ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সংস্কৃতি সংবাদ

মামুনুর রশীদের নাট্যভাবনা নিয়ে আলোচনা

প্রকাশিত: ১১:১৮, ১ মার্চ ২০২০

মামুনুর রশীদের নাট্যভাবনা নিয়ে আলোচনা

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ‘আমার কাছে মনে হয়েছে, শুরু থেকে আজ পর্যন্ত নাটকের একটি শক্তিশালী কণ্ঠস্বর মামুনুর রশীদ। কারণ এতদিনে তিনি তার অবস্থন শুধু ধরেই রাখেননি, সেগুলো ক্রমাগত সংহত করে রেখেছেন। এই সংহত করতে করতে বর্তমানে ফেসবুক বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের যে আঘাত আমাদের ওপর এসে পড়েছে, সেই আঘাতকে আমরা কিভাবে সামলাতে পারছি বা পারছি না সেগুলোও তার নাটকে এনেছেন। আরণ্যক প্রযোজিত ‘কহে ফেসবুক’ নাটক তার দৃষ্টান্ত। ‘সুকান্ত লিখেছিলেন ১৮ বছর বয়স দুঃসহ। এই দুঃসহ বয়স মামুনুর রশীদকে তাড়িয়ে বেড়াক আরও কিছুদিন। আমরা চাই আপনি আমাদের সঙ্গে থাকুন এবং পথ দেখিয়ে যান’-শিল্পকলা একাডেমিতে ‘মামুনুর রশীদের নাট্যভাবনা ও আমাদের নাট্যচর্চা’ শীর্ষক আলোচনায় একথা বলেন মুখ্য আলোচক কথাসাহিত্যিক অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। দেশের নবনাট্যধারার অন্যতম প্রাণপুরুষ আরণ্যক নাট্যদলের প্রতিষ্ঠাতা মামুনুর রশীদ। জীবন আর শিল্পের সীমারেখাকে একাকার করে দিয়ে তিনি নাটককে পরিণত করেছেন আন্দোলন, সংগ্রাম আর স্বপ্নপূরণের হাতিয়ারে। অভিনেতা, নাট্যকার, নির্দেশক ও সংগঠক মামুনুর রশীদের ৭২তম জন্মদিন ছিল শনিবার। এ উপলক্ষে রাজধানীর শিল্পকলা একাডেমিতে আরণ্যকের আয়োজনে বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হয়েছে ‘দ্রোহ দাহ স্বপ্নের নাট্য আয়োজন’ শীর্ষক ছয় দিনব্যাপী বর্ণিল উৎসব। এ উৎসবের অংশ হিসেবে একাডেমির স্টুডিও থিয়েটার হলে শনিবার বিকেলে ছিল ‘মামুনুর রশীদের নাট্যভাবনা ও আমাদের নাট্যচর্চা’ শীর্ষক আলোচনা। এতে মুখ্য আলোচক ছিলেন কথাসাহিত্যিক অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। আলোচনায় আরও অংশ নেন নাট্যজন নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, মলয় ভৌমিক ও আহমেদ ইকবাল হায়দার। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন অভিনেতা আজাদ আবুল কালাম। আলোচনায় কথাসাহিত্যিক অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম আরও বলেন, মামুনুর রশীদ বেশিরভাগ সময়ে একবারে সাম্প্রতিক বিষয় তিনি নাটকে নিয়ে এসেছেন। পঁচাত্তরের বেদনাঘন মুহূর্ত সামলিয়ে উঠতে না উঠতেই এরশাদের সামরিক শাসন আমাদের অনেক কিছুর মতোই সৃজনশীল ক্ষেত্রে একটা প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেছিল। সেই অপশাসন ও নানান ধরনের রাষ্ট্রীয় অপচর্চার বিরুদ্ধে মামুন ভাইয়ের নাটকগুলো মঞ্চে আসলে মানুষের মধ্যে একটা চেতনার ছোঁয়া পেয়েছিল। সে চেতনাটি হচ্ছে আমার স্বাধীনতা আমাকেই অর্জন করতে হবে। ‘ওরা কদম আলী’ বা ‘ইবলিশ’ যে নাটকই বলুন একেবারে সময়ের আয়নায় সেগুলো ধরা পড়েছে। তার প্রধান চিন্তা ছিল মানুষ নিয়ে। প্রথম দিকে বৃহৎ জনগোষ্ঠী তার নাটকের থিম ছিল। সেখান থেকে ব্যক্তি মানুষ ও পরিবারের মানুষ তার নাটকে চলে এসেছে। কতভাবে মানুষ বিপন্ন হতে পারে এগুলোই তিনি তার নাটকে তুলে এনেছেন। এই মানুষই যে তার চিত্তের উত্থান ঘটাতে পারে এ বিষয়গুলো মামুন ভাই নাটকে এনেছেন। তিনি তার নাটকের মধ্যদিয়ে সুস্থ চিন্তাগুলো চিহ্নিত করেছেন। তার নাটকে একদিকে সমাজের অসুস্থতা সম্পর্কে একটা ধারণা জন্মে এবং সেখান থেকে উত্তরণ কিভাবে ঘটাতে পারি তারও একটা আহ্বান খুঁজে নেয়ার সুযোগ থাকে। খুব বেশি নাট্যকার আজকাল আর সেগুলো করে না। আমরা কোথায় যেন একটা সুদ্ধতার ক্ষেত্রে আমাদের সংস্কৃতিকে হারিয়ে ফেলছি। তিনটা স্তরে তার নাটককে বিন্যস্ত করা যায়। প্রথমদিকে ছিল সামাজিক বিষয়বস্থার উদ্দেশ্য, দ্বিতীয় পর্যায়ে সে উদ্দেশ্যটা এসে অনেক বেশি প্রান্তের দিকে চলে গিয়েছে। ‘রাঢ়াং’-এর মতো নাটকে দেখেছি অনেক প্রান্তিক মানুষের অবস্থান সুসংহত করেছেন। এক সময়ে ব্যক্তির দিকে তার দৃষ্টি আবদ্ধ হয়েছে। এটা ঠিক আমাদের এই সময়ে দৃশ্য মাধ্যম যখন প্রবল শক্তিতে আবির্ভূত হয়েছে, এই দৃশ্য সংস্কৃতির সময়ে ব্যক্তি বা পরিবারের অবস্থান কি এ বিষয় নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু বলেন, মামুনুর রশীদের সঙ্গে আমার সম্পর্কের অর্ধশতাব্দী অতিক্রম হয়েছে। তার সঙ্গে আমার বড়সড় আকারের কোন দ্বিমত হয়নি। আমরা দীর্ঘ সময় সাংগঠনিক কাজ ও নাটক করেছি। নাটকের ক্ষেত্রে একই মঞ্চে দুটি প্রয়োগরীতি হয়েছে, কিন্তু আমরা একটা জিনিসই বোঝার চেষ্টা করেছি। সমাজ ও সভ্যতার বিকাশে মামুন ভাই যে আধুনিকতার দর্শন মাক্সিমের তত্ত্বটাকে বুঝে, দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদকে বুঝে শিল্পে প্রয়োগ করেছেন এটা করা খুবই কঠিন কাজ। তার নাটকে প্রয়োগগুলো আলাদা, সংলাপ ও এ রীতিগুলো আলাদা। এর আগে সকালে মামুনুর রশীদকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানায় অভিনয় শিল্পীসংঘ। সন্ধ্যায় একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার প্রধান মিলনায়তনে ‘অভিনন্দন, জীবন ও শিল্পের মামুনুর রশীদ’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন সংস্কৃতিজন রামেন্দু মজুমদার, নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু ও লিয়াকত আলী লাকী। সংহতি নিবেদন করেন অভিনেত্রী সুবর্ণা মুস্তাফা। সব শেষে ছিল আরণ্যক নাট্যদল প্রযোজনা ‘কহে ফেসবুক’ নাটকের উদ্বোধনী মঞ্চায়ন।
×