ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

করোনায় সঙ্কুচিত হয়ে আসছে শিল্প উৎপাদন

প্রকাশিত: ১২:১৩, ৩ মার্চ ২০২০

করোনায় সঙ্কুচিত হয়ে আসছে শিল্প উৎপাদন

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ চীন থেকে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাসে বাংলাদেশর উৎপাদন খাত মারাত্মক হুমকির মুখে। চীন থেকে আমদানি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দেশের প্রধান ১০টি উৎপাদন খাতে মারাত্মক আকার ধারণ করতে যাচ্ছে। বিশেষ করে কাঁচামাল সঙ্কটে এসব শিল্প খাতে উৎপাদন সঙ্কুচিত হয়ে আসছে। আমদানিকৃত মজুদ ফুরিয়ে যাওয়ায় হু হু করে বেড়ে যাচ্ছে পণ্যের দাম। পরিস্থিতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণে না এলে কোন কোন খাতে উৎপাদন নেমে আসবে শূন্যের কোটায়। সবচেয়ে হুমকির মুখে রয়েছে দেশের প্রধান রফতানি খাত পোশাক শিল্প। এ খাতের ক্ষয়-ক্ষতি নিরুপণের কাজ চললেও, চামড়া শিল্পে এ ক্ষতি ৩ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ট্রেড এ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের এক প্রতিবেদনে এমন চিত্র উঠে এসেছে। গত ২০ ফেব্রুয়ারি প্রতিবেদনটি বাণিজ্য সচিবের কাছে পাঠিয়েছে ট্রেড এ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন। এ প্রতিবেদনে বেশকিছু খাতে সম্ভাব্য ক্ষতির পরিমাণ তুলে ধরা হয়েছে। আবার কিছু কিছু খাতে ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করা হচ্ছে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, চীনে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাস বিশ্ব বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। উন্নত, উন্নয়নশীল ও অনুন্নত- সব দেশের বাণিজ্যে এর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব পড়েছে। বাংলাদেশে আমদানি করা প্রাথমিক কাঁচামাল, মধ্যবর্তী কাঁচামাল ও সম্পূর্ণায়িত পণ্যের সিংহভাগ চীন থেকে আমদানি করা হয়। করোনাভাইরাসের ফলে চীনের স্থানীয় উৎপাদন থেকে শুরু করে রফতানি বাণিজ্যে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। এর প্রভাব বাংলাদেশের বাণিজ্যে ইতোমধ্যে পড়তে শুরু করেছে। কমিশন বলছে, দেশের বাণিজ্যে করোনাভাইরাসের প্রভাব নিয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রণয়নের কাজ তারা করছে। এর আগেই বাংলাদেশের যেসব খাতে করোনার সম্ভাব্য প্রভাব রয়েছে তা বাংলাদেশ ট্রেড এ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন কর্তৃক পর্যালোচনা করে সাময়িক প্রতিবেদনটি প্রণয়ন করা হয়েছে। প্রতিবেদনে করোনাভাইরাসের সম্ভাব্য প্রভাবের খাতভিত্তিক পর্যালোচনা করা হয়। এতে সম্ভাব্য ক্ষতির পরিমাণও উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার ও লেদার গুডস শিল্প মোট যে পরিমাণ রফতানি করে তার মধ্যে ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ রফতানি হয় চীনে। করোনাভাইরাসের প্রভাবে এ খাতে সম্ভাব্য ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা। গার্মেন্টস এ্যাক্সেসরিজ এ্যান্ড প্যাকেজিং খাতে বার্ষিক চার বিলিয়ন ডলারের কাঁচামাল দরকার হয়। যার ৪০ শতাংশ চীন থেকে আসে। কাঁচামালের প্রাপ্তি বিঘিœত বা সঙ্কুচিত হবে বা হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়ায় এ শিল্প সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের মতে, প্রায় এক হাজার ৪০০ থেকে এক হাজার ৫০০ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। চীন থেকে কসমেটিক্স এ্যান্ড টয়লেট্রিস খাতে প্রতি মাসে আমদানির পরিমাণ ২০০ কন্টেনারেরও বেশি। যার মূল্য প্রায় ৭৫ কোটি টাকা। বর্তমানে চীন থেকে এসব পণ্য আমদানি ও জাহাজীকরণ বন্ধ আছে। ওভেন খাতের প্রায় ৬০ শতাংশ ফেব্রিক্স চীন থেকে আমদানি হয়। করোনাভাইরাসের প্রভাবে এ শিল্পে নেতিবাচক প্রভাব ইতোমধ্যে পড়তে শুরু করেছে। এ খাতে ক্ষতির পরিমাণ সবচেয়ে বেশি হবে। তবে এখনও সেটি নিরূপণ সম্ভব হয়নি। ক্ষতি নিরূপণের কাজ চলমান। নিট খাতের ১৫ থেকে ২০ শতাংশ কাঁচামাল চীন থেকে আমদানি হয়। এছাড়া নিট ও ডাইং কেমিক্যাল এবং এ্যাক্সেসরিজের ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ আমদানি হয় চীন থেকে। এ খাতেরও ক্ষতি নিরূপণের বিষয়টি চলমান। প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ২৫ জানুয়ারি থেকে চীনে কাঁকড়া ও কুচে রফতানি বন্ধ রয়েছে। বাংলাদেশের ৯০ শতাংশ কাঁকড়া ও কুচে চীনে রফতানি হয়। স্থানীয় বাজারে এসব পণ্যের কোন চাহিদা নেই। তাই পণ্যগুলো রফতানি করতে না পারায় গত এক মাসে প্রায় ২০০ কোটি টাকার জীবন্ত কাঁকড়া ও কুচে মারা গেছে। মজুদ করা পণ্য রফতানি করতে না পারলে ক্ষতির পরিমাণ ৩৫০ থেকে ৪০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। প্রতিবেদনে বলা হয়, কাঁচামাল ও মেশিনারিজসহ বিভিন্ন মেশিনের স্পেয়ার পার্টস যেমন- ইনজেকশন মোল্ডিং, প্রিন্টিং, এক্সটরশন মেশিনের পার্টস চীন থেকে আনতে হয়। এসব পণ্যের সরবরাহ বন্ধ হওয়ার কারণে সম্পূর্ণ সেক্টর হুমকির সম্মুখীন। বাংলাদেশে আমদানি করা মেশিনারি ও স্পেয়ার পার্টসের শতকরা ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ চীন থেকে আসে। আমদানি ও জাহাজীকরণ বর্তমানে বন্ধ আছে। এ খাতের আর্থিক ক্ষতি নিরূপণের কার্যক্রম কমিশনে চলমান। জুট স্পিনার্স পণ্য চীনে রফতানির পরিমাণ বছরে আনুমানিক ৮১ হাজার মেট্রিক টন। যার মূল্য প্রায় ৫৩২ কোটি টাকা। চীনে রফতানি ও জাহাজীকরণ বর্তমানে বন্ধ আছে। এ খাতের আর্থিক ক্ষতি নিরূপণের কার্যক্রমও চলমান। বছরে প্রায় ১৮০ কোটি ডলারের মুদ্রণশিল্পের কাঁচামাল চীন থেকে আমদানি হয়। বর্তমানে আমদানি ও জাহাজীকরণ বন্ধ আছে। এ খাতে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ৩৬০ কোটি ডলার। মেডিক্যাল ইন্সট্রুমেন্ট এ্যান্ড হসপিটাল ইকুইপমেন্ট চীন থেকে বার্ষিক প্রায় ২৫ কন্টেনার আমদানি করতে হয়। বর্তমানে আমদানি ও জাহাজীকরণ বন্ধ আছে। এ খাতের আর্থিক ক্ষতি নিরূপণের কার্যক্রম চলমান। চশমা শিল্পের কাঁচামাল মোট আমদানির (তৈরি পণ্য ও যন্ত্রাংশ) আনুমানিক ৯৫ শতাংশ চীন থেকে আসে। বর্তমানে চীন থেকে আমদানি ও জাহাজীকরণ বন্ধ আছে। এ খাতের আর্থিক ক্ষতি নিরূপণের কার্যক্রমও কমিশনে চলমান। কম্পিউটার খাত অনেকটাই চীনের ওপর নির্ভরশীল। ইতোমধ্যে কাঁচামাল, যন্ত্রাংশ, এ্যাক্সেসরিজ ইত্যাদির দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। সরবরাহ স্বাভাবিক না হলে চাহিদা যথাযথভাবে পূরণ করা সম্ভব হবে না। টিভি, ফ্রিজ, মোবাইল ফোন, ওভেন, চার্জারসহ ইলেকট্রনিক্স পণ্যের ৮০ ভাগই আসে চীন থেকে। শিপমেন্ট বন্ধ থাকায় স্থানীয় বাজারে পণ্যের সঙ্কট দেখা দিতে শুরু করেছে। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বাণিজ্য সচিব ড. মোঃ জাফর উদ্দীন বলেন, করোনাভাইরাসের প্রভাবে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে যে ক্ষতি হচ্ছে সেগুলো কাটিয়ে উঠতে ব্যবসায়ীসহ সকল স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে কাজ করছে সরকার। এফবিসিসিআই সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। তাই বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ীদের বিশেষ নীতি সহায়তা, ঋণ সহায়তা চাওয়া হয়েছে। সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালকে এ বিষয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, আমদানি দায় পরিশোধে দেরির কারণে কাউকে খেলাপী হিসেবে চিহ্নিত না করারও সুপারিশ করা হয়েছে।
×