ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

তৈয়্যবা রহমান

‘ভ্রমণ করতে ধনী হওয়ার প্রয়োজন নেই’

প্রকাশিত: ০৬:৩০, ২ মার্চ ২০২০

 ‘ভ্রমণ করতে ধনী হওয়ার প্রয়োজন নেই’

যেমনটি বলেছিলেন দার্শনিক, ঠিক তার একটি বাস্তব প্রতিফলন দেয়ার লক্ষ্যেই এই তরুণ প্রজন্মের একজনের এগিয়ে চলার গল্প। তিনি আরাফ ইন্তিসার। বর্তমানে তিনি একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইঞ্জিনিয়ার এ অধ্যয়নরত আছেন। জীবনের লক্ষ্য নিজেকে ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত দেখতে চাইলেও অনেক ছোট থেকেই তার সুপ্ত ইচ্ছা ছিল ভ্রমণ বিষয়ে সবার জন্য কিছু করার। ছোট থেকেই ভ্রমণ তার নেশা। ছুটি পেলেই ব্যাগ প্যাক, ক্যামেরা আর নিত্যসঙ্গী ল্যাপটপ নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। গত এক বছরে তিনি যেখানেই ঘুরতে বেড়িয়েছেন তৈরি করে ফেলেছেন ফলোয়ারদের জন্য তার গল্পের নানান রঙের ভ্রমণ ব্লপ। সবার সঙ্গে শেয়ার করেন তার ভ্রমণের ভাল-মন্দ সকল অভিজ্ঞতা। আর তার সঙ্গে জুড়ে দেন তার ক্যামেরায় বন্দী করা স্মৃতিময় নিসর্গের ছবি। তিনি জানেন, বর্তমানে তরুণ প্রজন্মের কাছে খুবই জনপ্রিয় মাধ্যম এখন ইউটিউব। তবে ইউটিউবার হিসেবে নিজেকে খ্যাত করার ইচ্ছা মনে মনে থাকলেও কখনও ভাবেননি তার স্বপ্ন সত্যি হতে যাচ্ছে। অনেক স্বপ্ন আর প্রত্যাশা নিয়ে গত ২০১৯ সালের ঠিক আজকের এই দিনে তৈরি করছিলেন ইউটিউব চ্যানেল। মূল উদ্দেশ্য ছিল তিনি যেখানে ভ্রমণ করবেন তার খুঁটিনাটি বিষয়গুলো ভিডিওর মাধ্যমে দর্শকদের জন্য উপস্থাপন করা। এই যেমন কোথায় ঘুরতে যাবেন, কোথায় থাকবেন, কোথায় খাবেন, সেখানে পরিবেশ কেমন অনেক কিছু। প্রযুক্তি ব্যবহার করে তিনি গোটা বিশ্বের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন তার ভুলগগুলো। তার এই ভিডিওগুলো অন্যদের ঘুরতে যাওয়ায় উৎসাহ জোগায়, প্রয়োজনীয় তথ্য পেয়ে ঘুরে আসছেন অনেকেই। ১ম ভিডিও আপলোড করার সঙ্গে সঙ্গেই বাড়তে থাকে তার দর্শকসংখ্যা। খুবই অল্প সময়েই তিনি প্রিয় হয়ে উঠলেন দর্শকদের কাছে। বর্তমানে তার সাবস্ক্রাইবার সংখ্যা ১৭ হাজারেরও বেশি। ঘুরতে যান ভালোবেসে পৃথিবীতে দুই ধরনের মানুষ আছেন। এক হলেন তারা যারা ভ্রমণ করেন প্রকৃতির বিশালতায় নিজেকে উৎসর্গ করার জন্য আর ক্লান্তি থেকে নিজেকে অবসাদ দিতে অন্যদিকে আরেক দল হলেন তারা, যারা ভ্রমণে যান না বা যাওয়ার প্রয়োজনও বোধ করেন না। আরাফ হলেন প্রথম দলের মানুষদেরই একজন। তিনি ভ্রমণ করতে ভীষণ পছন্দ করেন। তাই ঘুরতে গিয়ে তার স্মৃতিগুলো ফ্রেমবন্দী করতে ভোলেন না। সঙ্গে খুঁটিনাটি বিষয়গুলো জানিয়ে দেন ভিডিওতে যেন তার দর্শকরা পুরোপুরি গুছিয়ে ভ্রমণে যেতে পারেন। তিনি ভ্রমণকে ভালবেসে নিজের অভিজ্ঞতা সারাবিশ্বের কাছে তুলে ধরতে আগ্রহী। মূলত ট্র্যাভেলিং তার নেশা। ‘সাজেক ভ্রমণ’ দিয়েই শুরু করেছিলেন তার চ্যানেলটি গত ২০১৯-এর ২ মার্চ এ চ্যানেলটির উদ্বোধন। আর তার ঠিক দুই দিন পরই আপলোড করেছিলেন তার প্রথম ব্লগ ‘সাজেক ট্যুর।’ সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো এই ব্লগের শুটিং করেছিলেন তার নিজস্ব মোবাইল দিয়ে। কোন রকম পরিকল্পনা ছাড়াই আরাফ শুরু করেছিলেন তার শুটিং। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি জানান, ‘আমি যখন ট্যুরে ছিলাম হঠাৎ বন্ধুরা আমাকে উৎসাহিত করল ভিডিও তৈরির জন্য। ব্যাস! যেই বলা সেই কাজ’ এভাবেই শুরু হয়েছিল তার প্রথম ব্লগ। প্রথম ভিডিওটি আপলোড করার পর তার অনুভূতি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্রথমদিকে খুব বেশি দর্শক না হলেও সপ্তাহ পেরোতেই তার দর্শক সংখ্যা বাড়তে লাগল। বর্তমানে তার ঐ প্রথম ব্লগটির দর্শক সংখ্যা ৫৫ হাজারেরও বেশি।’ সঙ্গী নির্বাচন ঘুরতে যাওয়ার সঙ্গীর কথা জানতে চাইলে আরাফ জানায়, ‘আমি যেখানেই ভ্রমণে যাই, যাওয়ার আগে ঠিক জায়গা অনুযায়ী কতজন নিয়ে গেলে একটা বাজেট ট্যুর করা সম্ভব সেদিকটা খেয়াল করে সঙ্গী নির্বাচন করি। যাতে আমার দর্শকরা একটা পরিপূর্ণ তথ্য পায় এবং কম খরচে তাদের প্রিয় জায়গায় ঘুরে আসতে পারে।’ এই ব্যাপারে তার বন্ধুরা তাকে যথেষ্ট সাহায্য করে এবং কাজে স্পৃহা যোগায়, যেটা তার স্বপ্ন পূরণে অনেক সহযোগিতা করছে। পরিবারের সহযোগিতা একজন মানুষের তার কর্মক্ষেত্রে সফলতার পেছনে তার পরিবার খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যেমনটি পেয়েছেন আরাফ। এই ক্ষেত্রে আরাফ সর্বপ্রথম ধন্যবাদ জানাতে চান তার পুরো পরিবারকে। কাজের শুরু থেকেই পরিবারের প্রত্যেকের সম্পূর্ণ সমর্থন ছিল বরং তারাও খুবই আগ্রহ নিয়ে ভিডিওগুলো দেখেন। শুধু নিজের দেশেই না বাইরের দেশে ভ্রমণেও তারা সবসময়ই সহযোগিতা করেছেন। ভিডিও সম্পাদনা করেন নিজেই আরাফ তার প্রথম ভলগটি মোবাইলে করলেও পরের ভিডিওগুলো করেন তার একটি ক্যামেরার মাধ্যমে। প্রকৃতি নিজেই এক অনবদ্য জীবন্ত শিল্পকর্ম। তবুও ভ্রমণের সময় যেই দৃশ্যটি অসাধারণ বলে মনে হয়েছে সেটিই ধারণ করে ফেলেন তার ক্যামেরায়। এরপর কিছু অডিও সংযোজন করেন এবং ভিডিও এডিট করেন। তিনি এই এডিটিংয়ের কাজগুলো তার নিজের স্টুডিওতে বসেই করেন। ভিডিও এডিটিং শিখেছিলেন তার বড় ভাইয়ের কাছ থেকে। এখন নিজেই পুরো ভিডিও সম্পাদনা করেন। ভিডিওর মান ভাল রাখতে সর্বোচ্চ চেষ্টা আরাফ সবচেয়ে গুরুত্ব দেন তার ভিডিওটির মানের দিকে, কেননা কনটেন্ট যদি দর্শকদের দেখার উপযোগী না হয় তবে দর্শক সেটা পছন্দ করবে না। এ ব্যাপারে তিনি জানান, ‘আমি ভিডিওগুলো খুব যত্নের সঙ্গে উপস্থাপন করি যাতে দর্শকরা ঠিক সেই জায়গাটার আসল অনুভূতিটা বুঝতে পারেন। এমনভাবেই আমি প্রত্যেকটা মুহূর্ত ফুটিয়ে তুলি যেন দর্শকরা ভিডিও দেখতে দেখতেই সেই জায়গাটা অনুভব করতে পারে।’ তিনি ভিডিও এডিট করার সময়, সব সময় দর্শকদের কথা বিবেচনা করেই কনটেন্ট তৈরি করে থাকেন। অনেক সময় ভিডিও ধারণ করার সময় বাইরের শব্দ চলে আসে এতে কনটেন্টের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়ে যায়। তাই এই ত্রুটি এড়াতে আলাদা অডিও বা মিউজিক সংযোজন করে থাকেন। তিনি সবসময় চেষ্টা করেন কোয়ালিটি কনটেন্ট তৈরি করার। ডিএসএলআর ক্যামেরা ছাড়াও ভিডিও? আরাফ কোনরকম ডিএসএলআর ক্যামেরা ছাড়াই তৈরি করেন তার ভিডিওগুলো। অনেকই চিন্তা করেন ডিএসএলআর ক্যামেরা ছাড়া উন্নতমানের ভিডিও ধারণ সম্ভব হয় না। এ ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘এই পর্যন্ত কখনোই আমি আমার চ্যানেলের ভিডিওগুলোর জন্য ডিএসএলআর ক্যামেরা ব্যবহার করিনি, আমি সবসময় ‘গো প্রো হিরো সেভেন’ ক্যামেরা দিয়ে ভিডিও ধারণ করি।’ তিনি ভিডিও করার সময় কোন আলাদা মাইকও ব্যবহার করেন না। এক্ষেত্রে তিনি শুধু ক্যামেরা দিয়েই শুট করেন। জনপ্রিয় ভিডিওগুলো সম্প্রতি তার ভারতের একটি প্রদেশ ‘মেঘালয় সিরিজ’ খুবই জনপ্রিয় হয়েছে। এই সিরিজের ভিউয়ার্স ৩ লাখ ১৫ হাজার ছাড়িয়েছে। পাশাপাশি ‘সিকিম, দার্জিলিং’য়ের সিরিজও দর্শক বেশ পছন্দ করছে। এই পর্যন্ত তিনি সর্বমোট ২২টি ভিডিও আপলোড করেছেন তার চ্যানেলটিতে, যার দর্শকসংখ্যা এখন প্রায় আট লাখের কাছাকাছি। এর মধ্যে তার নিজের সবচেয়ে পছন্দের ভিডিও হলো ‘ইয়ান্থাম ভ্যালি, সিকিম’ এর ভøগটি। পেয়েছেন এওয়ার্ডও গত ২০১৯ সালের ৮ জুলাই বাংলাদেশ ট্র্যাভেল টিউবার্স গ্রুপ থেকে ‘বেস্ট ইয়াঙ্গ কনটেন্ট ক্রিয়েটর’ এ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন। তার জীবনে প্রথম এই ধরনের ক্রিয়েটিভ এ্যাওয়ার্ড পাওয়ার দিনটি ছিল তার পছন্দের দিনগুলোর একদিন। এই এ্যাওয়ার্ডটি তাকে অনেক বেশি উৎসাহিত করেছিল। তিনি বলেন, ‘সবচেয়ে ভাললাগে এটা ভেবে যে আমি দর্শকদের মনে জায়গা করে নিতে পেরেছি, এটা আমার আত্মবিশ্বাসকে আরও বাড়িয়েছে।’ ইউটিউবের পেছনে ব্যয় তিনি যেহেতু নিজেই ভিডিও সম্পাদন করেন তাই সেই ক্ষেত্রে কিছু ব্যয়ও করতে হয় তাকে। যেমন- গ্যাজেট সম্পৃক্ত ব্যয়, কপিরাইট ফ্রি মিউজিক লাইসেন্সিং এবং উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কম্পিউটার। অবলম্বন করেন বাড়তি কিছু সতর্কতা আরাফ ভিডিও সম্পাদনা করার সঙ্গে সঙ্গে মেনে চলেন কপিরাইট ও কমিউনিটি গাইডলাইন। তিনি জানান, ‘কপিরাইট ও কমিউনিটি গাইডলাইনের তিনটি স্ট্রাইক থাকে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে একেকটি স্ট্রাইকের জন্য ভিডিও মুছে যাওয়া, লাইভ স্ট্রিমিং বন্ধ হয়ে যাওয়া, ভিডিও আপলোড করতে না পারার মতো ঘটনা ঘটে।’ তাই তিনি এই বিষয়টিতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেন। নতুনদের জন্য পরামর্শ নতুন যারা ইউটিউবে কনটেন্ট নিয়ে কাজ করতে চায়, তাদেরও সর্বপ্রথম খেয়াল রাখতে হবে তাদের দর্শকদের প্রতি। নতুনদের জন্য পরামর্শ চাইলে তিনি বলেন, ‘কোয়ান্টিটির দিকে মূল লক্ষ্য না দিয়ে কোয়ালিটির দিকে দিতে হবে। নিজেকে দর্শকদের স্থানে বসিয়ে কনটেন্ট তৈরি করতে হবে এবং ভিডিওতে সবরকম খুঁটিনাটি যাবতীয় বিষয়গুলো উপস্থাপন করতে হবে।’ ভবিষ্যত পরিকল্পনা আরাফ তার ভিডিওগুলো তৈরি করেন মূলত তার মতো স্টুডেন্টদের জন্য যারা বাজেট ট্যুর করতে আগ্রহী। শুধু দেশেই না তার মূল উদ্দেশ্য দেশের বাইরে কিভাবে কম খরচে ঘুরে আসা যায়, তার একটি পরিপূর্ণ ধারণা দেয়া, যেমন- থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, নেপাল, ভুটান ইত্যাদি। অতি শীঘ্রই তার ইন্দোনেশিয়ার বালির একটি ভ্রমণ ভøগ উপহার পেতে যাচ্ছেন তার দর্শকরা। তবে ‘এক্সট্রিম স্পোর্টস’ তার ভীষণ পছন্দ এবং এটা তার জন্য অনেকটা নেশার মতো। এ ব্যাপারে তিনি জানান, ‘এক্সট্রিম স্পোর্টসের মধ্যে প্যারাসেইলিং, প্যারাগ্লাইডিং, জিপ লাইনিং, জেট স্কি করেছি আমি। বালিতে যেয়ে স্কুবা ডাইভিং এবং স্নোরকেলিং করব ইনশাআল্লাহ। এভাবে প্রত্যেকটা দেশে গিয়ে একটা করে এক্সট্রিম স্পোর্টস এ্যাক্টিভিটি করার ইচ্ছা আছে। থাইল্যান্ড এ স্কাই ডাইভিং আর নেপালে এ বাঞ্জি জাম্পিং করার ইচ্ছা আছে।’ আরাফ কখনোই তার চ্যানেল এর সাবস্ক্রাইবার নিয়ে চিন্তিত হন না। কেননা তার মূল উদ্দেশ্য হলো দর্শকদের খুশি করা। তিনি বলেন দর্শক যখন তার ভিডিওগুলো পছন্দ করে এবং তার ভিডিওগুলো দ্বারা উপকৃত হয়ে তাকে ধন্যবাদ জানায়, এটাই তার কাছে অনেক বড় প্রাপ্তি। আর আরাফ বাংলাদেশে একটি নতুন বিষয় নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা জানান তা হলো, ‘ডিজিটাল নোম্যাড’। বাংলাদেশে খুব একটা জনপ্রিয় না হলেও পেশা হিসেবে বহির্বিশ্বে খুবই জনপ্রিয়। ডিজিটাল নোম্যাড হলো পুরোসময় ট্র্যাভেলিং করে আয় করা আর ট্র্যাভেলিংয়ের ফাঁকে ফাঁকে কাজ করে আয় করা। শুধু পেশা হিসেবেই ট্র্যাভলিংকে গ্রহণ করা। ধীরে ধীরে এভাবেই এগিয়ে যেতে চান নতুন প্রজন্মের আরাফ ইন্তিসার। আর দর্শকদের উপহার দিতে চান আরও সুন্দর সুন্দর ভ্রমনের গল্প।
×