ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

গড়ে উঠবে উন্নত টার্মিনাল ও নৌ পর্যটন সুবিধা

পাটুরিয়া দৌলতদিয়া ও গোয়ালন্দ ঘাটের অবকাঠামো বদলে যাচ্ছে

প্রকাশিত: ১১:১৪, ৩ মার্চ ২০২০

পাটুরিয়া দৌলতদিয়া ও গোয়ালন্দ ঘাটের অবকাঠামো বদলে যাচ্ছে

ওয়াজেদ হীরা ॥ রাজধানী ঢাকা থেকে পদ্মা নদী পার হয়ে সারাদেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোয় যাতায়াতের জন্য মূলত পাটুরিয়া, দৌলতদিয়া ও গোয়ালন্দ ফেরিঘাট ব্যবহার করা হয়। নানা কারণে ফেরি বন্ধ থাকলেই যাত্রী সাধারণের ভোগান্তি চরমে উঠে। এখানে নেই অপেক্ষমাণ যাত্রীদের বিশ্রামের তেমন ব্যবস্থা। আবার যাত্রী হয়রানির অভিযোগও রয়েছে। ঘাটে আগমন-নির্গমন এবং ফেরি পারাপারের লক্ষ্যে আগত যাত্রী ও পরিবহনগুলোর জন্য নেই উন্নত টার্মিনাল। এসব সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে উন্নত যাত্রীসেবা নিশ্চিত করতে উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। আর উদ্যোগের কারণে এই পথে চলাচলরত ২১ জেলার মানুষ পাবে স্বস্তি। কমবে যাত্রী হয়রানিও। জানা গেছে, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার সড়ক যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে এই ঘাট ব্যবহার করা হয়। খুলনা বিভাগের খুলনা, বাগেরহাট, যশোর, সাতক্ষীরা, নড়াইল, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ ও মাগুরা। বরিশাল বিভাগের বরিশাল, পিরোজপুর, ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা ও ঝালকাঠি এবং ঢাকা বিভাগের গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর ও রাজবাড়ি জেলার মানুষ প্রতিনিয়তই সড়ক পথে এই পথ ব্যবহার করে চলাচল করতে গিয়ে নানা ধরনের ভোগান্তিতেও পড়ছেন। কখনও ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফেরির জন্য অপেক্ষাও করতে হচ্ছে মানুষকে। সীমিত পরিসরে বসার ব্যবস্থাও উন্নত না হওয়ায় এদিক সেদিক হাঁটাহাঁটি করে সময় পার করেন যাত্রীরা। উন্নত টার্মিনালের অভাবে নানা হয়রানিও হয় ঘাট এলাকায়। একই সঙ্গে ভারতের কলকাতায় যোগাযোগের জন্য সড়ক পথ এটি। নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, রাজধানী ঢাকাসহ সমগ্র দেশের সঙ্গে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল এবং পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের যাওয়ার জন্য সড়ক পথ হিসেবে মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া ফেরিঘাট সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ঢাকার সঙ্গে সড়ক পথে সমগ্র দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল এবং আন্তর্জাতিক সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের মাধ্যমে যাত্রীসেবা বৃদ্ধি, ঘাটে নৌ যানসমূহের আগমন-নির্গমন ও ফেরি পারাপারে অপেক্ষমাণ যাত্রী পরিবহনের উন্নত টার্মিনাল, পার্কিং সুবিধা, নৌকেন্দ্রিক পর্যটন সুবিধা সৃষ্টির মাধ্যমে আর্থসামাজিক উন্নয়নকে উদ্দেশ্য করে এক হাজার ৩৫১ কোটি ৭০ লাখ টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয়েছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে জনগণের সেবা নিশ্চিত করতে ‘পাটুরিয়া এবং দৌলতদিয়ায় আনুষঙ্গিক সুবিধাদিসহ নদীবন্দর আধুনিকায়ন’ শীর্ষক প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। যা সম্প্রতি একনেক চেয়ারপার্সন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুমোদনও দেয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান জানিয়েছেন, আমাদের ওইসব অঞ্চলের মানুষ সড়ক পথে যাতায়াতের সময় ফেরিতেও যাতায়াত করতে হয়। দীর্ঘদিন ধরে অনেক সমস্যা আছে। একটু অপেক্ষা করতে হলে যাত্রীদের বসার জন্য একটা ভাল ব্যবস্থা হবে। এছাড়াও যারা ভারতের কলকাতায় যায় এই সড়ক পথে তাদেরও সুবিধা বাড়বে। এক কথায় আমাদের নাগরিক সুবিধা বাড়াতে, ওই অঞ্চলের মানুষ যারা সবসময় এই পথগুলো ব্যবহার করে তারা অনেক উপকৃত হবে। আমাদের উন্নয়ন কাউকে পেছনে ফেলে নয় সবাইকে নিয়ে আমরা এগিয়ে যাব। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছেন, এক সময় দেশের উত্তর এবং উত্তর পশ্চিমাঞ্চলে উৎপন্নদ্রব্য ও যাত্রী সাধারণের ঢাকায় পরিবহনের জন্য আনুমানিক ১৯৪০-১৯৪৫ সালের দিকে আরিচার ফেরিঘাট প্রতিষ্ঠিত হয়। পাশাপাশি দক্ষিণ এবং দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের সড়ক পথে যোগাযোগের জন্য এ ঘাটটি ব্যবহৃত হতো। ২০০১-২০০২ সালে আরিচা এলাকায় নদীতে প্রচুর পলি পড়ায় এবং পানির গভীরতা কমে যায় এটি পাটুরিয়াতে স্থানান্তরিত হয়। বর্তমানে পাটুরিয়াতে ৪টি ফেরিঘাট, ১টি লঞ্চঘাট, ৩টি টার্মিনাল, ১৯টি ফেরি এবং ৬০-৯০টি লঞ্চ রয়েছে। নদীর অপর পাশে দৌলতদিয়া ঘাট। অনেক আগে ঘাটটি রাজবাড়ি জেলার গোয়ালন্দে অবস্থিত ছিল। ওই এলাকায় প্রচুর পলি পড়ায় ঘাটটি দৌলতদিয়া স্থানান্তরিত হয়েছে। পদ্মা নদী দিয়ে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে সড়ক পথে যোগাযোগ এখনও ফেরির ওপর নির্ভরশীল। তাই ঘাট এলাকায় আধুনিক অবকাঠামো ও উন্নত বন্দর সুবিধার কথা বলছেন সংশ্লিষ্টরা। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী মনে করছেন, দীর্ঘদিনের একটি সমস্যার সমাধান হতে যাচ্ছে এই প্রকল্পের মাধ্যমে। তিনি জানান, আমরা এই প্রকল্পের মাধ্যমে তিনটি ঘাটে আসা যাওয়া করা যাত্রীদের উন্নত সেবা নিশ্চিত করতে পারব। অনেক সময়ই নদী পার হতে যাত্রী ও চালকদের দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়। কিন্ত এখানে উন্নত আধুনিক সুবিধাসম্বলিত কোন টার্মিনাল নাই। প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে আধুনিক টার্মিনালে যাত্রী ও চালকরা বিশ্রাম নিতে পারবেন। এতে ফেরিঘাটের নানা ধরনের যাত্রী হয়রানি কমবে বলে আশা করছি। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষকে (বিআইডব্লিউটিএ)। মানিকগঞ্জের শিবালয়, রাজবাড়ি জেলার গোয়ালন্দ উপজেলার পাটুরিয়া, দৌলতদিয়া ও গোয়ালন্দ এলাকায় এর আনুষঙ্গিক কাজ অনুষ্ঠিত হবে। চলতি বছরের মার্চ মাস থেকে ফেব্রুয়ারি ২০২৩ সালের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে বলেও জানা গেছে। পরিকল্পনা কমিশনের প্রকল্প প্রস্তাবনায় জানা গেছে, প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ওই এলাকার বিভিন্ন দাগে মোট ৬৫ একর জমি অধিগ্রহণ করা হবে। এসব জমিতে আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসহ বহুতল টার্মিনাল ভবন এবং অন্য স্থাপনাদি নির্মাণ করা হবে, যার আয়তন হবে ১২ হাজার ২ বর্গমিটার। এজন্য উল্লেখিত জমিতে ৪৫ লাখ ঘনমিটার ড্রেজিং করা হবে। পাটুরিয়া এবং দৌলতদিয়া এলাকায় আট হাজার মিটার নদী শাসন করা হবে। ভূমি উন্নয়ন করা হবে ৫ দশমিক ৮০ লাখ ঘনমিটার। নতুন করে ফেরিঘাট নির্মাণ এবং প্রকল্প চলাকালীন পরিচালনার জন্য সমন্বয় সাধনের জন্য অবকাঠামো নির্মাণ করা হবে, যার আয়তন হবে ৩৩ হাজার ৭৯২ বর্গমিটার। পার্কিং ইয়ার্ডের আয়তন হবে ১ লাখ ৫৯ হাজার ১১০ বর্গমিটার। এছাড়াও প্রকল্প এলাকায় ড্রেনেজ ব্যবস্থা, সীমানা প্রাচীর ও ফেন্সিং কাজ, স্টিল জেটি নির্মাণ, পাটুরিয়া এবং দৌলতদিয়া এলাকায় মোট ২২টি পন্টুন স্থাপন, আরসিসি রোড নির্মাণ, ৩২টি স্টিল স্পাড এর কাজ সম্পন্ন করা হবে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্রে আরও জানা গেছে, প্রকল্প মোট ব্যয় ১ হাজার ৩৫১ কোটি ৭০ লাখ টাকা। যার পুরোটাই সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে জোগান দেয়া হচ্ছে। প্রকল্পটি চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীতে বরাদ্দবিহীন অননুমোদিত নতুন প্রকল্প হিসেবে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। কমিশনের একাধিক কর্মকর্তা জানান, আমাদের ওই অঞ্চলের বিভিন্ন জেলার মানুষ চলাচলের ক্ষেত্রে সুবিধা পাবে। এছাড়াও সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় নদী বন্দরগুলোয় বিভিন্ন সুযোগ সুবিধাদি বাড়ানোর বিষয়কে সরকার অগ্রাধিকার দিয়েছে, যার সঙ্গে প্রকল্পটির উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সঙ্গতিপূর্ণ। পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য শামীমা নার্গিস কমিশনের সুপারিশ দিতে গিয়ে বলেছন, পাটুরিয়া, দৌলতদিয়া ও গোয়ালন্দ ঘাটে নৌযানগুলোর আসা যাওয়া ও ফেরি পারাপারের জন্য সেখানে অপেক্ষমাণ যাত্রী এবং পরিবহনের জন্য উন্নত টার্মিনাল ও পার্কিং সুবিধা সৃষ্টি হবে। একই সঙ্গে ঢাকার সঙ্গে সড়ক পথে সমগ্র দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ও ভারতের কলকাতার সঙ্গে আন্তর্জাতিক সড়ক যোগাযোগ উন্নয়নের মাধ্যমে যাত্রী সেবা বৃদ্ধি পাবে।
×