ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

কবে আবার ফিরবে সেই সোনালি দিন?

প্রকাশিত: ১০:১০, ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০

কবে আবার ফিরবে সেই সোনালি দিন?

গৌতম পান্ডে ॥ ঢাকাই সিনেমার সোনালি দিন গত হয়েছে অনেক আগেই। চলচ্চিত্রের জোয়ার এখন আর নেই। কোন এক সময়ে নায়ক-নায়িকারা ছিলেন চলচ্চিত্রপ্রেমীদের কাছে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। এখন সেরকম আর দেখা মেলে না। দু’একজনের ওপর নির্ভর করে বাংলা সিনেমা দিনের পর দিন ধুঁকছে। দর্শক সিনেমা বিমুখ একথা বলা ঠিক হবে না। বলা যায় দর্শক বাংলা সিনেমা বিমুখ। অথচ এদেশে একসময় প্রচুর ভালমানের সিনেমা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গেও সেগুলোর কদর ছিল। ঘুরে দাঁড়াচ্ছে দেশের চলচ্চিত্র, ফিরে আসছে চলচ্চিত্রের সুদিন এসব এখন কথার কথা। তবুও নির্মিত হচ্ছে চলচ্চিত্র। মৃতপ্রায় এক ইন্ডাস্ট্রিতে পরিণত হয়ে কোনমতে যেন চলছে চলচ্চিত্রাঙ্গন। অবশ্য এরমধ্যেও ভাল গল্পের কিছু ছবিও দর্শক প্রেক্ষাগৃহে পেয়েছে। তবে সেই সংখ্যাটা অনেক কম। আমদানি করা ছবি দিয়েও সিনেমা হলে দর্শক ফেরানো যায়নি। চলচ্চিত্রে সাফল্য-ব্যর্থতা সমান্তরাল হেঁটেছে দীর্ঘদিন। আবার একের পর এক প্রেক্ষাগৃহে তালা ঝুলছে অথবা ভেঙ্গে ফেলা হচ্ছে এটাতো মিথ্যা নয়। কেন চলচ্চিত্রের এই ভগ্নদশা? এমন প্রশ্ন ঘুরে ফিরে সবার মধ্যে। এ নিয়ে চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্টদের মধ্যে প্রায়ই দেখা যায় কাঁদা ছোড়াছুড়ি। হল মালিকরা বলছেন নতুন কোন ছবি নেই, সিনেমা হল বন্ধ করা ছাড়া উপায় নেই। প্রযোজকরা বলছেন সিনেমায় লগ্নি করা টাকা ফেরত পাওয়া যায় না। পরিচালকরা দুষছেন হল মালিকদের। তাদের অব্যবস্থাপনার জন্য এ দুরবস্থা। সব মিলিয়ে দেশের সিনেমা অঙ্গন হুমকির মুখে। সিনেমায় এর মধ্যে সম্ভাবনার আলো দেখতে পাওয়া যাচ্ছে সরকার ও সিনেমাসংশ্লিষ্টদের কিছু নতুন পদক্ষেপের কারণে। এছাড়া বেশকিছু বড় বাজেটেরও ভাল গল্পের ছবি মুক্তি পেতে যাচ্ছে এ বছর। চলচ্চিত্রের সুদিন এসব ছবির মাধমে ফেরার প্রত্যাশাও করছেন চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্টরা। চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির সিনিয়র সহ-সভাপতি মিয়া আলাউদ্দিন বলেন, আমরা তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের সঙ্গে বৈঠক করেছি। আমাদের সঙ্গে ছিল চলচ্চিত্র প্রযোজক ও পরিবেশক সমিতি এবং পরিচালক সমিতি। আমরা সবাই একমত যে আমাদের সিনেমা হল বাঁচাতে হবে। হল বাঁচাতে হলে ছবির দরকার। আমরা জানিয়েছি ছবির লোকাল প্রোডাকশন দরকার, পাশাপাশি জরুরী ভিত্তিতে ভারত থেকে ছবি ইমপোর্ট করা হোক। একটা গিয়ে একটা আসা এটা থাকুক। এটার সঙ্গে জরুরী ভিত্তিতে ছবি আমদানির কথা বলেছি। আমরা চাচ্ছি আপদকালীন সময়ের দেয়ার জন্য কিছু ছবি ছাড়ের জন্য। অন্তত বছরে ১০টা হিন্দী ছবি যেটা বোম্বের সঙ্গে রিলিজ হতে পারে এমনই কথা বলেছি। এ বিষয়ে আমরা তিন সমিতি একমত শুধুমাত্র চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির দ্বিমত আছে। আমাদের ইচ্ছা শিল্পী সমিতি আমাদের সঙ্গে যাতে সহযোগিতা করে। এটা তথ্যমন্ত্রী আমদের বলেছেন শিল্পী সমিতির সঙ্গে আলোচনা করে একটা সুরাহা করবেন। প্রযোজকদের বিষয়ে আমরাও ক্লিয়ার। কারণ সমস্ত ব্যবসায়ীদের মধ্যে স্বচ্ছতা থাকা উচিত। সিনেপ্লেক্স থেকে প্রযোজকরা যে টাকাটা শেয়ার পায় এটা খুবই নি¤œতম। অতএব এই শেয়ারের বিষয়ে পুনর্বিবেচনা করা দরকার। আমাদের দেশের ছবি হলে খুবই ভাল হতো কিন্তু আমাদের দেশে তো ছবি কেউ বানাচ্ছে না। আমরা তথ্যমন্ত্রীকে বলেছি বাণিজ্যিক ভিত্তিতে যারা ছবি করে তাদেরও অনুদান দেয়া হোক। অনুদানের ছবি সিনেমা হলে চলে না, কোথায় চলে আমরা জানিও না। যারা ভাল প্রডিউসার তাদের কিছু অনুদান দেয়া হোক। তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ আমাদের কথায় একমত। চলচ্চিত্র প্রযোজক পরিবেশক সমিতির সভাপতি খোরশেদ আলম খসরু বলেন, আমাদের চলচ্চিত্র শিল্পকে কিভাবে বাঁচানো যায় এ বিষয়ে চলচ্চিত্র প্রযোজক পরিবেশক সমিতি, প্রদর্শক সমিতি ও পরিচালক সমিতি মিলে আমরা তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদের সঙ্গে সম্প্রতি বৈঠক করেছি। তথ্যমন্ত্রী আমাদের বলেছেন তিন সংগঠন মিলে একদম প্রথম সারির চলচ্চিত্রকে বাঁচানোর জন্য যে যে প্রস্তাব দরকার প্রস্তাবনা আকারে ওনাকে দেয়ার জন্য। কি কি কাজ করতে হবে সেগুলো ওনাকে দেয়ার জন্য সেই অনুযায়ী কাজ হবে। আমাদের কি কি করতে হবে সেটা করছি। এগুলো পরে ওনাকে প্রস্তাবনা আকারে পাঠাব। আমরা তো জানি আমাদের সমস্যাগুলো কি। আমাদের প্রথম কথা হলো করতে হবে। তেরশ হলের মধ্যে এখন মাত্র আশিটি হল আছে। আর দুই বছর পর তো একটিও থাকবে কি না সন্দেহ। এটার প্রতি এখন বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি আমরা। হল না থাকলে ছবি বানিয়ে দেখাব কোথায়? এছাড়া আমাদের আরেকটি সমস্যা হচ্ছে সিনেপ্লেক্সে ছবি চালালে পয়সা পাই না। ওরা টিকেট বিক্রি করে সাড়ে তিনশ টাকায় আমরা পাই ষাট টাকা। মন্ত্রী মহোদয়ের হস্তক্ষেপে এটার একটা সুরাহা চেয়েছি আমরা। এছাড়া সরকারী অনুদান বাণিজ্যিক ছবিতেও আমরা দিতে বলেছি। এগুলো হলে চলবে মানুষ দেখবে। চলচ্চিত্রের এই সঙ্কটের সময় হল মালিকরাও সেই ছবি পাবে। সরকারী অনুদান যাদের দেয় তার ছবি বানিয়ে হলে দেয়না এগুলো চলে না। নিজেরা নিজেদের ছবি দেখে, কোথায় দেখে বলতে পারি না। এ দাবিটাও জানিয়েছি। তারপর এফডিসির যন্ত্রপাতি, শূটিংয়ের জিনিসগুলোর দাম আরও কমানোর জন্য বলেছি। চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সঙ্গে এ বিষয়ে আপনাদের কোন বৈঠক হয়েছে কি না জানতে চাইলে খোরশেদ আলম খসরু বলেন, শিল্পী সমিতি আমাদের এগুলোর মধ্যে কোন ফ্যাক্টর না। শিল্পীরাওতা শিল্পীই। মূলত আমাদের সঙ্গে রিলেটেড হচ্ছে ডিরেক্টর আর হল মালিকদের। হিন্দী ছবি আনার বিষয়ে মতামত জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার ক্লিয়ার বক্তব্য যে যদি আমাদের শিল্পীরা পেইন দেয় তাহলে তো সমস্যাই হয়। সকাল ৮টায় শূটিং আসে বিকেল ৫টায়। একজন এক চার থেকে পাঁচজন এসিস্ট্যান্ট নিয়ে আসে তাদের খাওয়া-দাওয়া থেকে শুরু করে সব কিছুই আমাদের করা লাগে। আমরা প্রডিউসার এখানেও টাকা খরচ করব আবার টাকা দিয়ে ইমপোর্ট করে ছবি আনব। এখন সমস্যা হচ্ছে সিনেমা দিতে পারছি না। আর কিছুদিন গেলে হল আরও বন্ধ হয়ে যাবে। দেশে যদি খাদ্যের অভাব হয় তখন কিন্তু কোন নিয়ম-কানুন মানা হয় না জরুরী ভিত্তিতে ইমপোর্ট করা হয়। আমরা সেরকম বলেছি চলচ্চিত্রের খুবই খারাপ অবস্থা, আমাদের সবার সঙ্গে আলোচনা করে একটা লিমিটের মধ্যে হল বাঁচানোর জন্য দুই চারটা হিন্দী ছবিকে একই সঙ্গে মুক্তি দেয়ার পারমিশন দেয়া যায় কি না বলেছি। মন্ত্রী বলেছেন শিল্পী সমিতির এ বিষয়ে আপত্তি আছে, তবে আমরা এটা করব যদি সব সমিতি এটা এ্যাগ্রি করে। এ বিষয়ে চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সভাপতি মুশফিকুর রহমান গুলজারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমরা তথ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বসে বলেছি আমাদের দুই তিনটি জায়গায় কাজ করতে হবে তা না হলে আমাদের চলচ্চিত্র উন্নয়ন সম্ভব না। এগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে সিনেমা হলের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। সেটা সরকারের ঋণ বা অনুদান অথবা সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে যেভাবেই হোক না কেন সিনেপ্লেক্স নির্মাণ করতে হবে। হলের সংখ্যা না বাড়ালে সিনেমা টিকবে না। তথ্যমন্ত্রী বলেছেন এ বিষয়ে আমদের চিন্তা-ভাবনা চলছে এবং আমরা পজিটিভ একটি বিষয়ে পৌঁছতে পারব। দ্বিতীয় হচ্ছে আমাদের যে সিনেমা হলগুলো আছে সিনেপ্লেক্সসহ এর থেকে প্রযোজকরা যাতে ন্যায্য পাওনাটা পায় এ বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে। এই বৈষম্য দূর করার জন্য মন্ত্রীকে বলেছি। ভ্যাট বাদ দিয়ে তার ফিফটি পার্সেন্ট যেন প্রযোজক পায় এই ব্যবস্থা করতে হবে। এটা ভারতেও হয়। এতে হবে কি প্রযোজকরা টাকা পেলে আরও ছবি নির্মাণে এগিয়ে আসবে। গত দুই বছর প্রযোজক যে আসেনি তা নয়, কিন্তু তারা লোকসান দিয়ে বিদায় নিয়ে গেছে। এ বিষয়ে প্রদর্শক সমিতিও মত দিয়েছে। তারা বলেছে সব সিনেমা হলগুলো এরকম করে না, তবে যারা করে তাদের সঙ্গে বসে এ বিষয়ে একটা সুরাহা করব। যেহেতু সিনেমা কম নির্মাণ হচ্ছে সে কারণে হল বাঁচানোর জন্য সীমিত হারে কিছু হিন্দী সিনেমা আমদানি করার জন্য তারা বলেছে। আমরা বলেছিলাম আমদানি-রফতানির মাধ্যমে তো সিনেমা আসছে তাতে অসুবিধা কি? তারা বলেছে এ ছবি আসলে চলে না, দুই চারটি হিন্দী ছবি আনার কথা বলেছে। আমরা বলেছি যদি আপদকালীন সময়ে সেটা হয় বছরে একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক হিন্দী সিনেমা আনলে অন্তত হলগুলো বাঁচবে। আমরা বলেছি ইতোমধ্যে আমাদের দেশে অনেক সিনেমা আসছে কিন্তু দর্শক সেগুলো দেখে নাই। আমরা বলেছি আমাদের সিনেমার উন্নয়ন করতে হবে তাহলেই আমাদের সিনেমা বাঁচবে। আমরা তথ্যমন্ত্রী মহোদয়কে বলেছি এফডিসিতে একটা ফান্ড দিয়ে দেন যাতে প্রতি বছর সেখান থেকে দশ বারোটা ছবি বানানো যায়। আমাদের ইতিপূর্বে এর অভিজ্ঞতা আছে। আমজাদ হোসেন ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ নামের যে ছবিটি বানিয়েছিলেন তার প্রযোজক ছিলেন বিশ্বজিৎ। ছবিটি দর্শক দেখেছে এবং দেশ ও বিদেশে অনেক সুনামও পেয়েছে। এফডিসির তত্ত্বাবধানে অর্ধেক টাকায় ছবি বানানো সম্ভব। মন্ত্রী বলেছেন যত দ্রুত সম্ভব আমি এগুলো বাস্তবায়নের ব্যবস্থা করব। আশা করছি আমরা একটা রেজাল্ট পাব।
×