ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

দিলু রোডে অগ্নিকান্ড ॥ রনি-ফেরদৌস দম্পতি লাইফ সাপোর্টে

প্রকাশিত: ১০:৩১, ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০

  দিলু রোডে অগ্নিকান্ড ॥  রনি-ফেরদৌস দম্পতি  লাইফ সাপোর্টে

গাফফার খান চৌধুরী ॥ এই ছবি এখন শুধুই স্মৃতি। মায়ের কোলে হাস্যোজ্জ্বল আদরের একমাত্র ছেলে রুশদী পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে। আর মা জান্নাতুল ফেরদৌস এখনও জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। রনি-ফেরদৌস দম্পতি শেখ হাসিনা বার্ন এ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে লাইফ সাপোর্টে। তাদের বাঁচার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ বলে জানিয়েছেন বার্ন ইউনিটের প্রধান সমন্বয়ক অধ্যাপক ডাঃ সামন্তলাল সেন। ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে ঢাকার ইস্কাটনের দিলু রোডের গ্রীন হাউস নামে বাড়িটি এখন ‘ব্ল্যাক হাউসে’ পরিণত হয়েছে। পুড়ে অঙ্গার রুশদি ও তার বোন জুঁথি নামের এক তরুণীসহ তিন জন। বাড়িটির যে কোন দিকের বারান্দা বা জানালার গ্রিল খোলা রাখার ব্যবস্থা থাকলে প্রাণহানির ঘটনা ঘটনার ন্যূনতম কোন সম্ভাবনা ছিল না বলে বেঁচে যাওয়া বাসিন্দাদের দাবি। ঢাকার প্রতিটি বাড়িতে এজন্য জানালা বা বারান্দার গ্রিল যাতে খোলা যায়, এমন ব্যবস্থা রাখার দাবি করেছেন তারা। বাড়িটির সিঁড়ির গোড়ায় থাকা বৈদ্যুতিক বোর্ডে শর্টসার্কিট থেকে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনাটি ঘটে বলে বাড়ির বাসিন্দাদের দাবি। সর্বনাশা আগুন বাড়িটির গায়ে কিভাবে কালি লেপে দিয়েছে, তা নিজ চোখে না দেখলে বোঝা যাবে না। শুধু বাড়ির গায়ে নয়, পুরো এলাকার মানুষের মনে ভয়াবহ অগ্নিকান্ড রীতিমতো কালিমা লেপে দিয়ে গেছে। বিষাদের ছায়া নেমে এসেছে পুরো এলাকায়। আগুনের ভয়াবহতা দেখতে শত শত মানুষ ভিড় করছেন বাড়িটির কাছে। বাড়িটি রীতিমতো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। অগ্নিকান্ডের বিষয়ে গভীর অনুসন্ধান করছে ফায়ার সার্ভিসের তরফ থেকে গঠিত পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি। কমিটিকে দ্রুততার সঙ্গে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে। বৃহস্পতিবার ভোর চারটার দিকে ঢাকার হাতিরঝিল থানাধীন দিলু রোডের ইউনাইটেড হাউজিং এলাকার ৪৫/এ নম্বর ছয়তলা বাড়িতে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনাটি ঘটে। প্রায় পাঁচ কাঠা জমির ওপর বাড়িটি নির্মিত। বাড়িটিতে উত্তর ও দক্ষিণ নামে দুইটি ব্লকে ভাগ করে দুই ইউনিটে বাড়িটি তৈরি। বাড়িটির চারদিকের বারান্দায় সবুজ গাছ লাগানো ছিল। দূর থেকে বাড়িটি সবুজ বাড়ি হিসেবে দেখা যেত। এজন্যই বাড়িটির নাম রাখা হয়েছিল গ্রীন হাউস। সরেজমিনে দেখা গেছে, সেই গ্রীন হাউস এখন ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের পর ব্ল্যাক হাউসে পরিণত হয়েছে। পুরো বাড়িটির ভেতরে বাইরে কালো হয়ে আছে। আগুনের তাপে বাড়িটির পলেস্তার খসে পড়েছে। বাড়ির ভেতরের সব মালামাল পুড়ে গেছে। বাড়িটির নিচের গ্যারেজে থাকা পাঁচটি প্রাইভেটকার পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে। স্থানীয় এবং বাড়ির বাসিন্দারা জানান, বাড়িটির সিঁড়ির গোড়ায় থাকা বৈদ্যুতিক সুইচ বোর্ডটিতে শর্টসার্কিট হয়ে বিকট শব্দে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এরপর সেখান থেকেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে। সেই আগুন সামনে থাকা পাঁচটি প্রাইভেটকারে লেগে যায়। প্রাইভেটকারগুলোতে গ্যাস ও অকটেন ছিল। এতে করে আগুন আরও মারাত্মক হয়। এছাড়া পাঁচটি প্রাইভেটকারের একটি করে বাড়তি চাকাসহ মোট টায়ারের চাকায় আগুন লেগে যায়। আগুন মারাত্মকভাবে সিঁড়ি দিয়ে ওপরের দিকে উঠতে থাকে। তখন পুরো সিঁড়িতে আগুন জ্বলছিল। কাঠের মোটা দরজা পুড়ে আগুন ভেতরে ঢুকে পড়ে। আর তাতেই প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। বাড়িটির তৃতীয় তলার এক বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনকণ্ঠকে বলেন, ঘটনা ভোর পাঁচটার দিকে। তখন সবাই ঘুমাচ্ছিল। চিৎকার চেঁচামেচি শুনে আমি ঘুম থেকে উঠি। উঠে বারান্দায় গিয়ে দেখি শত শত মানুষ। তারা আগুন আগুন বলে চিৎকার করছিলেন। আমাকে তারা ছাদে উঠে যাওয়ার অনুরোধ করছিলেন। আমি দ্রুত স্ত্রী ও দুই সন্তানকে ঘুম থেকে জাগিয়ে দেই। সাইকেল চালানোর সময় একমাত্র ছেলেটির হাত ভেঙ্গে গেছে। আমি একা গিয়ে ঘরের মূল দরজা সামান্য খোলা মাত্রই মনে হলো, পুরো আগুন ঘরে ঢুকে যাচ্ছে। প্রচন্ড তাপে আমার প্রায় অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার অবস্থা হয়। তখন আমার সামনের দক্ষিণ দিকের ফ্ল্যাটে পুরোদমে আগুন গ্রাস করে ফেলেছে। আমি জীবন বাঁচাতে সামনের দিকের বারান্দার গ্রিল ভেঙ্গে ফেলার চেষ্টা করতে থাকি। স্ত্রী আর আমি চেষ্টার এক পর্যায়ে একটি গ্রিল সামান্য ফাঁকা হয়। যেন প্রাণ পাই। এরপর সেই ফাঁকা গ্রিলের ভেতরে নিজের শরীর, হাত, পা ঢুকিয়ে দিয়ে সজোরে চাপ দিতে থাকি। দেখলাম একটি গ্রিল পুরোপুরি বাঁকা হয়ে গেল। এ সময় পাশের বাড়ির এক ব্যক্তি একটি বাঁশের মই এনে আমাদের বারান্দায় লাগিয়ে দিল। আমরা সেই গ্রিলের ফাঁকা দিয়ে মইয়ের সাহায্যে কোনমতে নিচে নেমে জীবন বাঁচাতে পারলাম। যে ফ্ল্যাটে দুই পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে, তারা ঠিক আমাদের ফ্ল্যাটের সামনের মুখোমুখি ফ্ল্যাটের বাসিন্দা ছিল। আমরা দরজা খুললে বা গ্রিল ভেঙ্গে বের হতে না পারলে আমাদেরও কে এম রুশদি (৪) ও আফরিন জান্নাত জুঁথির (১৭) মতো পুড়ে কয়লা হতে হতো। তাই আমি মনে করি প্রত্যেকটি বাড়ির জানালা বা বারান্দার কোথাও না কোথাও গ্রিল কেটে রেখে সেখানে বাড়তি তালা বা ছিটকিনি দিয়ে আটকিয়ে রাখার ব্যবস্থা থাকা উচিত। এছাড়া বাসার ভেতরে লোহার ভারি হাতুড়ি, রশি ও মই রাখা উচিত। যাতে কোন বিপদ হলে দ্রুত সেই গ্রিল খুলে নিরাপদে নেমে যাওয়া যায়। এটি বাড়ির মালিকদের তাদের বাসিন্দাদের স্বার্থেই এমন ব্যবস্থা করে দেয়া প্রয়োজন। অথচ কোন বাড়িওয়ালা কোন ফ্ল্যাটের একটি গ্রিলও পাতলা লাগায় না। খোলা রাখার তো প্রশ্নই আসে না। এতে করে বাসা বাড়িতে অগ্নিকান্ডের সময় বাসিন্দারা আটকা পড়ে। ফলে প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। জানালা বা বারান্দার গ্রিল খোলার ব্যবস্থা থাকলে আমার সামনের ফ্ল্যাটের চার বছরের অবুঝ শিশু এ কে এম রুশদি ও সতেরো বছর বয়সী আফরিন জান্নাত জুঁথিকে (১৭) জীবন্ত দগ্ধ হয়ে মরতে হতো না। জুঁথি ভিকাররুন নিসা নূন স্কুল এ্যান্ড কলেজ থেকে এ বছর এইচএসসি পরীক্ষা দেয়ার কথা ছিল। তাদের শরীর পুড়ে একেবারে কয়লা হয়ে গেছে। তাদের চেনার কোন উপায় ছিল না। আর নিচ তলায় পুড়ে মারা যায় আবদুল কাদের লিটন (৪৩)। তিনি নিচ তলার একটি রুমে থাকতেন। রুমের জানালা দিয়েও বের হওয়ার কোন রাস্তা ছিল না। তাকে সিঁড়ির গোড়ায়, যেখানে আগুন লেগেছে সেখান দিয়ে বের হওয়ার আর কোন রাস্তা ছিল না। সেখান দিয়ে বের হওয়ার সময়ই দগ্ধ হয়ে তার মৃত্যু হয়। অগ্নিকান্ডে মারাত্মক দগ্ধ হিদুল কিরমানি রনি (৪০) ও তার স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস (৩৫) ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের আইসিইউতে লাইফ সাপোর্টে রয়েছেন। এ বিষয়ে সারাদেশের হাসপাতালগুলোতে বার্ন ইউনিট স্থাপনের প্রধান সমন্বয় অধ্যাপক ডাঃ সামন্তলাল সেন জনকণ্ঠকে বলেন, এই দম্পতির অবস্থার কোন উন্নতি হয়নি। তাদের অবস্থা স্থিতিশীল। তারা জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে রয়েছেন। আমরা তাদের বাঁচানোর যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছি। জান্নাতুলের শরীরের ৯৫ শতাংশ ও রনির শরীরের ৪৩ শতাংশ দগ্ধ হয়েছে। তাদের শ্বাসনালী পুড়ে গেছে। যা খুবই বিপজ্জনক। এ ধরনের রোগীর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। রনির পিতা এ কে এম শহিদুল্লাহ জানান, তার দুই ছেলেমেয়ের মধ্যে রনি বড়। তাদের বাড়ি নরসিংদী জেলার শিবপুর উপজেলায়। রনি বিআইভিপি নামের একটি প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার ছিলেন। পাশাপাশি আইসিএমএ নামের একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রভাষক ছিলেন। তার স্ত্রী জান্নাত বেক্সিমকো ফার্মাসিউক্যাল লিমিটেডের হিসাবরক্ষক ছিলেন। পিতা মাতা অনেক চেষ্টার পরেও তাদের একমাত্র সন্তান রুশদিকে বাঁচাতে পারেনি। নিহত জুঁথির পিতা জাহাঙ্গীর আলম (৪২) পূর্ত ভবনের প্রশাসনিক সেকশনে কর্মরত। মা লাল বানু (৩৫) গৃহিণী। আর ভাই আশিক আপন (২৪) মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। জুঁথিদের পরিবার ভবনের ছাদের একটি রুমে থাকতো। জুঁথির পিতা জাহাঙ্গীর আলম জানান, তারা ছাদ থেকে পাশের ভবনে লাফিয়ে পড়ে জীবন বাঁচান। কিন্তু জুঁথি সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে বাঁচার চেষ্টা করে পুড়ে কয়লা হয়ে যায়। আর নিহত আবদুল কাদের দ্বিতীয় তলায় থাকা ক্লাসিক ফ্যাশন ইন্টারন্যাশনাল নামের একটি বায়িং হাউজের অফিস সহকারী ছিলেন। তিনি ভবনের নিচতলায় একটি কক্ষে থাকতেন। তার এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে স্ত্রী গ্রামের বাড়িতে থাকেন। অগ্নিকা-ের ঘটনায় সুমাইয়া আক্তার (৩২), তার ছেলে মাহাদী (৯), মাহমুদুল হাসান (৯মাস) নামের তিন জন চিকিৎসাধীন। ফায়ার সার্ভিসের কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষ সূত্রে জানা গেছে, তিন জনের লাশই সিঁড়ি থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের আটটি ইউনিট ঘটনাস্থলে গিয়ে প্রায় দুই ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। ঘটনা তদন্তে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে ফায়ার সার্ভিসের তরফ থেকে। কমিটির প্রধান করা হয়েছে ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক আবুল হোসেনকে। কমিটির অন্য সদস্যরা হচ্ছেন, ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক মজিবুর রহমান, উপসহকারী পরিচালক আনোয়ার হোসেন, তেজগাঁও ফায়ার স্টেশনের সিনিয়র স্টেশন মাস্টার ফয়সালুর রহমান ও পরিদর্শক দেবব্রত বিশ্বাস। নিয়মানুযায়ী কমিটিকে ১৫ দিনের মধ্যে রিপোর্ট দিতে হয়। এ ঘটনায় দ্রুততার সঙ্গে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। ভবনটি ব্যবহার উপযোগী কি না সে সর্ম্পকে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) পরামর্শ দেবে।
×