ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

একুশ আমার গর্ব

প্রকাশিত: ০৭:৪৭, ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০

একুশ আমার গর্ব

নয়না খুব খুশি। অনেকদিন পর ছোটখালা দেশে আসছেন। মাও খুশি। একটাই মাত্র বোন তার। সেই কবে বিয়ে হয়ে বিদেশে গেছে! দু’চার বছর পর পর একবার আসে। আসে একমাসের জন্য। আত্মীয়স্বজনের বাড়ি বেড়াতেই তিনভাগ সময় চলে যায়। নয়নার মা কণা বোনকে খুব কম সময়ের জন্যই পায়। মন ভরে খাওয়াতে পারে না, গল্প করতে পারে না। মনে হয় বোনটা যেন প্লেন থেকে নেমে আবার প্লেনে উঠে গেল। এবার খালা আসছেন পাঁচ বছর পর। খালার মেয়েটাকে দুই বছরের দেখেছিল নয়না। এখন সে সাত বছরের। ছবি দেখেছে। বেশ লম্বা হয়েছে আর মেম সাহেবদের মতো ধবধবে ফর্সা। মা খুবই উত্তেজিত। খালাতো বোনের নাম টিসা। মা ওর জন্য অনেক ড্রেস কিনেছে। দোকানে গিয়ে ম্যাসেঞ্জারে ওকে দেখিয়ে দেখিয়ে তবেই কিনেছে। আর তখনই নয়না বুঝতে পেরেছে টিসা বাংলা বলতে পারে না। বাড়ি ফিরে নয়না মাকে বলে, : মা বোন বাংলা বলতে পারে না? মা বিব্রত হন। আমতা আমতা করে বলেন, : বিদেশে থাকে, ওখানে তো কেউ বাংলা বলে না। : তাতে কি, খালু খালু তো বাড়িতে ওর সঙ্গে বাংলা বলতে পারেন। মা জবাব দেন না। কি জবাব দেবেন? মেয়ের কথা অকাট্য। সত্যিই তো বাঙালীর মেয়ে বাংলা বলতে পারে না এমন কথা! অথচ বোন বাণী তো রীতিমতো বাংলার পাগল। বাংলা সাহিত্য নিয়ে পড়েছে। রবীন্দ্রনাথের বড় বড় কবিতা ওর মুখস্থ। আর ওর মেয়ে কীনা বাংলা জানে না! ফেব্রুয়ারির ২ তারিখ এলো ওরা। ঢাকায় দুদিন থাকার পর চলে গেল বগুড়ায় খালুর বাবা মার কাছে। তারপর নানান জায়গায় বেরিয়ে ঢাকায় ফিরল ফেব্রুয়ারির বিশ তারিখ। আর মাত্র দিন পাঁচেক থাকবে ওরা। মার ভীষণ মন খারাপ। খালাকে বার বার বলছেন, : এমন আসা আসিস কেন? না এলেই তো পারিস! খালা মাকে জড়িয়ে ধরে সান্ত¡না দিচ্ছেন, : মন খারাপ করো না বুবু। দেখো ঠিক একবছর পর আসব। তখন দুমাস ছুটি নিয়ে আসব। তোমার জন্য পুরো এক মাস বরাদ্দ। খালার এ কথায় মার মুখে হাসি ফোটে না। মা জানেন খালা একবছর পর আসবে না। আর খালাও জানেন, তিনি বোনকে শান্ত করার জন্য মিথ্যে সান্ত¡না দিচ্ছেন। টিসা মা খালার পাশের চেয়ারে বসে আলাপ শুনছে। বুঝতে পারছে কীনা কে জানে। নয়না ওর পাশে দাঁড়ায়। কাঁধে হাত রাখে। টিসা ফিরে তাকায়। : চলো একটু ছাদ থেকে ঘুরে আসি। ও বোঝে না। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। নয়না এবার ওর হাত ধরে। বলে, : কাম উইথ মি। টিসা নয়নার হাত ধরে হাঁটতে থাকে। নয়না শুনতে পায় মা খালাকে বলছেন, : করেছিস কি বাণী মেয়েটাকে মোটে বাংলা শেখাসনি। এটা একটা কথা হলো! বাঙালীর মেয়ে। খালা অসহায়ভাবে বলেন, : তুমি বুঝি ভাবছ আমি চেষ্টা করিনি। অনেক চেষ্টা করেছি। একটু শিখাই পর মুহূর্তে বিদেশীদের মধ্যে গিয়ে ভুলে যায়। আর বাড়ি কতক্ষণ থাকি বল। কাজেই তো থাকি। ২. ওরা ছাদে ওঠে। নয়না টিসার হাত ধরে বলে, : লিসেন টিসা। বাই বর্ন ইউ আর এ বাঙালী। ইউ হ্যাভ দু নো বাংলা। ইট ইজ আ মাস্ট। ইজ ইট নট? : ইয়েস ইয়েস। : নো ইয়েস। হ্যাঁ হ্যাঁ। হেসে ওঠে টিসা। পরদিন খুব সকালে নয়না টিসাকে ঘুম থেকে ডেকে ওঠায়। বাসার সামনে থেকে একটা রিক্সা নেয়। রিক্সা থেকে নামে মেডিক্যাল কলেজের সামনে। তারপর হাঁটতে হাঁটতে এসে দাঁড়ায় শহীদ মিনারের সামনে। শহীদ মিনার লোকে লোকারণ্য। সবাই খালি পায়ে শ্রদ্ধা জানাচ্ছে। অনেকের হাতে ফুল। নয়না বলে, : টিসা, দিস ইজ আওয়ার শহীদ মিনার। ইটস এ সিম্বল অব আওয়ার ল্যাংগুয়েজ মুভমেন্ট। ভাষা আন্দোলন। : ভাষা আন্দোলন? : ইয়েস টিসা। শহীদ মিনারের সামনে দাঁড়িয়ে ইংরেজী বলতে আমার খুব খারাপ লাগছে। কিন্তু তোমাকে বোঝাবার জন্য : তুমি বাংলায় বলো। আমি বুঝতে পারছি। চমকে ফিরে তাকায় নয়না। টিসা টেনে টেনে ভেঙে ভেঙে বলছে। কিন্তু বাংলা বলছে। ওর বাংলা বোঝা যাচ্ছে। টিসাকে জড়িয়ে ধরে নয়না। : শোন বোন, পাকিস্তানীরা এ দেশ দখল করে রেখেছিল। ওরা চেয়েছিল উর্দু হবে আমাদের রাষ্ট্রভাষা। দেশ চলবে উর্দু ভাষায়। তাই কখনো হয় বলো! তোমার আমার মায়ের ভাষা তো বাংলা। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য আন্দোলন হলো। সেই আন্দোলনে শহীদ হলেন সালাম বরকত রফিক জব্বার আরও কত না জানা বীর। তাঁদের স্মরণে এই শহীদ মিনার। সেদিন ছিল ২১ তারিখ। আজকের দিন। আজ সবাই তাঁদের স্মরণ করছে। শ্রদ্ধা জানাচ্ছে। বাংলাকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে ইউনেস্কো। : আমার কাছে যে ফুল নেই। : শ্রদ্ধা জানানোর জন্য ফুল দরকার হয় না। টিসা খালি পায়ে উঠে যায় শহীদবেদির সামনে। মাথা নত করে দাঁড়িয়ে থাকে। ওর চোখ ছলছল করে। ধীরে ধীরে নেমে আসে। বসে পড়ে শহীদ মিনারের সামনে মাটিতে। জোরে আঁকড়ে ধরে নয়নার হাত। : আপু আমি আর প্রয়োজন ছাড়া অন্য ভাষা বলব না। কাজের প্রয়োজনে বিদেশে আছি, থাকতে হবে হয়ত। কিন্তু কখনও ভুলব না, বাংলা আমার মাতৃভাষা। একুশ আমাদের গর্বের দিন।
×