ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ধুলার রাজত্বে কোথাও শান্তি নেই, বাড়ছে নানা রোগ

প্রকাশিত: ১১:০০, ২ মার্চ ২০২০

  ধুলার রাজত্বে কোথাও শান্তি নেই, বাড়ছে নানা রোগ

রাজন ভট্টাচার্য ॥ নাগরিক জীবনে বর্তমানে সবচেয়ে বড় সমস্যার একটি হলো বায়ু দূষণ অর্থাৎ ধুলো। রাজধানীতে এমন কোন সড়ক পাওয়া যাবে না যেখানে ধুলো নেই। যেখানে রয়েছে স্বাভাবিক বাতাস। এক কথায় যদি বলা যায় এখন পুরোপুরি ধুলোর নগরীতে রূপ নিয়েছে ঐতিহ্যের এই রাজধানী। আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের জরিপে মাসে অন্তত ২০ দিনের বেশি বিশ্বে দূষিত নগরীর তালিকায় ঢাকার অবস্থান থাকে শীর্ষে। এরপরও বলার কোন অবকাশ নেই শহরের অবস্থা কি। নগরবীদরা বলছেন, ধুলো দূষণের দিক থেকে সর্বকালের রেকর্ড অতিক্রম করেছে সাম্প্রতিক সময়। বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প, যখন তখন সেবা সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে ইচ্ছেমতো সড়ক খোঁড়াখুঁড়ি, নাগরিক সচেতনতার অভাব, নগরীর আশপাশে ইটভাঁটি, রাস্তার বালু-ইটসহ নির্মাণ সামগ্রী রাখাই দূষণের বড় কারণ। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে যথাযথভাবে রাস্তাঘাট পরিচ্ছন্ন না করা। রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক ঘুরলে দেখা যায়, শতকরা ৪০ ভাগের বেশি মানুষ এখন মাস্ক ব্যবহার করেন। ব্যবসায়ীরা বলছেন, গত কয়েক দশকে এবার মাস্কের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। সাধারণত শুষ্ক মৌসুমে ধুলোর উৎপাত বাড়ে। এবারও ব্যতিক্রম হয়নি। তবে মাত্রার দিক থেকে বেশি এবারের মৌসুমে। তাই প্রতিরোধের ব্যবস্থাও চোখে পড়ার মতো। উন্নতমানের মাস্ক বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা হয়। বাজারে এখন রীতিমতো এর সঙ্কট রয়েছে। যেসব দেশের প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে মাস্ক সরবরাহ করে তারা কমপক্ষে এক থেকে দুই লাখের কম অর্ডার নিচ্ছে না। ফলে ছোট ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো ইচ্ছা করলেই এই পণ্য আমদানি করতে ব্যর্থ হচ্ছে। বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো নতুন করে মাস্ক আমদানিতে নেমেছে। তবুও বাজারে সঙ্কট! রাজধানীর ৭০টি স্থানের বায়ু পর্যবেক্ষণ করে বায়ুমন্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)-এর এক গবেষণায় বলা হয়েছে, গত ১৩ মাসে ঢাকার মানুষ মাত্র ৯ দিন (২ শতাংশ) সময় ভাল বায়ু সেবন করেছে এবং ১৮৮ দিন (৪৮ শতাংশ) মধ্যম থেকে সতর্কতামূলক দূষিত বায়ু সেবন করেছে। এছাড়া ১০৭ দিন (২৮ শতাংশ) অস্বাস্থ্যকর বায়ু, ৮২ দিন (২১ শতাংশ) খুবই অস্বাস্থ্যকর বায়ু এবং ৫ দিন (১ শতাংশ) মারাত্মক অস্বাস্থ্যকর বায়ু সেবন করেছে। ক্যাপস বলছে, ঢাকা শহরের মধ্যে এলাকাভেদে দূষণের কম বেশি আছে। ঢাকার সবচেয়ে দূষিত এলাকা এখন পুরান ঢাকার লালবাগ এলাকা। দ্বিতীয় অবস্থানে আছে ফার্মগেট। এরপরেই যথাক্রমে দূষণের শীর্ষ সারিতে রয়েছে পুরান ঢাকার ইংলিশ রোড, সেগুনবাগিচা, ধানমন্ডির শংকর, নয়াপল্টন ও হাজারীবাগ এলাকা। তুলনামূলকভাবে বায়ুর মান ভাল পাওয়া গেছে মানিকদী ও গুলশান এলাকায়। ঢাকার দূষণের ইটভাঁটি ৫৮ শতাংশ, সড়কের ধুলো ১৮ শতাংশ, যানবাহনের ধোঁয়া ১০ শতাংশ, বায়োগ্যাস পোড়ানো ৮ শতাংশ এবং অন্যান্য কারণ ৬ শতাংশ দায়ী বলেও জানিয়েছে ক্যাপস। ২০১৯ সালে বায়ু দূষণের পরিমাণ ২০১৮ সাল থেকে গড়ে প্রায় ২০ ভাগ বেড়েছে। ফলে শিশু মৃত্যুর হারে বাংলাদেশ বিশ্বে দ্বিতীয় অবস্থানে পৌঁছে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা হেলথ এ্যাফেক্টস ইনস্টিটিউটের একটি গবেষণাপত্রের উদাহরণ দিয়ে পরিবেশ আন্দোলনের নেতা আবু নাসের খান বলেন, বায়ু দূষণের কারণে বাংলাদেশে বছরে এক লাখ ২২ হাজার ৪০০ মানুষ মারা যান। একই সংখ্যক মানুষকে সারাবছর ধরে ভুগতে হয় ফুসফুসসহ শ্বাসতন্ত্রের বিভিন্ন জটিল রোগে। উচ্চমাত্রার বায়ু দূষণের কারণে শারীরিকভাবে বিকলাঙ্গ, বুদ্ধিমত্তাবিহীন বা নির্বোধ শিশুর সংখ্যাও বেড়ে গেছে। হেলথ এ্যাফেক্টস ইনস্টিটিউটের গবেষণা থেকে জানা যায়, ২০১৩-১৮ পর্যন্ত সময়ে ঢাকার বায়ু সবসময় আদর্শ বায়ুমান এর চেয়ে চার থেকে ছয়গুণ বেশি খারাপ ছিল। স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের এক গবেষণায় দেখা গেছে, গত ৬ বছরে (২০১৩-১৮) বায়ু দূষকগুলোর মধ্যে বিশেষ করে অতি ক্ষুদ্র বস্তুকণার পরিমাণ তুলনামূলক বেড়ে চলেছে। এ সময়ের শীতকালে বায়ু দূষণের মাত্রা জাতীয় আদর্শ বায়ুমানের ১১ দশমিক ৮০ গুণ বেশি ছিল এবং বর্ষাকালে আদর্শ বায়ুমানের প্রায় ২ গুণ বেশি। গত শনিবার এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সে (একিউআই) ঢাকার স্কোর ছিল ২১৫। মানে বাতাসের মান ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর’। একিউআই মান ২০১ থেকে ৩০০ হলে স্বাস্থ্য সতর্কতাসহ তা জরুরী অবস্থা হিসেবে বিবেচিত হয়। এ অবস্থায় শিশু, প্রবীণ এবং অসুস্থ রোগীদের বাড়ির ভেতরে এবং অন্যদের বাড়ির বাইরের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রাখার পরামর্শ দেয়া হয়ে থাকে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (উন্নয়ন ও পরিকল্পনা) অধ্যাপক ডাঃ সানিয়া তহমিনা বলেন, করোনাভাইরাসের সংক্রামণ হওয়ার পর বিশ্বজুড়ে মাস্কের সঙ্কট দেখা দেয়। দেশে চড়া দামে মাস্ক বিক্রি হচ্ছে। তবে আমাদের অনেকেই নিয়ম মেনে ব্যবহার করছেন না। কথা বলার সময় মাস্ক গলায় নামিয়ে আবারও তা লাগানো হচ্ছে, এতে কোন কাজে আসবে না, বিপদ ডেকে আনে। রাজধানীর ফুসফুস হিসেবে পরিচিত রমনা ও হাতিরঝিল। শনিবার রমনা পার্ক এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে রাস্তার চেয়ে পার্কের ভেতর বায়ু দূষণের মাত্রা কম। তবে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। এর বড় প্রমাণ হলো, পার্কের গাছের পাতা থেকে শুরু করে মাটিতে মিশে থাকা খাস ধুলোয় ধূসর হয়ে গেছে। পার্কের দায়িত্বশীলরা বলছেন, যতদিন যাচ্ছে দূষণের মাত্রা বাড়ছে মনে হয়। বাতাসে ধুলো আসে বেশি। ভারি হচ্ছে উদ্যানের নির্মল বাতাস। তাই গাছপালা বিবর্ণ হচ্ছে। পাতা হারাচ্ছে সবুজ রং। ফুলের পাপড়ি জুড়ে দেখা গেছে ধুলো আর ধুলো। বসার বেঞ্জগুলোতেও ধুলোর আস্তর। একই চিত্র দেখা গেছে হাতিরঝিল এলাকায়। একদিকে লেকের পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে মহাদুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে চারপাশ জুড়ে। অন্যদিকে ধুলোর প্রভাব তো আছেই। সব মিলিয়ে যারা নিয়মিত হাতিরঝিল বা রমনায় হাঁটতে আসতেন তাদের অনেকেই মাস্ক ব্যবহার করতে শুরু করেছেন। আর মতিঝিল থেকে প্রেসক্লাব হয়ে ফার্মগেট পর্যন্ত আসা মানেই মহাদুর্ভোগের নাম। যারা এই সড়কটি নিয়মিত ব্যবহার করছেন তারাই বলতে পারবেন কি অবস্থা। এইটুকু রাস্তা পারি দিতে গায়ের রং যেন বদলে যায়। আর যদি সাদা পোশাক থাকে তবে এর রং হবে ধূসর। প্রাকৃতিকভাবেই রং বদলায় ধুলো। শনিবার ছিল একুশে বইমেলার শেষ দিন। ছুটির দিন হওয়ায় সকালে শিশু প্রহর থেকেই মেলা ছিল জমজমাট। শেষ অবধি মানুষ আর মানুষ মুখর ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে পুরো এলাকায়। সড়কের মাঝখানে চলছে মেট্রো রেলের মহাকর্মযজ্ঞ। তাই মাটি আর ধুলো রাস্তা জুড়ে। যা বাতাসে মিলে এলাকায় চিত্র স্বাভাবিক নয়। এরমধ্যেই চলছে খোলা খাবার বেচাকেনা। মেলায় আগত প্রত্যেকেই ধুলো নিয়ে ক্ষোভ জানিয়েছেন। পরিবেশ রক্ষায় পর্যাপ্ত পানি ছিটানোর দাবি জানিয়েছেন তারা। রাজধানীর আবাসিক, বাণিজ্যিক, অফিসপাড়া থেকে শুরু করে সবখানেই ধুলো দূষণ যেন মাত্রা ছাড়িয়েছে। সড়ক থেকে অলিগলিতেও এখন আর শান্তি নেই। রাজধানীর সবুজবাগের আহাম্মদবাগের বাসিন্দা আনিসুর রহমান বলছিলেন, একদিন যদি ঘর পরিষ্কার করা না হয় তাহলে ধুলোর স্তর জমে যায়। মনে হয় মাসাবধি ঘর পরিষ্কার করা হয় না। প্রাইভেটকার চালক মোহন বলছিলেন, আগে একদিন পর পর গাড়ি মোছা হতো। এখন তিন ঘণ্টার গাড়ি চালালে সামনের গ্লাস ঘোলাটে হয়ে যায়। দিনে অন্তত তিন থেকে চারবার গ্লাস পরিষ্কার করতে হচ্ছে। বাড্ডা এলাকার বাসিন্দা কমল জানালেন, প্রতিদিন সকালে এই এলাকায় বায়ু দূষণ রোধে সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে রাস্তায় পানি দেয়া হয়। একবার ভিজিয়ে যাওয়ার পর তিন ঘণ্টার মধ্যে সবকিছু আগের অবস্থায় ফিরে যায়। একই কথা বলছেন, স্থানীয় ব্যবসায়ী সাহেদ। তিনি আরও বলেন, ভালভাবে রাস্তা পরিষ্কার করা গেলে ধুলো কম হতো। সবচেয়ে বেশি ধুলো হচ্ছে বিভিন্ন যানবাহনের চাকা থেকে। আগারগাঁও ও ফার্মগেট এলাকায় মেট্রো রেলের মহাকর্মযজ্ঞ চলছে। নির্মাণকাজে জড়িতরা বলছেন, দূষণ রোধে বেশ কয়েকমাস থেকেই পানি ছিটানো হচ্ছে। এর পরও নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হচ্ছে না। এর কারণ হিসেবে তারা বলছে, ঢাকার শুষ্ক বাতাস। তাই এ রকম হচ্ছে। জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক কাজী সাইফুদ্দিন শনিবার এক অনুষ্ঠানে বলেন, এটি শুষ্ক মৌসুম। স্বাভাবিকভাবেই এখন বাতাসে সূক্ষ্ম কণার মাত্রা বেড়ে গেছে। এই কণা ফুসফুস থেকে শ্বাসনালি পর্যন্ত আক্রান্ত করছে। যে কারণে কাশি, শ্বাসকষ্ট ও ইনফেকশনের মতো সমস্যা বাড়ছে। যাদের আগে থেকেই এ্যাজমা রয়েছে তাদের সমস্যা জটিল হচ্ছে। বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইড ও কার্বন মনোক্সাইড বেড়ে যাওয়ার ফলে ফুসফুসে ক্যান্সারের সংক্রমণও বাড়ছে। বায়ু দূষণের কারণে শিশুরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জানিয়ে সহকারী অধ্যাপক কাজী সাইফুদ্দিন বলেন, বাতাসে সীসার উপস্থিতি থাকায় শিশুদের স্বাভাবিক বুদ্ধির বিকাশ হচ্ছে না। যেটি ভবিষ্যতে একটি বুদ্ধিহীন জনগোষ্ঠী তৈরি করতে পারে। ঢাকায় ধুলো বেড়ে যাওয়ার কারণ খুঁজতে দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে গিয়ে জানা যায়, তারা নিজেরাও এ সমস্যার বিব্রত। এমনকি ধুলোর হাত থেকে রেহাই পেতে কর্পোরেশনের চাকরিজীবীরা পর্যন্ত মাস্ক পরে অফিস করছেন। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, দক্ষিণ ঢাকার সড়কে আমরা প্রতিদিন দুই বেলা পানি ছিটাই। যেসব রাস্তায় ধুলো বেশি সেখানে বেশি পানি ছিটানো হয়। কিন্তু তাতেও ঠিকমতো কাজ হচ্ছে না। আমরাও আক্রান্ত। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের নেতা আবু নাসের খান ধুলো ও ধোঁয়া বৃদ্ধির পেছনে বেশকিছু বিষয়কে প্রত্যক্ষভাবে দায়ী করেছেন। তিনি বলেন, রাজধানীর চারপাশে ইটভাঁটির নিম্নমানের কয়লা ব্যবহার, যানবাহনেও নিম্নমানের জ্বালানি এবং অপরিকল্পিত নির্মাণ ও সংস্কার কাজের ফলে ঢাকার বায়ুমান চূড়ান্ত পর্যায়ে খারাপ হচ্ছে। তিনি বলেন, এক রাস্তা দশবার খোঁড়া হয়। ওয়াসা, রাজউক, সিটি কর্পোরেশন, যার যখন ইচ্ছা এসে রাস্তা খুঁড়ে রেখে যায়। এতে ধুলো বাড়ে। বাতাস বিষাক্ত হয়। ভোগান্তি হয় সাধারণ মানুষের। বায়ু দূষণের কারণে বাংলাদেশে প্রতিবছর এক লাখেরও বেশি মানুষ মারা যায়। প্রায় সমান সংখ্যক মানুষকে ভুগতে হয় দুরারোগ্য ও জটিল বিভিন্ন রোগে। এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদফতরের মহাপরিচালক এ কে এম রফিক আহমেদ বলেন, রাজধানীর বায়ুদূষণের মাত্রা কমাতে কাজ করে যাচ্ছি। দূষণ কমাতে আমরা জেল-জরিমানা পর্যন্ত করছি, কিন্তু দূষণ কমছে না। ঢাকার বিষাক্ত বাতাসকে নির্মল করতে হলে আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে, নতুন পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করতে হবে।
×