ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মাদকাসক্ত সাজিয়ে নিরাময় কেন্দ্রের কক্ষে ৬ মাস আটকে অমানুষিক নির্যাতন;###;পাগল সাজানোর চেষ্টা

র‌্যাব পরিচয়ে অপহরণ-ছয় মাস পর উদ্ধার

প্রকাশিত: ১১:০৬, ১ মার্চ ২০২০

র‌্যাব পরিচয়ে অপহরণ-ছয় মাস পর উদ্ধার

গাফফার খান চৌধুরী ॥ অবশেষে প্রায় ছয় মাস পর র‌্যাব পরিচয়ে অপহৃত সেই প্রবাসী আনোয়ার হোসেন উদ্ধার হয়েছে। ক্রস ফায়ারে হত্যার ভয় দেখিয়ে তার পরিবারের কাছে ৩৬ লাখ টাকা দাবি করা হয়েছিল। টাকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করায় তাকে মাদকাসক্ত সাজিয়ে একটি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের একটি ছোট কক্ষে ছয় মাস আটকে রাখা হয়েছিল। সেখানে তার ওপর চালানো হয়েছে অমানুষিক নির্যাতন। মাথার চুল ফেলে ন্যাড়া করে এবং দাড়ি কেটে তাকে পাগল সাজানোরও চেষ্টা করা হয়েছিল। মাদক সেবন করতে করতে আনোয়ার হোসেন পাগল হয়ে গেছে বলেও প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয়েছিল। সম্পদ হাতিয়ে নিতেই পরিকল্পিতভাবে এমন লোমহর্ষক ঘটনা ঘটানো হয়েছিল। যার নেপথ্যে রয়েছে তার ভাই ও এক স্ত্রী। আনোয়ারকে উদ্ধারের পর দীর্ঘ আড়াই মাসের তদন্তে বেরিয়ে এসেছে এমন লোমহর্ষক চাঞ্চল্যকর কাহিনী। পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন পিবিআইয়ের ঢাকা মেট্রোর দক্ষিণ বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার মোঃ শাহাদত হোসেন জনকণ্ঠকে এমন ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, ঢাকা মহানগর আদালতে দায়ের হওয়া আনোয়ার হোসেনের দ্বিতীয় স্ত্রী সাথী আক্তারের দায়ের করা একটি মামলার তদন্ত করতে গিয়ে বেরিয়ে এসেছে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য। মামলার অভিযোগে মোতাবেক, গত বছরের ২৪ আগস্ট সকাল নয়টার দিকে আনোয়ার হোসেন গেন্ডারিয়ার বাড়ি থেকে টঙ্গী যাওয়ার জন্য বের হন। ওইদিন রাত আটটা থেকেই তার মোবাইল ফোন বন্ধ। এরপর স্বাভাবিক কারণেই পরিবারের লোকজন তার খোঁজখবর নেন। কিন্তু কিছুতেই তার আর হদিস মিলছিল না। এর একদিন পর গত বছরের ২৬ আগস্ট আনোয়ার হোসেনের স্ত্রীর ইমো নম্বরে ফোন আসে। ফোনে আনোয়ার হোসেনকে অপহরণ করা হয়েছে বলে জানানো হয়। তার মুক্তিপণ হিসেবে ৩৬ লাখ টাকা দাবি করা হয়। এত টাকা না থাকার কথা জানানোর পর থেকেই আনোয়ার হোসেনের আর কোন হদিস মিলছিল না। পরিবারের সদস্যরা আনোয়ারকে হোসেনের খোঁজে ঢাকাসহ আশপাশের জেলার হাসপাতালগুলোর মর্গ থেকে শুরু করে সব জেলখানায় খবর নেয়। কোথাও আনোয়ারের হদিস মেলে না। শেষ পর্যন্ত পরিবারের সদস্যরাই ধরেই নেয়, আনোয়ার হোসেনকে হত্যা করে লাশ গুম করে ফেলে দেয়া হয়েছে। এ সংক্রান্ত ঢাকার সিএমএম আদালতে স্ত্রী সাথী আক্তার একটি মামলা দায়ের করেন। মামলার তদন্তের দায়িত্ব পান পিবিআইয়ের ঢাকা মেট্রোর দক্ষিণ বিভাগের উপপরিদর্শক (এসআই) সাদেকুর রহমান। তিনি জনকণ্ঠকে জানান, বহু চেষ্টা আর প্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে শেষ পর্যন্ত আনোয়ার হোসেন বেঁচে আছেন বলে নিশ্চিত হওয়া যায়। ঘটনার প্রায় ছয় মাস পর নিউ লাইফ নামের একটি মাদকাসক্তি চিকিৎসা ও পুনর্বাসন কেন্দ্র থেকে আনোয়ার হোসেনকে উদ্ধার করা হয়। উদ্ধারের সময় আনোয়ার হোসেনকে চেনা যাচ্ছিল না। তার মাথা ন্যাড়া করা। তার দাড়ি কেটে ফেলা হয়েছে। দেখতে পাগলের মতো মনে হচ্ছিল। উদ্ধারের সময় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের লোকজন উদ্ধারকৃত ব্যক্তি আনোয়ার হোসেন নয়, বলে প্রমাণ করার চেষ্টা করছিল। এমনকি ওই ব্যক্তি নেশা করতে করতে পাগল হয়ে গেছে বলে জানায়। শুধু বলা পর্যন্ত শেষ ছিল না, নানাভাবে তারা ওই ব্যক্তি পাগল বলে প্রমাণের চেষ্টা করে নিরাময় কেন্দ্রের তরফ থেকে। উদ্ধারের পর দীর্ঘ তদন্তে বেরিয়ে আসতে থাকে চাঞ্চল্যকর তথ্য। মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা জানান, আনোয়ার হোসেন বিদেশে ছিলেন। বিদেশ থাকার সময় তিনি দুই ভাই আমির হোসেন ও খোকন এবং স্ত্রী শিউলী আক্তারের নামে টাকা পাঠাতেন। সেই টাকায় তারা গাজীপুর জেলার টঙ্গী থানাধীন চেরাগ আলী এলাকার শৈলারগাতি এলাকার আছাদ উল্ল্যাহ মার্কেটের মাতাব্বর বাড়ির ৬১ নম্বর বাড়ির জায়গাটি কেনেন। সেই জায়গায় একটি সাততলা ভবন তৈরি করা হয়। ভবনটির ফ্ল্যাট ও নিচের দোকান নিয়ে স্ত্রী শিউলী আক্তার ও দুই ভাইয়ের সঙ্গে আনোয়ার হোসেনের দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হয়। এমন পরিস্থিতিতে আনোয়ার হোসেন সাথী নামের আরেক মেয়েকে বিয়ে করে ঢাকার গেন্ডারিয়ায় বসবাস শুরু করেন। এক পর্যায়ে আনোয়ার হোসেন প্রথম স্ত্রীকে তালাক দেন। প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে মশিউর জামানের সুসম্পর্ক ছিল। অংশ লিখে নিতে দুই ভাই, প্রথম স্ত্রী ও তার বন্ধু মশিউর জামান জানান, র‌্যাব পরিচয়ে আনোয়ারকে অপহরণ করার সিদ্ধান্ত নেয়। সে মোতাবেক আনোয়ারকে গত বছরের ২৪ আগস্ট টঙ্গীতে যেতে বলে বিষয়টির মীমাংসা করার জন্য। আনোয়ার হোসেন ওই বাড়িতে গেলে রাত দশটায় এ বিষয়ে চূড়ান্ত বৈঠক হবে বলে জানায়। আনোয়ার হোসেন অপেক্ষা করতে থাকেন। এ সময় কামরুজ্জামান রায়হানের নেতৃত্বে ৪/৫ জন অজ্ঞাত ব্যক্তি ঢাকা মেট্রো চ- ১৯-৫৮৯২ নম্বরের একটি মাইক্রোবাসযোগে সেই বাড়িতে হাজির হয়। তাদের গায়ে র‌্যাবের জ্যাকেটের মতো র‌্যাব লেখা নকল জ্যাকেট ছিল। কোমরের বেল্টের সঙ্গে র‌্যাবের নকল পরিচয়পত্র ঝুলানো ছিল। তারা নিজেদের র‌্যাব পরিচয়ে আনোয়ার হোসেনকে জোরপূর্বক মুখ চেপে ধরে গাড়িতে তুলে। তার চোখ বেঁধে ফেলে। গাড়িতেই আনোয়ার হোসেনের ওপর নির্যাতন শুরু হয়। এক পর্যায়ে তাকে ক্রসফায়ারে হত্যার হুমকি দেয়। মুক্তিপণ হিসেবে আনোয়ারের পরিবারের কাছে ৩৬ লাখ টাকা দাবি করা হয়। পরিবারের তরফ থেকে অপারগতা প্রকাশ করা হয়। ইতোমধ্যেই আনোয়ারের সঙ্গে ফ্ল্যাট ও দোকান নিয়ে চলে আসা ঝামেলা মেটানোর চেষ্টা করা হয়। তাতে ব্যর্থ হলে আনোয়ার হোসেনকে মাদকাসক্ত সাজিয়ে চোখ, হাত-মুখ বেঁধে কামরুজ্জামান ওরফে রায়হানের মালিকাধীন নিউ লাইফ মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের একটি ছোট্ট কক্ষে বন্দী করে রাখা হয়। সেখানে ফ্ল্যাট ও দোকান বুঝে পেতে তার ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়। তাতেও আনোয়ার রাজি না হলে তার মাথার চুল ফেলে দিয়ে ন্যাড়া করে দেয়া হয়। মুখের দাড়ি কেটে ফেলে পাগলের মতো চেহারা বানানো হয়। এরপর স্ত্রী শিউলিসহ অন্যরা আনোয়ারের কাছ থেকে সহায় সম্পত্তি লিখে নেয়ার বার বার চেষ্টা করতে থাকে। কিন্তু লিখে নিতে পারেনি। উদ্ধারের পর থেকেই আনোয়ার হোসেন মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাকে ঢাকার একটি হাসপাতালে নিরাপত্তার সঙ্গে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে বলে জানান আনোয়ার হোসেনের দ্বিতীয় স্ত্রী সাথী আক্তার।
×