্ব বাজারে অনেকটাই কমে গেছে পণ্যের দাম। এ কারণে অনেক ছোট কারখানা বিশ্ববাজারের প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে বন্ধ হয়ে গেছে। এরপর যদি ইউরোপে করোনাভাইরাস ব্যাপক আকার ধারণ করে তবে টিকে থাকাই অসম্ভব হয়ে পড়বে। কারণ ইউরোপের বাজারের ঐতিহ্যবাহী সরবরাহকারীদের কাছে শক্তিশালী প্রতিযোগী বাংলাদেশ। চীনের সঙ্গে গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মোট বাণিজ্য প্রায় ১৪.৬৮ বিলিয়ন ডলারের। পোশাক খাতে বিশেষ করে ওভেন খাতের কাঁচামালে ৬০ শতাংশ আসে চীন থেকে আর নিট খাতে প্রায় ২০ শতাংশ আসে চীন থেকে। এছাড়া অন্যান্য অনেক শিল্পে কাঁচামালের প্রধান উৎস চীন। করোনাভাইরাসের কারণে আমাদের অর্থনীতির ম্যানুফ্যাকচারিং ভ্যালু চেইনের ৮০ শতাংশের মতো প্রায় এক মাস স্থগিত ছিল। এ সময়ে খুব সামান্য পরিমাণ শিপমেন্ট হয়েছে। এ কারণে পোশাক খাত, প্লাস্টিক, চামড়া, ইলেকট্রনিক, মেডিক্যাল ইনস্ট্রুমেন্ট, কম্পিউটার, যোগাযোগসহ সব খাতে স্বাভাবিক সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। চলতি বছর জানুয়ারি মাসে ৬.৭২ লাখ টন পণ্য এসেছে অথচ ২০১৯ সালের একই সময় এর পরিমাণ ছিল ৮.৫১ লাখ টন, ২০১৮ সালে ছিল ৮.৮২ লাখ টন। দেশের পোশাক রফতানি আয়ের ৬০ শতাংশ আসে ইউরোগীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) ২৮টি থেকে। স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে এসব দেশে বাংলাদেশের পণ্য রফতানিতে শুল্ক দিতে হয় না। গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরের ১১ মাসে (জুলাই-মে) বাংলাদেশ থেকে ইউরোপে পোশাক রফতানি হয়েছে ১৯ দশমিক ৬৩ বিলিয়ন ডলার। আর ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ইউরোপে রফতানি হয়েছে ২১ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য। এ বিষয়ে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইএর সাবেক সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, ‘করোনাভাইরাসের কারণে প্রায় এক মাসের মতো আমদানি-রফতানিতে বিঘœ ঘটায় ব্যাংকিং খাতে পেমেন্ট ওভারডিও হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। সঙ্কট মোকাবেলায় ঋণপত্র সহায়তা ও ঋণপত্রের মূল্য পরিশোধের বিষয়ে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। কোন প্রতিষ্ঠান ব্যাংকে কাগজপত্র সরবরাহ করলে তাদের এ্যাকাউন্ট যাতে ক্লাসিফাইড না হয় এজন্য এডিশনাল চার্জ, ইন্টারেস্ট পেনালাইজড না হয় এজন্য বিশেষ নজর দেয়া প্রয়োজন।’ বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি ও এফবিসিসিআইএর সহ-সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘করোনাভাইরাসের কারণে শুধু বাংলাদেশ নয় বিশ্ববাজারে বড় ধাক্কা লেগেছে। তবে আমাদের ক্ষতি কী পরিমাণ হয়েছে তা এখনই বলা যাচ্ছে না। এক মাসের সাপ্লাই চেইন ডিসরাপশনের কারণে সরকারের সহায়তা, ব্যাংকিং সুবিধাসহ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয় এবং অন্যান্য স্টেকহোল্ডারদের সহায়তা স্বল্প মেয়াদে এ সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারবে।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের শঙ্কা এখন চীন নয়। কারণ দেশটি থেকে এখন পরিমাণে সামান্য হলেও কাঁচামাল আসতে শুরু করেছে। চীনের গ-ি পেরিয়ে করোনা আঘাত হানতে শুরু করেছে ইউরোপসহ ৫৩টি দেশে। ইউরোপে করোনাভাইরাস ব্যাপক আকার ধারণ করে তবে টিকে থাকাই অসম্ভব হয়ে পড়বে। তবে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ কত হবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না। এর প্রভাব সব দেশেই লেগেছে, আমাদের আরও অপেক্ষা করতে হবে।’
×