ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি

সাধারণ মানুষের জীবনে সৃষ্টি হবে ভোগান্তি

প্রকাশিত: ০৯:২৪, ১ মার্চ ২০২০

সাধারণ মানুষের জীবনে সৃষ্টি হবে ভোগান্তি

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুতের দাম। যা আজ ১ মার্চ থেকে কার্যকর হবে। ভোক্তা এবং বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ঘটনায় দাম বাড়বে নিত্যপণ্যের, সাধারণ মানুষের জীবনে সৃষ্টি হবে ভোগান্তি। এই প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ আবুল বারকাত বলেন, বিদ্যুতের দাম বাড়ার হার খুব সামান্য হলেও এর প্রভাব অনেক বেশি। কারণ বিদ্যুতসংশ্লিষ্ট পণ্যের উৎপাদন ব্যয় দ্বিগুণ হয়ে যায়। আমাদের দেশের বাড়িওয়ালাদের ‘স্বভাবের সমস্যার’ কারণে তারা এই সুযোগে বাড়িভাড়াও বাড়িয়ে দেবেন। এসব বাড়তি খরচের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আয় না বাড়ায় বাড়তি খরচ সামলানো কঠিন হয়ে যাবে সাধারণ জনগণের জন্য। আবুল বারকাত আরও বলেন, ‘বিদ্যুত ও পানির মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বাড়ানোতে যেন ধনী-গরিবের বৈষম্য না বাড়ায়, সেদিকে সংশ্লিষ্টদের সতর্ক থাকতে হবে। মুজিববর্ষের প্রাক্কালে মুজিববর্ষ শুরুর মাসেই জনগণকে বাড়তি খরচের ধাক্কায় ফেলা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সঙ্গে যায় না। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি ঢাকায় পা রেখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের প্রথম কথাই ছিল, ‘আমার মানুষ যেন খাবার পায়, কাজ পায়, উন্নত জীবনের অধিকারী হয়।’ আমরা উন্নত জীবনের অধিকারের বিষয়টা গুরুত্ব দেই না। কিন্তু সেটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এখানে উন্নত জীবন বলতে শুধু ধনীদের উন্নত জীবনের কথা বলেননি, পুরো বাংলাদেশের সব মানুষের জন্য উন্নত জীবন কামনা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। এই ভাবনাটি ভেবে কাজ করতে হবে আমাদের। বৈষম্য কমাতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। অর্থনিতিবিদ আনু মুহম্মদ বলেন, সরকার কিছু রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল প্রতিষ্ঠানকে বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে এভাবে বিদ্যুতের দাম বাড়াচ্ছে। এতে সীমিত কিছু ব্যক্তির মুনাফার জন্য সাধারণ জনগণকে ভোগান্তিতে ফেলা হবে। বনশ্রীর বাসিন্দা রেজওয়ানা হক বলেন, বিদ্যুতের দাম বাড়ার মানেই শুধু বিদ্যুত বিল বাড়া নয়। এর সঙ্গে অন্যান্য ব্যয়ও বেড়ে যায়। গ্যাসের চাপ কম থাকায় তারা বৈদ্যুতিক চুলার সাহায্যে রান্না করেন। এখন গ্যাসের বিলের পাশাপাশি বাড়তি বিদ্যুত বিলও গুনতে হবে। বিদ্যুতের দাম বাড়ায় বাড়িভাড়ার পাশাপাশি লিফট, জেনারেটর ও পানির মোটরের সার্ভিস চার্জ বেড়ে তাদের জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়াবে। বিদ্যুতের পাইকারি মূল্যহার বাড়ানোর জন্য ২০১৯ সালের ১৫ অক্টোবর বাংলাদেশ বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ড (বিউবো) এবং বিদ্যুতের সঞ্চালন মূল্যহার বাড়ানোর জন্য পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) একই বছরের ২০ অক্টোবর বিইআরসিতে আবেদন করে। এছাড়া বিদ্যুত বিতরণ কোম্পানি বা সংস্থা হিসেবে সাধারণ গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের খুচরা দাম পরিবর্তনের জন্য গত বছরের ২২ অক্টোবর বিউবো, ২১ অক্টোবর বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড ও ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি), ২৩ অক্টোবর ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি (ডেসকো) ও ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি এবং ২০ অক্টোবর নর্দার্ন ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি (নেসকো) কমিশনে আবেদন করে। এসব আবেদন পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে গত বছরের ২৮ নবেম্বর এবং ১ থেকে ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত গণশুনানি গ্রহণ করে বিইআরসি। এরপর সামগ্রিক বিষয় বিবেচনায় নিয়ে কমিশন খুচরা, পাইকারি ও সঞ্চালন- তিন পর্যায়েই বিদ্যুতের দাম পুনর্নির্ধারণ করেছে। গণশুনানির ৯০ দিনের মধ্যেই সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানানোর বিধান রয়েছে। সে হিসাবে গণশুনানির পর ৯০ দিন পূর্ণ হওয়ার সপ্তাহখানেক আগেই বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ঘোষণা দিলো বিইআরসি। এই প্রসঙ্গে অর্থনিতিবিদ আনু মুহম্মদ বলেন, বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর জন্য সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার খরচ বাড়বে যা তাদের ভোগান্তি বাড়াবে। এই মূল্যবৃদ্ধি তখনই যুক্তিযুক্ত হতো, যখন সরকারের পক্ষ থেকে সঠিক যুক্তি দেখানো হতো। এছাড়া রেগুলেটরি কমিশনের শুনানিতে সরকারের তরফ থেকে সঠিক যুক্তি দেখাতে পারেনি বলেও মন্তব্য করেন তিনি। জনজীবনে বিদ্যুতের দাম বাড়ার প্রভাব সম্পর্কে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, এতে বিদ্যুতের মাধ্যমে উৎপাদিত পণ্যের দাম বাড়বে। ফলে যারা বিদ্যুতের সরাসরি গ্রাহক না, তাদেরও জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়বে। রাজধানীর কলাবাগান এলাকার বাসিন্দা শাহরিয়ার কায়সার একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন। স্ত্রী ও দুই শিশু সন্তান নিয়ে কোনমতে টিকে আছেন এই শহরে। তিনি বললেন, এর ফলে তো জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাবে অনেক। বাসাভাড়া, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম থেকে শুরু করে সন্তানের স্কুলের সার্ভিস চার্জ পর্যন্ত বেড়ে যাবে। এই পরিস্থিতিতে তার মতো অনেকেরই আয় বাড়বে না। ফলে সীমিত আয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খাবেন। তিনবেলার জায়গায় হয়তো দুবেলা খাবেন। তার শিশু সন্তানদের পুষ্টির চাহিদা অপূরণীয় থেকে যাবে সবকিছুর দাম বেড়ে যাওয়ায়। দেখা গেছে, বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধিতে শুধু বাড়তি বিদ্যুত বিল নিয়ে চিন্তার থেকেও সামগ্রিক এই ব্যয়বৃদ্ধি নিয়েই চিন্তা বেশি। অনেকেই আশঙ্কা করছেন এতে অর্থনৈতিকভাবে যারা পিছিয়ে পড়া ‘লো-ইনকাম’ জনগণের ভোগান্তি বাড়বে। বৈষম্য আরও বেশি প্রকট হবে। বাড়বে প্রান্তিক জনগণের সংখ্যাও। আবুল বারকাত পশ্চিমা বিশ্বের উদাহরণ টেনে বলেন, তাদের আয়ের ৫০ ভাগ ব্যয় হয় বাড়িভাড়ার পেছনে। তারপর বড় খরচ হয় যাতায়াতে। সেখানে চিকিৎসাব্যয়সহ খাওয়া খরচ অনেকটাই কম। আমরাও উন্নত হওয়ার পথে আগাচ্ছি তাই আমাদের এই বিষয়ে আরও সতর্ক পদক্ষেপ নিতে হবে। বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে ধনী-গরিবের বৈষম্যের সম্পর্কের বিষয়টি নিয়ে বিশিষ্ট এই অর্থনীতি বিশেষজ্ঞের মতো, বাংলাদেশের অনেক মানুষই এখনও গৃহহীন এবং হতদরিদ্র জীবনযাপন করেন। আবার শহরাঞ্চলে বস্তিবাসী বা নিম্নমধ্যবিত্ত ‘লো-ইনকাম’ জনগণের জীবনযাত্রার মান নিম্নগামী। তাদের জন্য সামান্য বাড়তি খরচও বহন করা অনেক কঠিন হয়ে যাবে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য করণীয় সম্পর্কে আবুল বারকাত বলেন, গুলশান, বনানী, ধানমন্ডি, বারিধারার মতো জায়গার মানুষের হয়তো গায়ে লাগবে না। কিন্তু কম আয়ের জনগোষ্ঠীর বসবাস যেসব এলাকায় সেখানে বিদ্যুতের দামবৃদ্ধির প্রসঙ্গে ভিন্ন চিন্তা করতে হবে। এছাড়া প্রোগ্রেসিভ কর বা আয়ের পরিমাণের ওপর বাড়তি করের বিষয়টি কার্যকর করার পরামর্শ দেন অধ্যাপক বারকাত। কর প্রসঙ্গে বলেন, ‘অনেকেই করফাঁকি দেন।’ এর পেছনে মানুষের সঞ্চয় প্রবণতার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই সঞ্চয়ের পেছনেও কিছু বিষয় কাজ করে। যেমন অনিশ্চিত চিকিৎসাব্যয় ও হঠাৎ আসা বিপদ ইত্যাদি। সরকার যদি সাধারণ জনগণের ক্যানসার, কিডনিরোগ, হৃদরোগ ও ডায়াবেটিসের মতো জটিল ও ব্যয়সাধ্য রোগের চিকিৎসার খরচ বহন করতো, সেক্ষেত্রে মানুষ আয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কর দিতে এগিয়ে আসত। উল্লেখ্য, গত ২৭ ফেব্রুয়ারি বিইআরসির এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী- গ্রাহক, পাইকারি ও সঞ্চালন পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। এছাড়া গ্রাহক ও সঞ্চালন পর্যায়ে ৫ দশমিক ৩ শতাংশ এবং পাইকারিতে ৮ দশমিক ৪ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুতের দাম। এর আগে ২০১৭ সালের ২৩ নবেম্বর সব শেষ বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেয় বিইআরসি। ওই সময় গ্রাহক নির্বিশেষে গড়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয় প্রতি ইউনিটে ৩৫ পয়সা, যা শতাংশের হিসাবে ৫ দশমিক ৩ শতাংশ। এতে ৬ টাকা ৫০ পয়সা থেকে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম বেড়ে হয় ৬ টাকা ৮৫ পয়সা। ওই বছরের ডিসেম্বর থেকে এ দাম কার্যকর হয়। এর আগে ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে বিদ্যুতের দাম ২ দশমিক ৯৩ শতাংশ বাড়ানো হয়েছিল।
×