ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

রায়হান আহমেদ তপাদার

উদীয়মান প্রযুক্তি বনাম চতুর্থ শিল্প বিপ্লব

প্রকাশিত: ০৮:০৯, ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০

  উদীয়মান প্রযুক্তি বনাম চতুর্থ শিল্প বিপ্লব

পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত ৩টি শিল্প বিপ্লব হয়েছে। প্রথম শিল্প বিপ্লব হয় ১৭৬০ সালে বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কারের মাধ্যমে যা উৎপাদন শিল্পের সম্প্রসারণ ঘটায়। দ্বিতীয় শিল্প বিপ্লবটি হয়েছে উনিশ শতকের শেষার্ধে এবং বিশ শতকের প্রথমার্ধে ১৮৭০ সালে বিদ্যুত আবিষ্কারের মাধ্যমে যা উৎপাদন শিল্পে আমূল পরিবর্তন আনে। তৃতীয়টি ১৯৬০ সালে তথ্যপ্রযুক্তির উদ্ভবের কারণে। তার ফলে বিভিন্ন শিল্পে অভাবনীয় পরিবর্তন ঘটে। আমরা এখন চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছি। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবটি হবে মূলত ডিজিটাল বিপ্লব। তখন কল- কারখানাগুলোতে ব্যাপক হারে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হবে। শুধু কল-কারখানাই নয়, যোগাযোগ ব্যবস্থায়ও আসবে আমূল পরিবর্তন। আগের শিল্প বিপ্লবগুলোর ক্ষেত্রে দেখা গেছে মানুষ যন্ত্রকে পরিচালনা করেছে। কিন্তু ৪র্থ বিপ্লবে যন্ত্রকে উন্নত করা হয়েছে। যার ফলে যন্ত্র নিজেই নিজেকে পরিচালনা করতে পারবে। এমনিতেই মানুষের থেকে যন্ত্রের ধারণ ক্ষমতা অনেক বেশি এবং যন্ত্র অনেক নিখুঁত ও দ্রুত কাজ করতে পারে। আঠারো শতকের শেষার্ধে শিল্প উৎপাদনের ক্ষেত্রে ইংল্যান্ডে যে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা হয় তাই সাধারণভাবে শিল্প বিপ্লব নামে পরিচিত। শিল্প বিপ্লবের ফলে ইংল্যান্ড বিশ্বের প্রথম শিল্পোন্নত দেশে পরিণত হয় এবং দেশটি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে সামনে এগিয়ে যায়। তখন ইংল্যান্ডের শিল্পপণ্য পৃথিবীর সব দেশে রফতানি হতো। তাই ইংল্যান্ডকে বলা হতো পৃথিবীর কারখানা। তৃতীয় শিল্প বিপ্লব শুরু হয় ১৯৬০ সালে। এটাকে কম্পিউটার বা ডিজিটাল বিপ্লবও বলা হয়। অন্যদিকে ক্ষুদ্র ও শক্তিশালী কিন্তু সস্তা সেন্সর, মোবাইল ইন্টারনেট, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ও মেশিন লার্নিং হচ্ছে চতুর্থ বিপ্লবের ভরশক্তি। প্রতিটি বিপ্লবের সঙ্গেই এসেছে নতুন নতুন প্রযুক্তি; আর প্রযুক্তির সঙ্গে গণমাধ্যমের সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কারণ একমাত্র প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়েই গণমানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছাতে পারে গণমাধ্যম। ছাপাখানার হাত ধরে সংবাদের গণমানুষের কাছে পৌঁছানো শুরু। এরপর শিল্প বিপ্লবের প্রভাবে গণমাধ্যমের কার্যক্রমে একে একে যোগ হয়েছে টেলিফোন, ফ্যা-, টেলিপ্রিন্টার, রেডিও, টেলিভিশন, কম্পিউটার, ইন্টারনেট এবং উপজাত হিসেবে আজকের সোশ্যাল মিডিয়া। এই প্রতিটি ধাপেই সংবাদ, গণমাধ্যম এবং পাঠক, দর্শক বা শ্রোতার ভূমিকা ও অংশগ্রহণের ধরনে এসেছে আমূল পরিবর্তন। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের মতো বৃহত্তর প্রতিশ্রুতি কিংবা সম্ভাব্য মহাবিপদ নিয়ে আগের কোন শিল্প বিপ্লব হাজির হয়নি। আজকের নীতিনির্ধারকরা প্রায়ই প্রচলিত সরলরৈখিক চিন্তায় জড়িয়ে পড়েন, তাদের মনোযোগ একাধিক সঙ্কট দ্বারা ডুবে যায়। ফলে আমাদের ভবিষ্যতকে রূপদানকারী উদ্ভাবনের শক্তিগুলো সম্পর্কে কৌশলগত চিন্তা আরও গভীর করার সময় হয়েছে। বিশ্ব জনসংখ্যার ৩০ শতাংশের বেশি এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সংযুক্ত। তারা শিখতে ও শেখাতে এবং তথ্য-আনন্দ-বেদনা-দুঃখ-অভিজ্ঞতা-সাফল্য ভাগাভাগি করে নিতে সামাজিক মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে। আদর্শ বিশ্বে এই মিথষ্ক্রিয়াগুলো আন্তঃসাংস্কৃতিক বোঝাপড়া ও সংহতির সুযোগ করে দেবে। অন্যদিকে নতুন তথ্যপ্রযুক্তি দ্বারা হাজির হওয়া সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলোর অন্যতম হলো মানুষের গোপনীয়তা। কেন এটি এত প্রয়োজনীয় তা আমরা সহজাতভাবে বুঝতে পারি। আগামী বছরগুলোতে এই মৌলিক বিষয়গুলো নিয়ে বিতর্ক তীব্র হবে। আসলে গোপনীয়তা রক্ষা করা খুব কঠিনই হবে। নতুন এই কঠিন পরিস্থিতিতে গোপনীয়তার সংজ্ঞাই বদলে যাবে। আগের মতো অনেক কিছুকে আর গোপনীয় বলে রক্ষা করতে পারব না আমরা। সবকিছুই খোলামেলা হয়ে গেলে মূল্যবোধকেও নবতর নিম্নস্তরে নামিয়ে এনে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করার প্রয়োজন পড়বে। একইভাবে জিন-সম্পাদনা, জৈব প্রযুক্তি এবং এআইতে ঘটে যাওয়া বিপ্লবগুলো জীবনকাল, স্বাস্থ্য, জ্ঞান এবং ক্ষমতার বর্তমান সম্পর্ককে পেছনে ঠেলে দিয়ে মানব হওয়ার অর্থ নতুন করে সংজ্ঞায়িত করবে। অর্থাৎ আমাদের নৈতিকতা ও নৈতিক সীমারেখাকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করতে বাধ্য করবে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব। চতুর্থ শিল্প বিপ্লব বিশ্বের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে কি প্রভাব ফেলবে সেটি নিয়ে দুই ধরনের মতো পাওয়া যাচ্ছে। একদল বিশেষজ্ঞ বলছেন, এর ফলে সব মানুষেরই আয় ও জীবনমান বাড়বে। বিশ্বের পণ্য সরবরাহ প্রক্রিয়াতেও ডিজিটাল প্রযুক্তি আনবে ব্যাপক পরিবর্তন। ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের অন্যতম বৃহৎ প্রতিশ্রুতি হলো, বিশ্বের জনগণের জীবনমান উন্নত করা এবং আয়ের স্তর বৃদ্ধি করা। শিল্পোন্নত দেশগুলোতে যারা ইতোমধ্যে কানেকটেড নেটওয়ার্কের আওতায় আছে, তাদের জন্য নতুন নতুন প্রযুক্তিগুলো আরও পণ্য এবং পরিষেবা উপভোগের দুয়ার খুলে দিচ্ছে। প্রযুক্তির বাজার বিকশিত করায়ও এর ভূমিকা দেখা যাচ্ছে। উদীয়মান প্রযুক্তি নতুন পণ্য ও পরিষেবা তৈরি করে তৈরি করছে নতুন চাহিদা ও তার যোগানের ব্যবস্থা। এসব আমাদের ব্যক্তিগত জীবনের ভোগবিলাস ও আনন্দ উপভোগ বাড়িয়ে তুলবে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লব পরিণত হলে দেখা যাবে, মানবের সৃজনশীলতা উদ্ভূত এ্যালগরিদম এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার স্বয়ংক্রিয় সিদ্ধান্তে যা আসে, তা-ই ধীরে ধীরে মূল্যবোধ বলে পরিগণিত হবে। এতে সমাজে পাপের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যেতে পারে এবং মানব মননে পাপবোধ বলে কিছু অবশিষ্ট রইবে না। মানবমনের বিবিধ চাহিদাই হয়ে উঠবে মূল্যবোধের ভিত্তি। ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র যখন উপনিবেশে সংঘাত সৃষ্টি করেছে ও লুটপাট অব্যাহত রেখেছে, তখন ইউরোপের বস্তুবাদী নাগরিক তা নিয়ে মাথা ঘামায়নি, কেননা তাতে আর্থিক মুনাফার যোগ ছিল। আর্থিক মুনাফাই নৈতিকতার সীমা ঠিক করে দিয়েছিল। পশ্চিমা পুঁজিবাদী দেশগুলো এভাবে রূপান্তরের মধ্য দিয়ে গেছে যার বর্তমান নীতি হলো, ব্যক্তি ও ব্যবসার যেকোন চাহিদাই নৈতিকতার ভরকেন্দ্র হোক তা আগের মানদণ্ডে অনৈতিক বা বেঠিক। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের বিকাশমান সৃজনশীলতা, উদীয়মান প্রযুক্তিগুলো তেমন করে পুরনো নৈতিকতার ভাঙ্গনকে অবশ্যম্ভাবী করে তুলবে। অন্যদিকে ব্যবসায়িক মুনাফার একমুখী চক্রে পড়ে প্রাণ ও পরিবেশগত নৈতিকতা আরও ধসে পড়তে পারে। তৃতীয় শিল্প বিপ্লবে আমরা দেখেছি, উদ্ভিদের স্বাভাবিক প্রাকৃতিক প্রজননের প্রক্রিয়াগুলোকে চিরতরে বন্ধ করে দিয়ে বীজহীন ফল উৎপাদনকে বাণিজ্যিক বৈধতা দেয়া হয়েছে। এমনকি এসবের স্বত্ববিহীন পুনরুৎপাদনকে বাণিজ্যিকভাবে অবৈধ করা হয়েছে। জেনেটিক্যালি মোডিফায়েড উদ্ভিদ ও প্রাণীর প্রাকৃতিক সংরক্ষণগত অধিকার তো অস্বীকার করা হয়েছেই, উল্টো যেসব চাষী অতীতে নিজ শস্যবীজে চাষাবাদে অভ্যস্ত ছিলেন, তাদের বীজ ব্যবসার চক্রে ফেলা হয়েছে। ফলে উভয় দিক থেকেই অনৈতিকতাকে নৈতিকতায় রূপ দেয়া হয়েছে। দিনের শেষে আমরা চাই সিদ্ধান্তগুলো যাতে মানুষ এবং মূল্যবোধের কাঠামোর মধ্যে থাকতে পারে। আমাদের এমন ভবিষ্যত গঠন করা দরকার, যা মনুষ্যত্ব ও মানবিক মূল্যবোধকে সবার আগে রাখবে। সিদ্ধান্তগুলো যেন বৈষম্যহীন ক্ষমতায়নের মাধ্যমে সব মানুষের জন্য কাজ করে। চরম হতাশাবাদী দৃষ্টিতে বলতে গেলে আশঙ্কা হয়, চতুর্থ শিল্প বিপ্লব একদিক থেকে মানবতাকে ‘রোবটাইজ’ করার যাত্রা এবং এর ফলে আমাদের হৃদয় ও আত্মাকে বঞ্চিত করার সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে। তাই মানবপ্রকৃতির মধ্যকার সবচেয়ে যা গুরুত্বপূর্ণ : সৃজনশীলতা, সহানুভূতি, মমত্ববোধ ইত্যাদিকে প্রাধান্য দেয়ার মাধ্যমে ভবিষ্যতকে মানবিক গন্তব্যে রাখার ভিত্তিতে নতুন যৌথ এবং নৈতিক বৈশ্বিক উপলব্ধির বিকাশ ঘটাতে হবে। এটা নিশ্চিত করা আমাদের সবার কর্তব্য। এটা খুব সম্ভব যে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের শেষ দিকে এসে আমরা কি করি তা-ই শুধু পরিবর্তিত হবে না, আমরা কারা থাকব, তা-ও বদলে যাবে। এটি আমাদের পরিচয় এবং এর সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্যাগুলোকে প্রভাবিত করবে। আমাদের গোপনীয়তার অনুভূতি, মালিকানা বিষয়ক ধারণা, ভোগের ধারণা পরিবর্তিত হয়ে যাবে। আমরা কিভাবে কাজ করি, অবসর নিই, কিভাবে আমরা আমাদের পেশার উন্নতি করি, গড়ে তুলি আমাদের দক্ষতা, মানুষের সঙ্গে মিলি এবং সামাজিক সম্পর্ক লালন করি, এগুলো সবই রূপান্তর প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাবে এবং আদতে রূপান্তরিত হয়ে যাবে। ইতোমধ্যেই আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও চিকিৎসাসেবা পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। আগামী দিনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও জিন প্রযুক্তির অতিবিকাশের ফলে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের সঙ্গে প্রযুক্তি ব্যবহারের সংঘাত তৈরি হবে। এই পরিবর্তনের গতি আরও বেগবান হবে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের পরিপূর্ণ বাস্তবায়নের যুগে। ইতোমধ্যে এ বিপ্লবের ফসল হিসেবে এসে গেছে দেহে স্থাপিত প্রযুক্তি, চশমায় মনিটর, থ্রিডি প্রিন্টিং, পরিধেয় ইন্টারনেট, আইওটি, বিগ ডাটা, ড্রাইভারবিহীন গাড়ি, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, ব্লক চেন ও বিট কয়েন আর চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে পরিবর্তন আসছে জ্যামিতিক হারে, তাই শীঘ্রই আমরা মুখোমুখি হব আরও অভাবনীয় সব প্রযুক্তির। সেই সঙ্গে বদলে যাবে ম্যাসেজের মিডিয়াম। সেই অনুযায়ী প্রস্তুত হতে হবে গণমাধ্যমকেও। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে দর্শক, শ্রোতা বা পাঠকের মানস জগত অনুযায়ী বার্তা ও মাধ্যম ঠিক করতে পারলেই গণমাধ্যম গণমানুষের গ্রহণযোগ্যতা পাবে, সেই লক্ষ্য অর্জনই এখন গণমাধ্যমের চ্যালেঞ্জ। তাই শুধু শিক্ষিত নয়, দেশে দক্ষ জনগোষ্ঠী গড়ে তোলার দিকে মনোযোগ দিতে হবে। শুধুমাত্র দেশেই নয়, যারা বিদেশে কাজ করছে তাদেরও যথাযথ প্রশিক্ষণ দিয়ে বিদেশে পাঠাতে হবে। বিদেশে আমাদের ১ কোটি শ্রমিক আয় করেন ১৫ বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে ভারতের ১ কোটি ৩০ লাখ শ্রমিক আয় করেন ৬৮ বিলিয়ন ডলার। কর্মক্ষেত্রে আমাদের শ্রমিকদের অদক্ষতাই তাদের আয়ের ক্ষেত্রে এই বিরাট ব্যবধানের কারণ। সঙ্গত কারণেই আমাদের উচিত কারিগরি শিক্ষার ওপর জোর দেয়া। কারণ আগামীতে বেশিরভাগ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে শিল্প কল-কারখানাগুলোকে কেন্দ্র করে। আর যে দেশ শিল্পায়নে যত বেশি অগ্রসর সে দেশ তত বেশি উন্নত। আমরা যদি সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে না পারি তাহলে অবশ্যম্ভাবীভাবে আমাদের পিছিয়ে পড়তে হবে। লেখক : শিক্ষাবিদ, লন্ডন প্রবাসী [email protected]
×