ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

জ্বলন্ত লাভার ওপর ভাসছে পুরান ঢাকাবাসী

প্রকাশিত: ১০:৪০, ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০

  জ্বলন্ত লাভার ওপর ভাসছে পুরান ঢাকাবাসী

রাজন ভট্টাচার্য ॥ বৃহস্পতিবার সকালটা খুব ভালভাবে শুরু হয়নি। যখন নগরীর মানুষ আড়মোড়া ভেঙ্গে ঘুম থেকে উঠছেন তখনই টিভির খবর দেখে চোখ যেন কপালে অর্থাৎ আবার আগুনের ঘটনা। ভোরে রাজধানীর দিলু রোডের একটি আবাসিক ভবনে অগ্নিকান্ডে শিশুসহ তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। আহত পাঁচ জনের মধ্যে অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক। আবাসিক এলাকা হিসেবে পরিচিত দিলু রোড। অথচ আগুন লাগা পাঁচতলা ভবনটি ছিল আবাসিক কাম বাণিজ্যিক- কেন? এ প্রশ্ন যখন সামনে তখন ফের পুরান ঢাকার কথা মনে পড়ে। মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। কারণ গোটা পুরান ঢাকাই যেন অগ্নিগিরি ভাসছে জ্বলন্ত লাভার সেখানেও আবাসিক ভবনগুলো বাণিজ্যিকীকরণ করা হয়েছে। ২৯ বিপজ্জনক কেমিক্যাল ঐতিহ্যের পুরান ঢাকার বাসাবাড়ির গুদামগুদামে। ফলে যে কোন সময় নিমতলী বা চকবাজারের মতো ট্র্যাজেডি ঘটতে পারে। পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা বলছেন, অগ্নিঝুঁকি বিবেচনায় ঢাকা শহরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর এলাকা হলো পুরান ঢাকা। আগুনের ক্ষয়ক্ষতি বাড়াবে কেমিক্যালের গোডাইন। তাছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে এই শহরে সবচেয়ে ভয়াবহ আগুনের ঘটনা ঘটছে এই পুরান ঢাকাতেই, যেখানে প্রতিটি ঘটনায় মৃত্যু ও ক্ষয়ক্ষতির সংখ্যা ছিল অনেক বেশি, যা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রকাশ পায়। নিমতলী ও চকবাজার অগ্নিকান্ড ট্র্যাজেডির পর সিটি কর্পোরেশন ও বিস্ফোরক অধিদফতরের পক্ষ থেকে কেমিক্যালের গুদাম সরিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে অভিযান পরিচালনা করতে গিয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের বাধার মুখে পড়েন। ফলে নানা ঘটনার মধ্যে চাপা পড়ে যায় কেমিক্যাল ইস্যু। ফল সেই আগের মতোই। বিপজ্জনক কেমিক্যালের গুদামের ওপরই বসবাস পুরান ঢাকার কয়েক লাখ মানুষের। যে কোন সময় ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনা যদি ঘটে, তবে ক্ষয়ক্ষতি বাড়বে। মানুষের জানমাল রক্ষায় বিপজ্জনক কেমিক্যাল সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত হলো। কিন্তু বাস্তবায়ন হলো না। তার মানে নিজেদের ইচ্ছামতো যা খুশি চলবে। অর্থের কাছে কি তাহলে জীবনের দাম একেবারেই তুচ্ছ- এ প্রশ্ন অমূলক নয়। নইলে কেন, এসব গোডাউন সরিয়ে নিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সহযোগিতা করা হয়নি। এমন কোন ব্যক্তি পাওয়া যাবে না যিনি সচেতন হয়ে নিজ দায়িত্বে গোডাউন সরিয়ে নিয়েছেন। নানা কৌশলে আবাসিক ভবনে মজুত করা হচ্ছে কেমিক্যাল! তাহলে কি নাগরিক হিসেবে কার কোন দায়দায়িত্ব নেই। এমনি করেই সবকিছু চলবে! আর ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও বাধার মুখে অভিযান থেকে সরে আসতে হবে সরকার! খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নিমতলী ট্র্যাজেডির ৯ বছর পরও নিরাপদ হয়নি পুরান ঢাকা। নিরাপত্তা ঝুঁকি আর আতঙ্কের মধ্যে এলাকাবাসীর নিত্য বসবাস। সর্বশেষ চকবাজারের ঘটনায় স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্কের মাত্রা বেড়েছে। শুষ্ক মৌসুম চলছে। ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা বাড়তে পারে- এ আশঙ্কার কথা বলা হচ্ছে বিশেষজ্ঞমহল থেকেই। ২০১০-২০ চলছে। দীর্ঘদিনেই সঙ্কটের সমাধান হয়নি। বরং গোটা পুরান ঢাকায় বারোয়ারি সমস্যার মাত্রা বেড়েছে। কেমিক্যালের গুদামের সংখ্যার পাশাপাশি পাল্লা দিয়েছে প্লাস্টিক, কাগজ, পারফিউম, গ্যাস সিলিন্ডার রিফিল, স্প্রে থেকে শুরু করে দাহ্য পদার্থের মজুদ। ঘনবসতি বোঝা তো রয়েছেই। যানজট, অনুমোদনহীন গ্যাস ও অবৈধ বিদ্যুত সংযোগ তো দুর্যোগের মাত্রা বাড়ানোর জন্য এক পা বাড়িয়ে আছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন, নিমতলীর ঘটনা থেকে শিক্ষা না নেয়ার চকবাজারসহ অন্যান্য ঘটনা ঘটেছে। কেবল দাহ্যবস্তু সরিয়ে নেয়ায় মনোযোগী না হয়ে আগুনের সূত্রপাতের কারণের দিকেও মনোযোগ দেয়া জরুরী। পুরান ঢাকার পরিবেশ যে কোন মূল্যে নিরাপদ রাখতে হবে। তারা বলছেন, ভবন থেকে বের হতে না পারায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মানুষ পুড়ে মারা গেছেন। ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো নিয়ে স্থানীয়রা যদি নিজেরা কাজ করে তাহলে দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব। ’১৪ সালের ৩ জুন শিল্পসচিব বলেছিলেন, কেমিক্যাল পল্লীতে সতেরোটি সাততলা ভবন তৈরি করে গুদাম সরানো হবে।’ পরের বছর ২ ফেব্রুয়ারি কেরানীগঞ্জে ২০ একর জায়গায় রাসায়নিক পল্লী স্থাপনের কথা বলেন তিনি। ’১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকন বলেছিলেন, ‘১ মার্চ থেকে পুরান ঢাকার কেমিক্যাল গুদাম স্থানান্তরের কাজ শুরু হবে। এর কয়েকদিন পরই তিনি সব কেমিক্যাল কারখানা সরিয়ে নেয়ার নির্দেশ দেন। ঘোষণা দিয়েও বছরের পর বছর তা কার্যকর না করতে পারার বিষয়ে সাঈদ খোকন বলেন, ওই এলাকায় শত শত বাড়িতে কেমিক্যাল রাখা হয়। আমাদের পক্ষে তো এত নজরদারি করা সম্ভব নয়। এরপরও আমরা এবার উদ্যোগ নিয়েছিলাম এলাকার প্রতিটি বাড়ি ধরে ধরে ইনস্পেকশন করব। ২২ হাজার অবৈধ গুদাম বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) এক হিসাবে দেখা গেছে, পুরান ঢাকায় ২৫ হাজার কেমিক্যাল বা রাসায়নিক দাহ্যবস্তুর গুদাম আছে। এসবের মধ্যে ১৫ হাজার আছে বাসাবাড়িতেই। মাত্র আড়াই হাজার গুদামকে ট্রেড লাইসেন্স দিয়েছে সিটি কর্পোরেশন। বাকি ২২ হাজারের বেশি গুদামই অবৈধ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার শিক্ষক ও দুর্যোগ পুনর্বাসন বিশেষজ্ঞ গওহর নঈমওয়ারা বলেন, ‘মূল সমস্যা হচ্ছে অগ্নিব্যবস্থাপনা। কেমিক্যাল থাকলে বা না থাকলেও আগুন ধরতে পারে। কাজেই গুদাম সরিয়ে নিয়ে যেখানে যাবে সেখানেও তো আগুন লাগতে পারে। ব্যবস্থাপনা নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। বাপার সাধারণ সম্পাদক আবদুল মতিন বলেন, কেমিক্যাল গুদাম সরিয়ে নিতে কর্তৃপক্ষের গাফিলতির কারণেই সামনের দিনগুলোয় আরও দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। ’১০ সালের নিমতলীর ঘটনার পর দাহ্য পদার্থের গুদাম আলাদা জায়গায় সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত ছিল। কেমিক্যাল পল্লীর কথাও শুনেছিলাম। তারপর ভেতরে ভেতরে কী হলো জানি না। স্থানীয় ব্যবসায়ী মহলকে সহযোগিতা করতে হবে। জীবনের বিনিময়ে ব্যবসা করা ভাল নয়। এত মানুষ নিহতের ঘটনার দায় তাদেরও আছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করেন গবেষক আফসান চৌধুরী। তার মতে, ‘এ দুর্ঘটনার দায় গোটা ব্যবস্থাপনার। আমাদের চোখে কী পড়ছে না তা? নিমতলীর ঘটনার পর ৩৮ সুপারিশ করা হয়েছিল। সেসবের কয়টা বাস্তবায়ন হয়েছে? শিল্প মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কেমিক্যাল পল্লী প্রকল্পটি ’২১ সাল পর্যন্ত। ৫০ একরের প্রজেক্ট। প্রায় ৯৫০ গুদাম সরানো যাবে। তারা বলছেন, গুদাম সরিয়ে নেয়ার কাজ অবশ্য সহজ নয়। স্থানীয়রা তাদের ব্যবসা দূরে নিয়ে যেতে চান না। নিমতলী ঘটনায় শতাধিক মানুষের প্রাণহানির পর তদন্ত কমিটি যেসব সুপারিশ করেছিল, তা বাস্তবায়ন হয়নি। এ কারণেই চুড়িহাট্টার আগুন এত ভয়াবহ মাত্রা পেয়েছিল। স্থপতি ইকবাল হাবীব বলেন, ‘কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে, এটাই হলো বড় ঘাটতি। ঘাটতিটা এখন এমন পর্যায়ে এসে ঠেকেছে যে ৯ বছর ধরে আমরা পুনরাবৃত্তি করার পরও এসব কার্যক্রম বাস্তবায়নে সরকারকে বাধ্য করতে পারলাম না। জনসাধারণও একইভাবে নির্লিপ্ত। তিনি বলেন, আপনি অদৃষ্টবাদিতায় যখন নিজেকে সমর্পণ করবেন, প্রতিরোধ গড়ার ক্ষেত্রে পুরোপুরি গা ছেড়ে দেবেন, তখন ওটাকে আত্মাহুতি ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। অদৃষ্টবাদিতার জন্যই এসব হত্যাকা- ঘটে চলেছে। আমাদের নিষ্ক্রিয়তায় হত্যাকা-, এই অবহেলার মৃত্যু। বাংলাদেশের বিস্ফোরক পরিদফতর বলছে, চকবাজারে যে অগ্নিকা- হয়েছিল তা বীভৎস রূপ পার উচ্চমাত্রার রাসায়নিক দাহ্য পদার্থের কারণেই। প্রধান বিস্ফোরক পরিদর্শক সামসুল আলম বলছেন, নিমতলীর ঘটনার পর এ ধরনের দাহ্য পদার্থের দোকান বা গুদাম তখন সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল, তখন আমরা ২৯ কেমিক্যালের একটি তালিকাও বলেছিলাম ওসব রাখা যাবে না। এসব কেমিক্যাল উচ্চ মাত্রার দাহ্য পদার্থ। সম্প্রতি সিটি কর্পোরেশনের সঙ্গে মিলে আমরা অভিযানও চালিয়েছিলাম। তিনি বলেন, গত বছরেও উচ্চ মাত্রার কেমিক্যাল রাখত এমন প্রমাণ পাওয়ার পর অনেকের লাইসেন্স স্থগিত করে সিটি কর্পোরেশন। এমনকি যে ভবনে আগুন লেগেছিল সেটিতেও রাসায়নিক দ্রব্য ও দাহ্য পদার্থ রাখার কোন অনুমতি ছিল না।
×