ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

দিলু রোড অগ্নিকাণ্ড, পরিবারের কেউ রইল না!

রুশদীর মায়ের পর চলে গেলেন বাবাও

প্রকাশিত: ১১:১৫, ৩ মার্চ ২০২০

রুশদীর মায়ের পর চলে গেলেন বাবাও

নিয়াজ আহমেদ লাবু ॥ একমাত্র শিশু সন্তান রুশদীর পর পিতা-মাতাও চলে গেছেন না ফেরার দেশে। রাজধানীর নিউ ইস্কাটনের দিলু রোডে নিচতলায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে পুরো পরিবারের কেউ বেঁচে নেই। ঘটনার দিন বৃহস্পতিবার ভোরে চার বছরের শিশু রুশদী না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছিল। তার পথ ধরে রবিবার মা জান্নাতুল ফেরদৌস জান্নাত (৩৮) চলে গেছেন। আর পাঁচ দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে সোমবার চলে গেলেন বাবা শহীদুল কিরমানী রনিও (৪৫)। ভোরে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন এ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। এ নিয়ে এই অগ্নিকা-ের ঘটনায় ৫ জনের মৃত্যু হলো। ইনস্টিটিউটের সমন্বয়ক ডাঃ সামন্ত লাল সেন জানান, সোমবার ভোরে ইনস্টিটিউটের নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শহীদুল কিরমানী রনির মৃত্যু হয়। তার শরীরের ৪৩ শতাংশ দগ্ধ হয়েছিল। শ্বাসনালী পুড়ে গিয়েছিল। আর রনির মৃত্যুর মধ্য দিয়ে শিশু রুশদীর ছোট সংসারের আর কেউ বেঁচে রইলেন না। নিহত রনির গ্রামের বাড়ি নরসিংদী জেলার শিবপুর উপজেলার ইটনা গ্রামের। তার বাবার নাম একে এম শহীদুল্লাহ। তিনি রনি হাতিরঝিল পুলিশ প্লাজায় ভিআইভিপি এস্টেট ম্যানেজমেন্ট নামে একটি কোম্পানির ফাইন্যান্স ম্যানেজার ছিলেন। পাশাপাশি আইসিএমএ নামের একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রভাষক হিসেবেও কাজ করতেন। আর তার স্ত্রী নিহত জান্নাতুল ফেরদৌস জানান, বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যাল লিমিটেডের হিসাবরক্ষক ছিলেন। এছাড়া তিনি একজন অনলাইন উদ্যোক্তা ছিলেন। রুশদী’স ক্লজেট নামে একটি অনলাইন পেইজের মাধ্যমে বাংলাদেশী শাড়ি বিক্রি করতেন তিনি। এদিকে সোমবার দুপুরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গের সামনে নিহত রনির ফুফাত ভাই নাকিব হাসান জানান, হাসপাতালে আইনী প্রক্রিয়া শেষে ভাই রনির মরদেহ কর্মস্থলে জানাজা শেষে নরসিংদীতে নিয়ে যাওয়া হবে। সেখানে পারিবারিক কবরস্থানে তার আদরের একমাত্র শিশু সন্তান রুশদী, স্ত্রী জান্নাতের কবরের পাশেই তাকে দাফন করা হবে। এ সময় রনির ফুফাত ভাই নাকিব জানান, ছেলে রুশদীর মৃত্যুর খবর শুনে নিজেও বাঁচার আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন রনি। এরপরই পরিবারকে জানিয়ে দেন পারিবারিক কবরস্থানে একসঙ্গে সবাইকে কবর দিতে। নাকিব হাসান জানান, বাবা রনি ও মা জান্নাতকে যখন ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন ইউনিটে নিয়ে আসা হয় তখনই রনি পরিবারের কাছ থেকে জানতে পারেন তার একমাত্র আদরের ছেলে রুশদী বেঁচে নাই। এই কথা বলার পর পোড়া শরীরের কষ্ট ও যন্ত্রণায় রনি চোখের টল টল করে পানি পড়ছিল। বার বার দীর্ঘশ্বাস দিচ্ছিল রনি। অস্পষ্ট স্বরে বার বার বলছিল, আমার বেঁচে থেকে লাভ নেই। নিজের বাঁচার আশাও ছেড়ে দিয়েছিলেন রনি। আর তিনি বলেছিলেন, পারিবারিক কবরস্থানে সবাইকে পাশাপাশি দাফন করতে। এরপর আর কথা বলতে পারেনি রনি। নাকিব জানান, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার দিন বৃহস্পতিবার বিকেল থেকেই লাইফ সাপোর্টে নেয়া হয় রুশদীর বাবা রনি ও মা জান্নাতকে। কিছুটা চেতনা দেখা দিলে তিনি বার বার রুশদীকে নিয়ে কথা বলছিলেন। তাদের আদরের ধন ছিল রুশদী। তার মা জান্নাতের ফেসবুক খুললেই দেখা যায়। তাদের তিনজনের মধ্যে আল্লাহ এতই মিল দিয়েছিলেন যে একসঙ্গেই নিয়ে গেলেন। আশা করি আল্লাহ তিনজনকে একসঙ্গেই রাখবেন। তিনি জানান, ঘটনার দিন জীবন্ত দগ্ধ হয় তাদের একমাত্র সন্তান রুশদী। এরপর রবিবার তার মা জান্নাতের মৃত্যু হয়। মায়ের কথামতেই ছেলে রুশদীর কবরের পাশে তাকে দাফন করা হবে। বাবা শহীদুল কিরমানী রনিরও দাফনও হবে স্ত্রী সন্তানের পাশেই। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানান, গত বৃহস্পতিবার দিলু রোডের ৪৫/এ নম্বর পাঁচতলা বাড়ির নিচতলার গ্যারেজ থেকে প্রথমে আগুন লাগে। এতে ঘটনার দিন নিহত রনি ও জান্নাতুল দম্পতির চার বছরের সন্তান রুশদী জীবন্ত দগ্ধ হয়েছে। একই অবস্থা হয়েছিল এইচএসসি পরীক্ষার্থী আফরিন জাহান যুথী (১৭) ও আব্দুল কাদের লিটন (৪০)। ওই দিনই শিশু রুশদী ও কিশোরী যুথীর অঙ্গার হওয়া লাশ ওই পাঁচতলা ভবনের তৃতীয় তলার সিঁড়িতে পড়েছিল। একই অগ্নিকাণ্ডে ধোঁয়ায় অসুস্থ হয়েছে ওই বাড়ির আরও চারজন বাসিন্দা। তারা হচ্ছেন, কাঁচামাল ব্যবসায়ী মনির হোসেন (৪০), তার স্ত্রী সুমাইয়া আক্তার (৩০), ছেলে মাহমুদুল হাসান (৯ মাস) ও মাহাদি হাসান রিফাত (৯)। স্থানীয়রা জানান, বাড়িটির তৃতীয় তলায় জান্নাতুল ফেরদৌস ও তার স্বামী রনি, ছেলে নিয়ে ভাড়া থাকতেন। আর নিহত আফরিন জাহান যুথী পাঁচতলায় বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকতেন এবং আব্দুল কাদের লিটন থাকতেন ভবনের নিচতলায় একটি কক্ষে। তিনি ওই ভবনের দ্বিতীয় তলার ক্লাসিক ফ্যাশন ইন্টারন্যাশনাল নামের একটি বায়িং অফিস সহকারী হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ঘটনার দিন নিহত যুথীর চাচা মোঃ সুরুজ্জামান জানান, আগুন লেগেছে সে আতঙ্কে দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামছিল যুথী। আর ওপর থেকে বাবা, ভাই গ্রিল বেয়ে বাইরে দিয়ে নামেন। তারা দু’জনেই সামান্য আহত হন। মাও নামার সময় পড়ে গিয়ে গুরুতর আহত হন। তার পা ও কোমরের হাড় ভেঙ্গে যায়। তাকে পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
×