ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশ-জিম্বাবুইয়ে

লিটনের সেঞ্চুরিতে রেকর্ড জয় টাইগারদের

প্রকাশিত: ১০:৫৮, ২ মার্চ ২০২০

  লিটনের সেঞ্চুরিতে রেকর্ড জয় টাইগারদের

মিথুন আশরাফ ॥ মাঠের লড়াইয়ে নামার আগে টেস্টে যেমন ওয়ানডেতেও তেমন আত্মবিশ্বাসের সুরে কথা বলেছেন জিম্বাবুইয়ে ক্রিকেটাররা। বাংলাদেশকে হারিয়ে দেবেন। সেই উচ্চাশা দেখিয়েছেন। কিন্তু মাঠের লড়াইয়ে নামতেই সব শেষ হয়ে যায়। টেস্টে উড়ে গিয়েছিল জিম্বাবুইয়ে। এবার ওপেনার লিটন কুমার দাসের ক্যারিয়ার সেরা অপরাজিত ১২৬ রানের ইনিংসে প্রথম ওয়ানডেতে পাত্তাই পেল না জিম্বাবুইয়ে। ১৬৯ রানের বড় ব্যবধানে জিতল টাইগাররা। বাংলাদেশের ওয়ানডে ক্রিকেট ইতিহাসে রানের দিক দিয়ে সবচেয়ে বড় জয়ও মিলে গেল। রেকর্ড জয় মিলল। তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে ১-০ ব্যবধানে এগিয়েও গেল মাশরাফিবাহিনী। সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে টস জিতেই ব্যাটিং নেন বাংলাদেশ ওয়ানডে দলের অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা। উইকেট ব্যাটিংনির্ভর। তা আগেই আঁচ করা গেছে। আর তাইতো ব্যাটিং নিয়ে বড় স্কোর গড়া গেলেই হয়ে গেল, এমন পরিকল্পনা করেই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সেই সিদ্ধান্ত সঠিকও প্রমাণ হলো। জিম্বাবুইয়ের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ ৩২১ রান করল বাংলাদেশ। ৬ উইকেট হারিয়ে ৫০ ওভারে এই রান করল। তা সম্ভব হল লিটনের অসাধারণ ইনিংসে। ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় সেঞ্চুরিতে। লিটনের ১০৫ বলে ১৩ চার ও ২ ছক্কায় করা অপরাজিত ১২৬ রানের ইনিংসের সঙ্গে মোহাম্মদ মিঠুনের ৫০, শেষ মুহূর্তে মোহাম্মদ সাইফউদ্দিনের (১৫ বলে অপরাজিত ২৮) এক ওভারের ব্যাটিং তান্ডবে বিশাল স্কোর গড়ল বাংলাদেশ। ৩২২ রানের টার্গেটে খেলতে নেমে ৩৯.১ ওভারে ১৫২ রানের বেশি করতে পারেনি জিম্বাবুইয়ে। বল হাতে ৩ উইকেট শিকার করেন সাইফউদ্দিন। ২ উইকেট করে নেন মাশরাফি বিন মর্তুজা ও মেহেদী হাসান মিরাজ। ব্যাট হাতে জিম্বাবুইয়ের হয়ে সর্বোচ্চ ৩৫ রান করতে সক্ষম হন ওয়েসলে মাধেভেরে। সাইফউদ্দিন ব্যাট (২৮*) ও বল (৩/২২) হাতে অসাধারণ অলরাউন্ড নৈপুণ্য দেখান। ওয়ানডে সিরিজটিতে চরম উত্তেজনা কাজ করছে। মাশরাফির অধিনায়কত্বে সম্ভাব্য শেষ সিরিজ ভাবা হচ্ছে। তাই মাশরাফি কী করেন, সেদিকেই সবার মনোযোগটা বেশি থাকে। আবার সিরিজ শুরুর আগে যে ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তাতে সিরিজের উত্তাপ মাশরাফিকে ঘিরে আরও বেড়ে গেছে। মাশরাফি ২ উইকেট শিকার করেন। টিনোটেন্ডা মুতুম্বদজিকে আউট করে দিয়ে জিম্বাবুইয়েকে অলআউট করে দেন ‘নড়াইল এক্সপ্রেস’। জিম্বাবুইয়ে ২৩ রানেই ৩ উইকেট হারিয়ে বসে। ১ রান স্কোরবোর্ডে যোগ হতেই সাইফউদ্দিন আউট করে দেন ওপেনার টিনাশে কামুনহুকামওয়েকে (১)। একটু এগিয়ে যেতেই আবার সাইফউদ্দিন তোপ। এবার রেগিস চাকাভাকে (১১) এলবিডব্লিউ করে দেন সাইফউদ্দিন। দলের ২৩ রানে চাকাভা আউটের পর অধিনায়ক চামু চিভাভাকে (১০) আউট করে দিয়ে পাঁচ ম্যাচ পর আবার উইকেট শিকার করেন মাশরাফি। জিম্বাবুইয়ে যে নিশ্চিতভাবেই হারতে যাচ্ছে, তা বাংলাদেশের বড় স্কোর গড়াতেই ধারণা করা গেছে। আর বড় ব্যবধানেই যে হারতে যাচ্ছে, তা দলের ৪৪ রানে তাইজুল ইসলামের স্পিন জাদুর কাছে হার মেনে ব্রেন্ডন টেইলর (৮) বোল্ড হওয়াতেই বোঝা যায়। অভিষেক ওয়ানডে খেলতে নামা ওয়েসলি মাধেভেরে ও সিকান্দার রাজা মিলে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু দলের রান যখন ৭৯ হয়, তখন মুস্তাফিজুর রহমানের শর্ট বলে আউট হয়ে যান সিকান্দার (১৮)। কিছুদূর যেতেই দলের ৮৪ রানে মাধেভেরেকে (৩৫) সাজঘরে পাঠান মেহেদি হাসান মিরাজ। দলের ১০০ রান হয় অনেক কষ্টে। তবে আর ৬ রান হতেই মুতুম্বামি (১৭) রান আউট হয়ে যান। ৩ রান যোগ হতেই ডোনাল্ড তিরিপানোকে (২) আউট করে দেন মিরাজ। দলের ১৩০ রান হতেই কার্ল মুম্বাকে (১৩) বোল্ড করে দেন সাইফউদ্দিন। এরপর টিনোটেন্ডা মুতুম্বদজি ও এমপফু দলকে ১৫০ রানে নিয়ে যান। আর ২ রান হতেই মাশরাফি নিজের সপ্তম ওভার করতে এসে প্রথম বলে মুতুম্বদজিকে (২৪) আউট করে দিয়ে জিম্বাবুইয়ের শেষ উইকেটটি নিয়ে ফেলেন। তাতে করে বাংলাদেশ ওয়ানডেতে সবচেয়ে বড় জয়টি পেয়ে যায়। এর আগে ২০১৮ সালে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে যে ১৬৩ রানের জয় পেয়েছিল, সেটি এতদিন বড় জয়ের রেকর্ড ছিল। রবিবার জিম্বাবুইয়েকে ১৬৯ রানে হারিয়ে সেই রেকর্ড ভেঙ্গে নতুন রেকর্ড গড়া গেল। জিম্বাবুইয়ের বিরুদ্ধে এর আগে ২০০৯ সালে বুলাওয়েতে ৩২০ রানের স্কোর গড়েছিল বাংলাদেশ। এই স্কোরটিই এতদিন জিম্বাবুইয়ের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ স্কোর ছিল। লিটনের বিধ্বংসী ব্যাটিংয়ে রবিবার প্রথম ওয়ানডেতে সেই স্কোর থেকে ১ রান বেশি করে বাংলাদেশ। জিম্বাবুইয়ের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ স্কোর গড়ে। এ নিয়ে জিম্বাবুইয়ের বিরুদ্ধে তিনবার ৩০০ রানের বেশি দলীয় স্কোর গড়তে পারে বাংলাদেশ। ২০০৯ সালে বুলাওয়েতে ৩২০ রানের স্কোর করার পর একই সময়ে আরেক ম্যাচে বুলাওয়েতেই ৩১৩ রানের স্কোর গড়ে বাংলাদেশ। সেই থেকে জিম্বাবুইয়ের বিরুদ্ধে এত বড় স্কোর আর গড়া যায়নি। সাড়ে ১০ বছর পর আবারও এত বড় স্কোর গড়া গেছে। সেই স্কোরটিই আবার জিম্বাবুইয়ের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ স্কোর হয়ে গেল। যেভাবে বাংলাদেশ দল এগিয়ে যেতে থাকে, একটা সময় মনে হয়েছিল বাংলাদেশের ওয়ানডে ইতিহাসে যে সর্বোচ্চ ৩৩৩ রান গড়ার রেকর্ড আছে, গতবছর ওয়ানডে বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে করেছিল বাংলাদেশ, তা ভেঙ্গে ফেলা যাবে। এ রেকর্ড দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাটিং করে গড়েছিল বাংলাদেশ। তা না পারলেও প্রথম ইনিংসে ব্যাটিং করে যে বিশ্বকাপেই দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে ৩৩০ রান করার রেকর্ড গড়েছিল বাংলাদেশ, তা তো করা সম্ভব। কিন্তু শেষদিকে রান একটু ধীরগতিতে হওয়াতেই কোনটিই হয়নি। লিটন দলকে দ্রুত টেনে নিয়ে যেতে থাকেন। দ্রুত স্কোরবোর্ডে রানও জমা হতে থাকে। ৪৫ বলে হাফসেঞ্চুরি করার পর ৯৫ বলে বাউন্ডারি হাঁকিয়ে সেঞ্চুরিও করে ফেলেন লিটন। একটা সময়ে গিয়ে ২০১৮ সালের এশিয়া কাপের ফাইনালে যে লিটন (১২১ রান) নিজের জাতীয় দলের ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরিটি করেছিলেন, সেই সেঞ্চুরির কাছেও চলে যান। উইকেটে টিকে থাকলেই যে জাতীয় দলের হয়ে ক্যারিয়ারের সেরা ইনিংসটি হয়ে যাবে, তা বোঝাই যায়। ১২০ রানেও চলে যান লিটন। আর ২ রান করলেই ক্যারিয়ার সেরা ইনিংস খেলবেন। এমন মুহূর্তে ৩৭তম ওভারের দ্বিতীয় বলে গিয়ে যুব বিশ্বকাপে চমক জাগিয়ে জাতীয় দলে অভিষেক হওয়া জিম্বাবুইয়ে স্পিনার ওয়েসলি মাধেভেরের বলে স্লগ সুইপ করে মিড উইকেটের ওপর দিয়ে ছক্কা হাঁকিয়ে ক্যারিয়ার সেরা ইনিংসটি খেলেন। সেই সঙ্গে দলও ২০০ রানে চলে যায়। দলের রান ২০৫ হয়ে যায়। এমন মুহূর্তে লিটন আর হাঁটতে পারেননি। পেশিতে টান পড়ে। রানও নিতে পারেননি। সেঞ্চুরি হওয়ার পরই পেশিতে টান লাগে। তাও ব্যাট হাতে উইকেটে থাকেন। ফিজিও আগের ওভারে লিটনকে দেখতেও আসেন। কিন্তু ছক্কা হাঁকাতে গিয়ে আর কুলিয়ে উঠতে পারেননি। ফিজিওর সঙ্গে শেষপর্যন্ত মাঠের বাইরে চলে যেতে হয়। লিটন উইকেট ছেড়ে সাজঘরে যেতেই রানের গতিও কমে যায়। শুরুতে ওপেনার তামিম ইকবালকে নিয়ে ৬০ রানের জুটি গড়েন। এরপর নাজমুল হোসেন শান্তকে নিয়ে ৮০ রানের জুটি গড়েন। তামিম ধীরগতিতে খেলে ৪৩ বলে ২৪ রান করে আউট হন। আর শান্ত ৩৮ বল খেলে ২৯ রান করে দলের ১৪০ রানে আউট হন। দুইজনই আউট হয়ে গেলেও লিটন ঠিকই উইকেট আঁকড়ে থাকেন। নিজের স্টাইলিশ ধারায় ব্যাটিং করতে থাকেন। মুশফিকুর রহিমকে (১৯) নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন লিটন। কিন্তু মুশফিক বেশিদূর এগিয়ে যেতে পারেননি। দলের ১৮২ রানে গিয়ে সাজঘরে ফিরে যান। মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ ব্যাটিংয়ে নেমে ঠিকই লিটনকে যোগ্য সঙ্গ দিতে থাকেন। কিন্তু দলের ২০৬ রান হতেই লিটন চোট পেয়ে মাঠ ছাড়েন। এরপর থেকেই রানের গতিতে ভাটা পড়ে যায়। যেভাবে দ্রুত রান বাড়ছিল, তাতে ৩৫০ রান হওয়ার সম্ভাবনাও ছিল। কিন্তু তা হয়নি। মাহমুদুল্লাহ ও মোহাম্মদ মিঠুন মিলে পরের ছয় ওভারে মাত্র ২টি বাউন্ডারি হাঁকাতে পারেন। যেখানে ৩৭তম ওভারের দ্বিতীয় বলেই ২০০ রান হয়ে যায়, সেখানে পরের ছয় ওভারে দলের রান থাকে ২৪১। রানের গতি না বাড়ালে ৩০০ রান হওয়াও কঠিন হয়ে পড়ে! এমন মুহূর্তে মিঠুন খোলস ছেড়ে বের হন। ধুমধরাক্কা ব্যাটিং শুরু করে দেন। ৪৪তম ওভারে মুতুম্বদজির প্রথম বলে ছক্কা ও শেষ বলে চার মারেন মিঠুন। উত্তেজনা এবার বেড়ে যায়। পরের ওভারে মাহমুদুল্লাহ আবার সিকান্দার রাজার দুই বলে চার-ছক্কা হাঁকান। রানের গতি বেড়ে যেতে থাকে। কিন্তু মাহমুদুল্লাহ (৩২) আর বেশিদূর যেতে পারেননি। দলের ২৭৪ রানে আউট হয়ে যান। তবে মিঠুন থেমে থাকেননি। এমপফুর স্লোয়ার বলে বাউন্ডারি হাঁকিয়ে ৪০ বলে হাফসেঞ্চুরি করে ফেলেন মিঠুন। হাফসেঞ্চুরি করার পরের বলেই আউট হয়ে যান। ততক্ষণে দলের রান ২৮৯ হয়ে যায়। ৩০০ রান থেকে ১১ রান দূরে থাকে বাংলাদেশ। হাতে থাকে ২ ওভার। শেষ মুহূর্তে চলে যায় ইনিংস। যে ব্যাটসম্যানই নামবেন, তার কাজই হচ্ছে বাউন্ডারি হাঁকানোর চেষ্টা করা। মেহেদি হাসান মিরাজ (৭) নেমেই ছক্কা হাঁকান। আউটও হয়ে যান। তবে কাজের কাজটি করেন মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন। ৪৯তম ওভারে দলের রান থাকে ২৯৯। সাইফউদ্দিন শেষ ওভার ব্যাটিং করার সুযোগ পেয়েই দেখিয়ে দেন, শেষ মুহূর্তে তাকে কতটা দরকার। ওয়ানডে সিরিজ শুরুর আগে দলে সুযোগ পেয়ে সাইফউদ্দিন যেভাবে বলেছিলেন, তাতে সারমর্ম দাঁড়ায়, জিম্বাবুইয়েকে দেখিয়ে দেবেন। সাইফউদ্দিন ব্যাট হাতে দেখিয়েও দিলেন। এক ওভারে, এমপফুর করা শেষ ওভারে তিনটি ছক্কা হাঁকান সাইফউদ্দিন। টানা দুই বলে দুটি ছক্কা হাঁকানোর পর আরেকটি ছক্কা হাঁকান। দলের রান ৩০০ হয়ে শেষ পর্যন্ত ৩২১ রানেও চলে যায়। সাইফউদ্দিন ১৫ বল খেলে ৩ ছক্কায় অপরাজিত ২৮ রানও করে ফেলেন। শেষ ওভারে ব্যাটিং ভেল্কি দেখান সাইফউদ্দিন। জিম্বাবুইয়ের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ স্কোরও গড়ে বাংলাদেশ। এই স্কোর জিম্বাবুইয়ের কাছে স্বাভাবিকভাবেই পাহাড়সম হওয়ার কথা। হয়েছেও। আর তাইতো পাত্তা পায়নি জিম্বাবুইয়ে। রেকর্ড জয়ই পেল বাংলাদেশ।
×